পর্ব-১
সুধার পাড়া গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট সুন্দর একটি নদী। নদীটির নাম সুধার ডিয়ার। সুধার পাড়া গ্রামের সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধি এই নদী। নদীর পানি দিয়ে গাঁয়ের মাঠে ফসল ফলায় কৃষক। নদীর গভীর মিষ্টি পানিতে লুকিয়ে আছে হরেকরকম মাছ। জাল ফেললে উঠে আসে বোয়াল,রুই,পাবদা, পুটি, চিতল মাছ। রুই, কাতলা, চিংড়িও মাছ পাওয়া মাঝে মাঝে। নদীতে মাছ পাওয়া গেলেও গ্রামের প্রতিটি ধনী বাড়িতেই আছে পুকুর। চিংড়ি চাষের ঘের। সেগুন,পাইন গাছের ছায়ায় ঘেরা ছবির মতো সাজানো ছোট ছোট বাড়ি। সেগুন কাঠের তৈরী-দোচালা, তিন চালা টিনের ঘরগুলো দেখতে অনেকটাই ক্যাং ঘরের (বৌদ্ধদের উপাসনালয়) মত। কোনটা যে ক্যাং ঘর আর কোনটা মানুষের বসত বাড়ি দূর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। গ্রামের পাশের বনের মাঝ দিয়ে একে বেঁকে চলে গেছে ছোট সড়ক। এই সড়কের শেষ কোথায় নূর আল ইসলাম জানে না। যত দূর চোখ যায় বন আর বন। কিন্তু নূর আল ইসলাম জানে সুধার ডিয়ার নদী ওপারের শহরের নাম মংডু। ওর বাবা রফিকুল ইসলাম মংডু শহরের একটা কলেজের শিক্ষক। তিনি প্রতি সোমবার এই নদী পার হয়ে মংডু যান। তিনি কলেজের শিক্ষক হোস্টলে থাকেন। কলেজ ছুটির পর আবার শুক্রবার বিকেলে সুধার পাড়ার আছেন। শনিবার ও রোববার দুই দিন কলেজ বন্ধ থাকে। ঐ দিন তিনি বাড়িতে থাকেন। নূর আল ইসলামের সেদিন যে কী মজা লাগে তা বুঝানোর ভাষা কারো জানা নেই। সে বেশ কয়েকবার বাবা-মা , ভাই -বোনদেন সাথে মংডু গিয়েছে। দুই একদিন থাকতে ভালই লাগে। কিন্তু তারপর আর ভাল লাগে না। বার বার বাড়ি কথা মনে পড়ে।
নূর আল ইসলামরা দুই ভাই এক বোন। তার বড় ভাইয়ের নাম জায়েদ ইসলাম। বোনের নাম জায়েদা। বড় ভাই ক্লাস সিক্সে পড়ে। বোন ওর ছোট। এখনো স্কুলে যায় না। মায়ের কাছে বাড়িতেই পড়ে। নূর আল ইসলাম পড়ে ক্লাস ফোরে। ওরা যখন কলেজে পড়বে, তখন ওরা সবাই মংডু চলে আসবে। বাবা বাসা ভাড়া করবে। সেই বাসায় সবাই মিলে থাকবে। এ কথা ভাবতেই নূর আল ইসলামের মনটা খারাপ হয়ে যায়। দাদা-দাদী, চাচা-চাচী। চাচাত-ভাই বোন আর খেলার সাথীদের ছেড়ে সুধার ডিয়ারের ওপারে নাফ নদীর পাড়ে থাকবে। সুধার ডিয়ারের মতো কী নাফ নদী তার অত আপন। লাল রঙের ঐ যে গাভীটা তাকে দেখলেই হাম্বা হাম্বা ডাকে। সে নিজ হাতে খড় নয় তো ঘাস দেয়ার পরই শান্ত হয়। ওদের বাড়ির পাইন গাছে বাসা বেঁধেছে এক জোড়া টিয়া পাখি। বাসায় দু’টি ডিমও আছে। নূর আল ইসলাম স্কুল থেকে এসে ডিমগুলো পাহারা দেয়। তার ভয়, সে পাহারা না দিলে দুষ্ট কাঠবিড়ালিটা ডিমগুলো নষ্ট করে ফেলবে। নূর স্কুল ছুটির দিন হাবিবুল্লাহ, সিতাব আর আলাউলকে সাথে নিয়ে ঘুড়ি উড়ায়, বলি বল খেলে। কিন্তু ওরা মংডু চলে গেলে খেলবে কি করে? না. সে আর ভাবতে পারে না। তার দু চোখে বৃষ্টি নামে।
পর্ব-২
আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর- আজানের সুমধুর ধ্বনিতে নূর আল ইসলামের ঘুম ভাঙে। সে দ্রুত উঠে অজু করে দাদার সাথে মসজিদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওর পাশে এসে দাঁড়ায় মঈন। নূর আল ইসলাম পরেছে সাদা রঙের ফতুয়া আর লুঙ্গি, মাথায় সাদা টুপি। মঈনের পরনে প্রিন্টের শার্ট আর লুঙ্গি। শার্টের ওপরে বেশ শক্ত করে লুঙ্গিটা বাঁধা। মঈন নূর আল ইসলামের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলে: ‘তুমি বাঙালিদের মতো ফতুয়ার নীচে লুঙ্গি পড়েছো কেন?’
