১৯৭২ সালে এসআই (সাব-ইন্সপেক্টর) পদে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন আবদুল কাহ্হার আকন্দ। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৯ বছরেরও বেশি সময় চুক্তিতে পুলিশে চাকরি করেছেন তিনি। এ সময় পেয়েছেন পুলিশ সুপার এবং অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে ‘বিরল’ পদোন্নতি। এর সবই সম্ভব হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আশীর্বাদে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, জেলহত্যা মামলা, ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, বিডিআর বিদ্রোহ মামলাসহ রাজনৈতিক বিভিন্ন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন কাহার আকন্দ। মামলা তদন্তের নামে শেখ হাসিনার মিশন বাস্তবায়নই ছিল তার কাজ। এর মাধ্যমে তিনি শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত এবং আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন। ফলে পুলিশ বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক পাঁচবার বিপিএম এবং পিপিএম পদক দেয়া হয়েছে কাহার আকন্দকে।
২০১৯ সালে পুলিশের চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর থেকেই তিনি এমপি পদে প্রার্থী হতে এলাকায় জনসংযোগ শুরু করেন। অথচ ওই মেয়াদে তার কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া) আসনে এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন সাবেক আইজিপি, রাষ্ট্রদূত ও সচিব নূর মোহাম্মদ। কিন্তু সবাইকে অবাক করে এবং সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদকে বাদ দিয়ে বিগত নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন পান কাহার আকন্দ। তবে নির্বাচনী দৌড়ে সফল হতে পারেননি তিনি। আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে ধরাশায়ী হন। শেখ হাসিনার কাছের মানুষ হওয়ায় এরপরও তাকে নিয়ে এলাকায় আলোচনা ছিল- কাহার আকন্দ মন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। তিনি নিজেও মন্ত্রিত্ব পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন। তার কাছের মানুষজনকে বলেছিলেনও, নেত্রী (শেখ হাসিনা) তাকে মন্ত্রী করবেন। কিন্তু ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লব তার সেই স্বপ্ন ভেঙে দেয়। কিশোরগঞ্জ ও কটিয়াদী থানায় দায়ের হয় ৩ মামলা। অপকর্মের দায় থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। পরদিন ৬ই আগস্ট কাহার আকন্দ নিরাপদে দেশ ছেড়েছেন বলেও তার কাছের অনেকগুলো সূত্র জানিয়েছে। তবে অনেকেই বিষয়টি বিশ্বাস করছেন না। তারা মনে করছেন, দেশেই কোথাও আত্মগোপনে রয়েছেন কাহার আকন্দ।
এদিকে মানবজমিনের অনুসন্ধান এবং বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, সামান্য একজন দারোগা হিসেবে চাকরি শুরু করা কাহার আকন্দের পারিবারিক অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। বাবা মৃত মেহেদি আকন্দ ছিলেন কটিয়াদী উপজেলার সহশ্রাম ধূলদিয়া ইউনিয়নের পূর্বপুরুড়া গ্রামের একজন দরিদ্র কৃষক। বনগ্রাম আনন্দ কিশোর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তিনি। বাড়ি থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরের এ বিদ্যালয়ে তিনি হেঁটে যাতায়াত করতেন। সেখান থেকেই ১৯৬৭ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন মহকুমা সদরের গুরুদয়াল সরকারি কলেজে। সেখান থেকে ১৯৬৯ সালে এইচএসসি পাস করেন। তখন তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে তিনি পুলিশে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসআই পদে চাকরি নেন। চাকরির ধারাবাহিকতায় ধাপে ধাপে হন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) তিনি পদোন্নতি লাভ করেন। চাকরির বেশিরভাগ সময়ই তার কেটেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি)। আওয়ামী লীগের ১৯৯৬ জামানায় শুরু হয় তার স্বর্ণযুগ। ১৯৯৬ সালের ১৪ই নভেম্বর সংসদে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান আবদুল কাহার আকন্দ। এরপর তিনি জেলহত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফেরে। একই সঙ্গে চাকরিতে ফেরানো হয় চাকরিচ্যুৎ সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) কাহার আকন্দকে। ২০০৯ সালের ২৮ই জানুয়ারি চাকরি ফেরত পাওয়ার একদিন পরই তিনি অবসরে যান। কিন্তু অবসর থেকে ফিরিয়ে এনে আবদুল কাহার আকন্দকে চুক্তিতে সিআইডিতে বিশেষ পুলিশ সুপার করা হয়। চুক্তিতে ফিরেই কাহার আকন্দ ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব নেন। ২০১১ সালের ৩রা জুলাই আসামির তালিকায় আরও ৩০ জনকে যোগ করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন কাহার আকন্দ। সম্পূরক অভিযোগপত্রে তারেক রহমানসহ চারদলীয় জোট সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও বিএনপি-জামায়াত নেতাদের নাম ঢুকিয়ে দেন কাহার আকন্দ।
অনুসন্ধান এবং কাহার আকন্দের ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, কাহার আকন্দের ফর্মুলা ছিল তদন্তে শেখ হাসিনার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো। শেখ হাসিনার মিশন বাস্তবায়ন করাই ছিল তার কাজ। এর মাধ্যমে তিনি শেখ হাসিনার আনুকুল্য পাওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক ফ্লাট-প্লট ও বাড়ি করা ছাড়াও কানাডাতেও তিনি একাধিক বাড়ি করেছেন। এ ছাড়া গড়েছেন বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। একটি সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-এর জামানায় খিলগাঁওয়ের তালতলার কাহার আকন্দ একটি বহুতল ভবন করেছেন। আওয়ামী লীগের বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে তিনি রাজধানীর বসুন্ধরাসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় একাধিক ফ্লাট-প্লট ও বাড়ি করেছেন। এক সময় তিনি তালতলা’র বাসায় থাকলেও সর্বশেষ তিনি বসুন্ধরা এলাকার ফ্লাটে থাকতেন। দেশ ও দেশের বাইরে মিলিয়ে অন্তত হাজার কোটি টাকার মালিক বনেছেন কাহার আকন্দ। এ ছাড়া তার ভাই স্থানীয় সহশ্রাম ধূলদিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম আকন্দের নামেও বিপুল পরিমাণ সহায়-সম্পদ করেছেন।