:‘কেন দেখতে ভাল লাগে না, ভাইয়া?’ নূর হাসতে হাসতে হাসতে বলে।
:’ভাল লাগলেই কি এখানে আমাদের সবকিছু করার আছে, তুমি বুঝ না?’ এ কথা বলে মঈন নূর আল ইসলামের লুঙ্গিটা ফতুয়ার ওপরে উঠিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেয়। কারণ এটাই বার্মার রীতি। এর ব্যতিক্রম দেখলে বর্মীরা তাকে বাঙালি অনুপ্রবেশকারী মনে করে। অবস্থা এতটাই খারাপ যে, তাকে নাফ নদী ওপারে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়।
অজু শেষ করে ততক্ষণে দাদা এসে গেছেন। তিনি বলেন: ‘দাদু ভাইয়েরা চলো।’
পথে যেতে যেতে নূর আল ইসলাম দাদুর কাছে জানতে চায়: ‘আচ্ছা দাদু অন্য দেশের মতো আমাদের এখানে মাইকে আজান দেয়া হয় না কেন?’
: ‘নূর সে অনেক কথা। নামাজ শেষ করে পরে বলতে হবে। এখন চলো.. ’ দাদু গম্ভীর গলায় বলেন।
মসজিদ খুব দূরে নয়। বাড়ির পাশের বাগানটার পরেই,মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। কেরোসিনের কুপির আলোয় দেখতে অভ্যস্ত চোখগুলো ভোরের এই আলো-আঁধারির লুকোচুরিতে মন্দ দেখে না। পথ চলতে কষ্ট হয় না। শুধু ওদের গ্রাম নয়। রাখাইনের অধিকাংশ গ্রামেই বিদ্যুৎ নেই। থানা শহরগুলোয় বিদ্যুতের লাইন আছে। কিন্তু রাত নয়টার পর বন্ধ করে দেয়া হয়। মিয়ানমারের সামরিক সরকার এই নিয়ম করেছে। ওরা দেশের নাম, রাজধানীর নাম এবং নূর আল ইসলামদের আরাকানের নামও বদলে ফেলেছে। মিয়ানমারের নাম ছিল বার্মা। রাজধানী নেপিদের নাম ছিল রেঙ্গুন ব্ াইয়াঙ্গুন। তাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয় আরাকানের নতুন নাম দিয়েছে রাখাইন রাজ্য। মিয়ানমারের জান্তা সরকার দেশটির জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীতও পরিবর্তন করেছে। দেশটির নাম বদল করা হয়েছে দুই বার প্রথমে ‘ইউনিয়ন অব মিয়ানমার’- এখন এই নাম এর স্থলে ‘দ্য রিপাবলিক অব দি ইউনিয়ন অব মিয়ানমার’ করা হয়েছে। ১৯৮৯ সালে দেশটির নাম বার্মা থেকে মিয়ানমারে পরিবর্তন করে জান্তা সরকার। মিয়ানমারে নতুন জাতীয় পতাকার ওপরে হালকা সবুজ, মাঝখানে গাঢ় সবুজ ও নিচে লাল রং। আর আনুভূমিক এই তিনটি ডোরার মাঝখানে আছে সাদা রঙের একটি তারকা। সামরিক সরকারের এইসব খামখেয়ালির কথা ভাবতে ভাবতে নূর আল ইসলাম মসজিদে ঢুকে। দু’রাকাত সুন্নত নামাজ শেষ করে। ফরজ নামাজের কাতারে দাঁড়ায়।
নামাজ শেষে ওরা মসজিদের বাইরে আসে। ভোরের রক্তিম আভায় পুব আকাশটা খুব সুন্দর লাগছে। নূর আল ইসলাম ভাবে এমন সুন্দর আকাশ কী পৃথিবীর অন্য কোথাও আছে। আকাশের রঙে ওর মনেও খুশীর রঙ লাগে। আরাকানের মহাকবি আলাওলের লেখা একটি গান তার মনে পড়ে যায়, সে মনের অজান্তে গেয়ে ওঠে-‘ প্রত্যুষে বেহানে / কমল দেখিয়া / পুষ্প তুলিবারে গেলাম । / বেলা উদনে / কমল মুদনে / ভোমরা দংশনে মৈলাম।’
: ‘মৈলে হবে না, দাদু। তোমাকে অনেক বড় হতে হবে। আরাকানের মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর করতে কাজ করতে হবে। এখন বাড়ি চলো। স্কুলের সময় হয়ে এলো।’ দাদুর কথা শোনে নূর আল ইসলামের কান লজ্জায় লাল হয়ে যায়। আলাওলের গানের অর্থ সে বুঝে না। সে মনে মনে ভাবে, সুন্দর সকালে ফুল তুলতে গিয়ে ভ্রমরের কামড়ে কবির মরণ দশা কেন হয়েছিল। এই গানের অর্থ কী ? কিন্তু লজ্জায় সে দাদুকে বলতে পারে না। দাদুর হাত ধরে বাড়ির পথে হাঁটতে থাকে।
পর্ব-৩
সুধা পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছোট ছোট দু’টি ঘর। ঘরগুলো কাঠ আর টিনের তৈরি। অফিস ঘরটার দরজা জানালা বেশ শক্ত মজবুত। ক্লাস রুমগুলো বলতে গেলে খোলা। সামনে এক চিলতে খেলার মাঠ। ক্লাস এখনো শুরু হয়নি। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা মাঠে ছুটোছুটি করছে। স্কুলে নূর আল ইসলামের বন্ধুর অভাব নেই। নিজের ক্লাসের বাইরেও বেশ কয়েকজন বন্ধু আছে। ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক সবাই ওকে ভালবাসে। কিন্তু আজ তার খেলায় মন নেই। পাইন গাছটার নীচে বসে একা একা ভাবছে, সুধা পাড়া গ্রামের অধিকাংশই মুসলমান। শুধু সুধা পাড়া না। মিউরকলু কাইনি পেরাং, কাইম পেরাং, সোলিং পেরাং, টংফরু, ডবে আফকচান, কেরী, কাজীপাড়া, কেওদা, রোহিঙ্গাপাড়া, রমজুপাড়া, আমবাড়ী, বাহারপাড়া, লখনৌপাড়া, টংটং মিরং, ফলুওয়ারী পালওয়ানপাড়া, মেয়কটং, মচ্ছারী আংপেরাং, রাজারবিল, রৌশন পেরাং, জোপেরাং, ছমিলা, রোহিঙ্গাডং, আলীখং মিন জং, ছুয়েক্রংডং, মরুছং, খোয়াংছং, লোয়াডং গ্রামসহ মংডু, বুচিডং, রাসিডং জেলার শতকরা ৮০ জন অধিবাসী মুসলমান। আরাকানের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এই অঞ্চলে মুসলমানের সংখ্যা বেশী। তবে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বৌদ্ধ,হিন্দু,খ্রিস্টান সব ধর্মের ছেলে-মেয়েরাই আছে।
স্কুলে নূর আল ইসলামের বন্ধুর অভাব নেই। বৌদ্ধ,হিন্দু খ্রিস্টান সবার সাথে তার সমানভাব। সে তার দাদুর কাছ থেকে শিখেছে, সব মানুষ হযরত আদম (আ,) ও হাওয়া (আ.) এর সন্তান। তাই কোন মানুষকে ঘৃণা করতে নেই। সব মানুষকে ভালবাসতে হবে। দাদু তাকে আরো বলেছেন, ‘আল্লাহর ইচ্ছায় তাদের জন্ম হয়েছে, মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে। এই রাজ্যের শান্তি, শৃঙ্খলা রক্ষা করে দেশ গড়ার জন্য কাজ করতে হবে। হিংসা-বিদ্বেষ, বিচ্ছিন্নতাবাদ ছড়ানোর মধ্যে কোন মঙ্গল নেই। এক সময় এই আরাকান মুসলমানরা শাসন করছেন। তখন রাজ্যে শান্তি ছিল। সব ধর্মের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতো।’ নূর আল ইসলাম ভাবে কিন্তু এখন সেই শান্তি কোথায় হারিয়ে গেছে। তাদের গ্রামের মসজিদে মাইকে আজান দেয়া যায় না। লুঙ্গির ওপর শার্ট না পরলে তাকে বাঙালি বলে শত্রু মনে করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার ভয় দেখায়। কেন দেশটা এমন হলো, এই প্রশ্নের উত্তর সে তার দাদার কাছে জানতে চেয়েছিল, তিনি পরে একদিন বলবেন বলেছেন।
: ‘আরে দোস্ত। তুই একা একা বসে কি করছিস?’ সিতাবের ডাকে নূর আল ইসলামের ভাবনায় ছেদ পড়ে।
:‘ না তেমন কিছু না।’
: ‘তাহলে আয় এখনই লাইনে দাঁড়াতে হবে।’ বলে সিতাব নূরকে টানতে থাকে। সে কোন প্রতিবাদ না করে, এক সাথে এসে লাইনে দাঁড়ায়। ত্রি-পিটক পাঠের জন্য সিতাবের ডাক পড়ে। সে সবার সামনে গিয়ে লাইনের দিকে মুখ করে ভক্তির সাথে পড়ে:‘ নম তাস্সা ভগওয়াত (অ) আরহাত (অ) সম্মাসম্বুদ্ধাস্সা। (৩ বার) ১. পাণাতিপাতা বেরমনী সিক্খাপদং সমাদিযামি। ২. অদিন্নাদানা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি। ৩. কামেসু মিচ্ছারানা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি। ৪. মুসাবাদা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি। ৫. সুরামেরেয মজ্জপমাদটঠনা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিযামি। বাংলা অনুবাদ : ১. প্রাণী হত্যা করা থেকে বিরত থাকার শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি। ২. অদত্ত বন্তু (যা দেওয়া হয়নি) গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি। ৩. মিথ্যা কামাচার থেকে বিরত থাকার শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি। ৪. মিথ্যাকথা বলা থেকে বিরত থাকার শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি। ৫. নেশাদ্রব্য সেবন করা থেকে বিরত থাকার শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।’
নূর আল ইসলাম তার চাচার কাছে শুনেছে,সেনাশাসনের আগে স্কুলে এ্যাস্বেলির সময় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা হিসেবে আরাকানে ত্রিপিটক পাঠ বাধ্যতামূলক ছিল না। কিন্তু এখন একদিনও বাদ দেয়ার উপায় নেই। কোন দিন বাদ দিলে, ফুঙ্গিরা (বৌদ্ধ ভিক্ষু) বর্মীসেনাদের নিয়ে এসে স্কুলের প্রধানশিক্ষক ও সভাপতিকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের ওপর নির্যাতন চালায়। প্রধানশিক্ষক ও সভাপতি যদি মুসলমান হন তাহলে তো কথাই নেই। দেশদ্রোহী বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি ইত্যাদি অপবাদ দিয়ে তাদেরকে গলা কেটে হত্যা করতে দ্বিধা করে না। সাধু পাড়া স্কুলের সভাপতি নূর আল ইসলামের দাদা কফিল উদ্দিন । ওর ছোট চাচা নঈম উদ্দিন একজন সহকারী শিক্ষক। গ্রামের সবাই ওদের পরিবারকে সম্মান করে শুধু ফুঙ্গিরাই আড়চোখে দেখে। ওদের পিছনে সব সময় গোয়েন্দাগিরি করে। কোন আত্মীয় স্বজন বাড়িতে এলে থানায় রিপোর্ট করতে হয়। ওর চাচাতো ভাই ও চাচাদের গ্রামের বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই। একান্ত প্রয়োজনে মংডু পর্যন্ত যেতে পারেন। তাও ফেরার পর কোথায় গিয়েছিলেন কার কার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে বিস্তারিত রিপোর্ট জমা দিতে হয়। মংডুর বাইরে যেতে হলে মিয়ানমার সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হয়। চিকিৎসা, শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে হলেও এর অন্যথা করলে রক্ষা নেই। সোজা জেল হয় তো নৌকায় তুলে সাগরে ভাসিয়ে দিবে। ধর্মরক্ষা আর জাতীয় নিরাপত্তার নামে ফুঙ্গি আর মিয়ানমার সরকার যা করছে, তার সাথে সিতাব পঠিত ত্রিপিটকের বাণীর কোন মিল নূর আল ইসলাম খোঁজে পায় না।
পর্ব-৪
সূর্য এখন ঠিক মাথার ওপর। মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ। আগের চেয়ে সূর্যেও তেজ অনেক বেড়েছে। স্কুল ঘরের টিনের চালের ওপর সূর্যের তাপের তীব্রতা একটু একটু করে বাড়ছে। মুসলমান এলাকা বলে বিদ্যুৎ নেই। সরকারের উন্নয়ন বাজেটও অন্য এলাকার চেয়ে কম। কিন্তু সূর্য তো তা বুঝে না। মুসলমানের বাইরে বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিস্টান কিংবা জড়বাদী যারা আছে গরমের তীব্রতায় তারাও কাহিল হয়। সিতাব ঘামতে ঘামতে নূর আল ইসলামের কাছে এসে বলে: ‘দোস্ত। ঘরে আর বসে যাচ্ছে না। এখন তো টিফিন চল গাছের নীচে গিয়ে একটু বসি।’
: ‘ টিফিন করবি না ? ’ নূর প্রশ্ন করে।
:‘ তোর বাক্সে কি আছে ?’ সিতাব জানতে চায়
: ‘সবজিপাড়কা, তোর ? ’
: রুটি আর ডিম সিদ্ধ।
: বেশ মজা হবে। চল।
দু’জন ছাতিম গাছের নীচে গিয়ে বসে। ওদের দেখে গালিব, শ্যাম, জন ও রনি, শোভা, সোমাও আসে। দুপুর বেলা স্কুল আঙ্গিনার গাছটার নীচে পিকনিক পিকনিক আমেজ শুরু হয় । সবাই মিলে একসাথে বসে টিফিন খাচ্ছে। মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ) ও মা হাওয়ার মাসুম সন্তানদের এই মিলনমেলায় পৃথিবীতে জান্নাতের সুখ নেমে আসে। স্বর্গীয় আবহ আরো মধুময় হয়ে উঠে আরাকানের বুকের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া লে¤্র মিঙ্গান, কালাডন, মায়ু ,নাফ আর সুধা ডিয়ার নদীর শীতল ছোঁয়াভরা বাতাসে। ছাতিম গাছের ডাকে একটা ঘুঘু ডাকছে। দূরের পাইনের মগডালে বসে কু-হু-কু-হু রব তুলেছে একটি কোকিল। শিশুদের কোলাহলের সাথে এক তাল আর লয়ে মিশে প্রকৃতিতে বইছে মধু মালতি রাগিনী। নূর আল ইসলাম খাওয়া শেষ করে একটা কবিতা আবৃত্তি শুরু করে। আরাকানের বিখ্যাত কবি সৈয়দ আলাওলের কবিতা
‘ তোমা হৈতে বান্ধব নাহিক কোনজন।
যাহারে দেখিলে দুঃখ হয় বিস্মরণ ॥
শিশুকালে তোমা সঙ্গে ছিল নানা সুখ।
একদিন কিঞ্চিৎ না পাইলে মনে দুখ ॥’
সিতাব খাওয়া শেষ করে হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে বলে: ‘বন্ধু, আমারও তোমাকে একদিন কিঞ্চিৎ দেখতে না পেলে মনে দুঃখ লাগে। চলো সময় শেষ, এবার ক্লাসে যেতে হবে।’ওরা সবাই মিলে হল্লা করে যার যর ক্লাসে ঢুকে।
পর্ব-৫
আজ শনিবার। নূর আল ইসলামের স্কুল ছুটি। আগামী দিন রোববারও স্কুল বন্ধ। মিয়ানমারে শনি ও রোববার দুই দিন সরকারি ছুটি। গতকাল বিকেলে নূর আল ইসলামের বাবা অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বাড়ি এসেছেন। তিনি দুই দিন পরিবারের সাথে সময় কাটাবেন। সোমবার গিয়ে ক্লাস করাবেন। তিনি খুব ভোরে ফজরের নামাজ পড়েই বাড়ি থেকে বের হন। সপ্তাহের এই দুইটি দিন নূর আল ইসলামের খুব মজায় কাটে। অধ্যাপক সাহেব অর্থাৎ ওর বাবা সারাক্ষণ তাকে কাছে কাছে রাখেন। বাপ-বেটা মিলে ধানের জমি,সবজি বাগান, চিংড়ির ঘের দেখতে যান। পুকুর থেকে বড় বড় মাছ ধরেন। নদীর পাড়ে মুক্ত বাতাসে হাঁটেন। হাঁটতে হাঁটতে অনেক গল্প করেন। মাঝে মাঝে বড় ভাই জায়েদ ও ছোট বোন জায়েদায়ও সাথে থাকে।
আজ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাবার সাথে মসজিদে গিয়ে ছিলো নূর। মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে কথা বলার পর থেকেই বাবার মনটা খুব খারাপ। মসজিদটির অবস্থা খুব জরাজীর্ণ। একটু বৃষ্টি হলেই পানি পড়ে। অজুর করার নলকূপটা নষ্ট। চারদিকের বেড়াও ভাঙা। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ইমাম সাহেবকে মসজিদটি সংস্কারের কথা বলছিলেন। ইমাম সাহেব তাকে জানান, তিনি অনেক বার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ফুঙ্গি নেতারা অনুমতি নিচ্ছে না। মসজিদ ঠিক করলে না কি এখানে বসে মুসলমানরা তাদের বিরুদ্ধে গোপন মিটিং করার সুযোগ পানে। বেড়া থাকলে তারা তা বুঝতেই পারবে না। তাই অনুমতি দেয়া যাবে না। তারা হুমকি দিয়েছে, বেশী বেড়া বেড়া করলে আগুন দিয়ে মসজিদ পুড়িয়ে দিবে। ওদের হুমকির কথা শোনে মনে ক্ষোভের আগুন জ্বললেও কিছু করার নেই। কারণ যেখানে ন্যায়বিচার নেই। রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে স্বৈরশাসক, সে দেশে কার কাছে নালিশ করবে। নালিশ করতে গেলে উগ্রপন্থী মুসলিম বলে তাকে উল্টো জেলে পুরে রাখবে, নয় তো হিং¯্র ফুঙ্গিদের হাতে ছেড়ে দিবে। ওরা মুখে জীবহত্যা মহাপাপ বললেও। মুসলমানদের জায়গা জমি দখল করতে দা দিয়ে কুপিয়ে তাদের হত্যা করতে দ্বীধা করে না। বর্মী সৈন্যরা মুসলমানদের রক্ষা করার বদলে সেখানে বাঙালি রোহিঙ্গা বলে নাসাকাদের হাতে তুলে দেয় নয় তো নিজেরাই গুলি করে হত্যা করে। তিনি ভাবেন, শুধু তাদের এই মসজিদ নয় আরাকানে এমন অসংখ্য ভাঙ্গাচোরা মাদ্রাসা,মসজিদ ও মক্তব আছে। সরকার ফুঙ্গিদের খুশী করতে এখানে মসজিদ, মাদ্রাসার সংস্কার করতে দিচ্ছে না। বরং সুযোগ পেলেই পুড়িয়ে নয় তো ভেঙ্গে দিচ্ছে।
মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরে অধ্যাপক রফিক পারিবারিক বৈঠকে বসেন। কিন্তু কোন সমাধান খোঁজে পান না। নূরের দাদা ফকিল উদ্দিন ছেলেদেরকে বলেন,‘ জানি না কোন পাপের কারণে আমাদের বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষের এই জন্মভূমিতে আমরা পরবাসী হয়ে যাচ্ছি।’
পর্ব-৬
আজ পূর্ণিমা। পূর্ণিমার রাতে ওদের খুব সর্তক থাকতে হয়। আশ-পাশের রাখাইন পাড়ায় মদের আসর বসে। এখানে চোলাই মদ পানির চেয়ে সস্তা। রাখাইন যুবকদের সাথে অনেক মুসলমান যুবকও যোগ দেয় ঐসব আসরে। নেশা করলে মানুষ তো আর মানুষ থাক না। মদের নেশায় বুদ হয়ে দল বেঁধে গিয়ে অনেক অপকর্ম করে। তবে অপকর্ম যেই করুক দোষটা পড়ে গিয়ে মুসলমান যুবকদের ঘাড়ে। কোন অঘটন ঘটলে তদন্তের আগেই বিচার শুরু হয়, অপরাধের মাত্রা অনুসারে শাস্তি পেতে হয়। এমন অনেক উদাহরণ আছে মুসলমান যুবকের মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়ার পর তদন্তে বের হয়ে এসেছে, মূল অপরাধী রাখাইন বৌদ্ধ। বলে রাখা ভাল মৃত্যুদ- কার্যকর করতে আইন আদালতে যাওয়ার আগেই উগ্রপন্থীরা কাজটা সেরে ফেলে। গুজব ছড়িয়ে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। যুবক যুবতীদেরকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। দিনের পর দিন চলতে থাকে এই সহিংসতা। এমন অঘটন থেকে বাঁচতেই গ্রামের মানুষ রাত জেগে পাহারা দেয়। নিজেদের সন্তানদের দিকে নজর রাখে।
কফিল উদ্দিন সাহেব মাদুর বিছিয়ে বসেছেন ছেলে আর নাতিদের নিয়ে। নূর আল ইসলাম এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভাবছে, আল্লাহর কত সুন্দর সৃষ্টি এই চাঁদ। কোন বৈষম্য না করে মুসলমান,হিন্দু, বৌদ্ধ,খ্রিস্টান সবাইকে আলো দিচ্ছে। কিন্তু মানুষ কেন ক্ষমতা হাতে পেলেই বৈষম্য করে। কেন তারা আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে দুষ্টের দমন শিষ্টের লালন করতে পারে না।
: ‘আকাশের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছো, দাদু ?’ কফিল উদ্দিনের ডাকে নূরের চিন্তায় ছেদ পড়ে।
: ‘চাঁদ কত সুন্দর!’ নূর বলে।
: ‘হ্যা চাঁদ খুব সুন্দর। তুমি ঠিক বলেছ । কিন্তু আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ, তা কি জান, দাদু।
: জানি, দাদু। এখন বলেন, আমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হওয়ার পরও কেন, এই রাখাইন রাজ্যে এত অবহেলিত?
: সে অনেক কথা, দাদু । তুমি জানতে চেয়েছিলে অন্য দেশের মতো এখানে কেন মাইকে আজান দেয়া হয় না ?
: ‘পরে বলবেন, বলে বলেছিলেন।’ নূর বলে।
:‘ তাহলে শোন।’ কফিল উদ্দিন শুরু করেন-
: আমাদের আরাকান এক সময় স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র ছিল। ইতিহাসের উত্থান-পতনে আজ আর আরাকান নামের আর কোন দেশ নেই। সেই সাথে সাথে বদল হয়ে গেছে আমাদের পরিচয়ও। আমাদের আসল পরিচয় আরাকানি মুসলমান। কিন্তু ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবেই এদেশের অনেক মুসলমানকে এখন রোহিঙ্গা বলা হচ্ছে। কারণ রোহিঙ্গা বলেই বলা যায় বহিরাগত,বাঙালি। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য হলো আরাকানের মুসলমানরাই আদিবাসী। আমাদের আশে-পাশে শক্তিশালী কোন মুসলিম দেশ না থাকায়, শুধু স্বাধীনতা নয় স্বায়ত্ব শাসনও হারিয়েছে আরাকানের মুসলমানরা। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে স্বাধীনতার কথা বলায় একদল মুসলমানকে ফুঙ্গিরা রোহিঙ্গা জঙ্গি আখ্যা দিচ্ছে।
: ‘এখন আমাদের করণীয় কি, দাদু।’ নূর জানতে চায়।
: ‘করণীয় ঠিক করতে হয়, সামর্থ্যকে বিবেচনায় নিয়ে।’ দাদু বলেন।
; ‘মানে।’ নূর পাল্টা প্রশ্ন করে।
:‘মানে, খুব সহজ্, মনে কর, তোমার আজ খুব পোলাও আর গরুর গোশত খেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু তোমার পকেটে যে টাকা আছে তা দিয়ে বড়জোর ডাল ভাত জুটবে। এমন অবস্থায় তোমার কি করা উচিত?’ দাদু জানতে চান।
: ‘রুটি ডাল খেয়ে, কিছু টাকা হাতে রাখা।’ এই তো বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেছো।’ হাসতে হাসতে নূরের কথার উত্তর দিয়ে দাদু বলেন;
: ‘তাহলে শোন। এখন আমাদের দায়িত্ব মিয়ানমার সরকারকে বুঝানো, আমরা এই মাটিরই সন্তান। এই দেশের নাম বদল করে তোমরা রাখাইন রেখেছো বলেই দেশটিতে আমরা পরবাসী হয়ে যায়নি। কোন জাতিকে নিঃচিহ্ন করার ষড়যন্ত্র মানবতাবিরোধিতা অপরাধ। আমাদের সকল মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। নাগরিক হিসেবে আমরাও দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখার সুযোগ চাই। আর এজন্য তোমাদেরকে লেখা-পড়া করতে হবে। সরকারের নীতিনির্র্ধারনী ফোরামে কথা বলার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। আন্তর্জাতিক জনমত তৈরির মতো ব্যক্তিত্ব অর্জন করতে হবে। তা না করে অস্ত্র হাতে তুলে নিলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হবে বেশী। তাদের কারণে নিরীহ মুসলমানদের ওপর নির্যাতন বাড়তেই থাকবে।’ কফিল উদ্দিন সাহেব থামার সাথে সাথে নূর প্রশ্ন করে’
: খুব সংক্ষেপে আমাকে একটু আরাকানের ইতিহাসটা বলবে, দাদু।
; কেন বলব না,শোন-ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায়, এই উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে ক’টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে উঠে, আরাকান তথা বর্তমান রাখাইন প্রদেশ তার অন্যতম। বর্তমান রোহিঙ্গারা সেই আরকানী মুসলমানদের বংশধর। এক সময় আরাকান স্বাধীন ছিল। ১৪৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন দুশ’ বছরেরও অধিককাল স্থায়ী ছিল। ১৬৩১ থেকে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত আরাকানে মারাত্মক দুর্ভিক্ষ হয়। এরপর মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। ১৬৬০ সালে আরাকান রাজা সান্দথুধম্মা নিজ রাজ্যে আশ্রিত মোগল শাহজাদা সুজাকে সপরিবারে হত্যা করে। এই সময় থেকেই মূলত: বিরতি দিয়ে দিয়ে চলছে মুসলমানদের উপর নিপীড়ন ও নির্যাতন। ১৭৮০ সালে বর্মী রাজা বোধাপোয়া আরাকান দখল করে নেয়। তিনিও ছিলেন ঘোর সাম্প্রদায়িক ও মুসলিমবিদ্বেষী। বর্মী রাজা ঢালাওভাবে মুসলমানদের শহীদ করে। ১৮২৮ সালে বার্মা ইংরেজদের দখলে গেলে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। তবে ১৯৩৭ সালে বার্মার স্বায়ত্তশাসন লাভের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক রূপ নেয় এবং অন্তত ৩০ লাখ মুসলমান শহীদ হয়। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু মুসলমানদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। স্বাধীন দেশের সরকার আজ পর্যন্ত তাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার দেয়নি। অত্যাচার নির্যাতন ও বিতাড়নের মুখে বহু রোহিঙ্গা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহুদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এরা বিশ্বের রাষ্ট্রহীন নাগরিক। ১৯৮২ সালে সরকার যে নাগরিকত্ব আইন করেছে, তাতে তিন ধরনের নাগরিকের কথা বলা হয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ছল-ছুতায় আরাকানের মুসলমানদেরকে রোহিঙ্গা বলে আখ্যায়িত করে ফুঙ্গিরা। কারণ তিন ধরনের নাগরিকের কোনটির মধ্যেই রোহিঙ্গারা নেই। সরকারিভাবে তাদের সে দেশে বসবাসকারী বা ‘জবংরফবহঃং’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের সাংবিধানিক ও আর্থ-সামাজিক অধিকার নেই। তারা এক অর্থে বন্দী। কারণ মিয়ানমারের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে তারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া যেতে পারে না। এক সময় যে আরাকান মুসলমান প্রধান ছিল, এখন সেখানে রাখাইন বসতি বাড়িয়ে তাদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয়েছে।
পর্ব-৭
এখন সকাল ১০টা বাজে। আজ রোববার। স্কুল বন্ধ। নূর আল ইসলাম তার বাবার সাথে গ্রামে ঘুরতে বের হবে। তার হঠাৎ মনে পড়লো, গত কয়েক দিন ধরে সিতাব স্কুলে আসছে না। অন্য বন্ধুদের কাছ থেকে খবর নিয়ে জেনেছে,সে অসুস্থ। নূর আল ইসলাম ওর বাবাকে বলল:‘ বাবা সিতাব অসুস্থ। ওকে একটু দেখতে যেতে চাই।
বাবা বললেন: বেশ। চল।
এই গ্রামের লোকেরা তান্ত্রিকতায় খুব বিশ্বাসী। এরা মুমূর্ষ অবস্থা না হলে ডাক্তারের কাছে যায় না। এরা ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজে বিশ্বাসী। সিতাবের বাবা মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদে সরকারি চাকরি করেন। ওদের দেশের কোথাও যেতে বাধা নেই। কারণ ওরা মুসলমান নয়। তিনি সাধারণত এক মাস পর পর বাড়ি আসেন। সিতাবের মা-ই সংসারের সবকিছু দেখ-ভাল করেন। ওর বাবা বলেছেন, সিতাব যখন কলেজে পড়বে ওরা সবাই নেপিদে চলে যাবে, ওখানকার বড় সরকারি কলেজে পড়বে। এ কথা ভাবতেই নূরের মনটা খারাপ হয়ে যায়। কারণ সিতাব ওর ভাল বন্ধু। নূরের ইচ্ছে হয় সেও ওর সাথে নেপিদের কোন ভাল কলেজে পড়ার, কিন্তু তার সাধ থাকলেও দেশের আইনের কারণে সম্ভব নয়। ওদের সীমানা খুব বেশী হলে আকিয়াব পর্যন্ত। কারণ ওরা মুসলমান। সরকার ওদের নাম দিয়েছে রোহিঙ্গা। ওদেরকে সব সময় সন্দেহের চোখে দেখা হয়। মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে ওদেরকে স্বীকারই করতে চায় না। অবশ্য পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে অন্যদের চেয়ে গ্রামে ওদের একটু আলাদা মর্যাদায় দেখা হয়।
সিতাবদের বাড়ি। সুন্দর ছিমছাম আধা পাকা ঘর। বাড়ির সামনে বাগান। বাগানের পাশে পুকুর। নূর ওর বাবাকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করার সাথে সাথে সিতাবের মা এগিয়ে আসেন।
তিনি বলেন, ‘আপনারা এসেছেন খুব ভাল হয়েছে। এখন কি করব, আমি বুঝতে পারছি না। ছেলেটার অসুখ দিন দিন বাড়ছে। ফুঙ্গিদের তন্ত্র-মন্ত্রে কোন কাজ হচ্ছে না। আসুন আসুন।’
নূর ওর বাবাকে সাথে নিয়ে সিতাদের ঘরে যায়। নূরকে দেখে শত কষ্টের মাঝেও সিতাব উঠে বসার চেষ্টা করে। নূরের বাবা বাধা দিয়ে বলেন:‘ তোমাকে উঠতে হবে না, বাবা। শুয়ে থাক।’ তিনি ওর কপালে হাত দিয়ে দেখেন, জ্বরে গা পোড়ে যাচ্ছে। সিতাবের মাকে জিজ্ঞেস করেন: দিদি, কত দিন ধরে ওর এই অবস্থা।’
তিনি বলেন:‘ তিন ধরে।’
: ডাক্তার দেখিয়েছেন?
: না। ফুঙ্গিদের দেয়া ওষুধ আর পড়া পানি খাওয়াচ্ছি।
: ওকে এখনই ডাক্তার দেখাতে হবে। নূর, বাবা এখনই নদীর ঘাটে গিয়ে তোমার চাচা আর ভাইয়াকে বল নৌকা ঠিক করতে আমরা সিতাবকে নিয়ে আসছি।’ নূরের বাবার কথা শেষ হওয়ার আগেই সে ভৌ দৌড় দেয়।
পর্ব-৮
নূর আল ইসলামের বাবা অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সিতাবকে কোলে নিয়ে সুধার ডিয়ার নদীর তীরে বাধা নৌকার দিকে আসছেন। তার পিছনে পিছনে আসছেন সিতাবের মা। বাইরের বাতাসে ঠা-া লাগলেও সিতাবের খুব ভাল লাগছে। নদীর তীর থেকে নদীর ঘাট খুব দূরে নয়। ১০/ ১২ মিনিটের মধ্যেই ওরা নৌকায় উঠে। নূর আগে থেকেই নৌকার পাটাতনের মাচালে মাদুর আর কাঁথা বিছিয়ে রেখেছিলো। অধ্যাপক সাহেব যতেœর সাথে সিতাবকে শুইয়ে দেন। সিতাবের পাশে বসে নূর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বন্ধুর হাতের স্পর্শে সিতাবের জ্বর কমতে থাকে। ওর খুব ভাল লাগে। মাঝি নৌকা বাইতে বাইতে গান ধরে:
‘ কর্নফুলী নদী পূর্বে আছে এক পূরী
রোসাঙ্গ নগরী নাম স্বর্গ অবতারী।।
তাহাতে মগধ বংশ ক্রমে যুদ্ধাচার
নাম শ্রী থুধম্মা রাজা ধন অবতার।।
প্রতাপে প্রভাত ভানু বিখ্যাত ভুবন
পুত্রের সমান করে প্রজার পালন।।
দেব গুরু পুজ এ ধর্মেতে তান মন
সে পদ দর্শনে হএ পাপের মোচন।।
পূণ্যফলে দেখে যদি রাজার চরণ
নারকীও স্বর্গ পাএ সাফল্য জীবন।।
…………………………………
মুখ্য পাত্র শ্রীযুক্ত আশরাফ খান
হানাফী মোজাহাব ধরে চিস্তিয়া খান্দান।।
……………………………………
শ্রীযুক্ত আশরাফ খান লস্কর উজীর
যাহার প্রতাপ বজ্রে চুর্ণ আর শির।।’
মাঝির গানের সুরে সুদূর অতীতে হারিয়ে যান অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। সেই কত শত বছর আগে আরাকানের বিখ্যাত কবি দৌলত কাজী এই কবিতা লিখে গেছেন। যা আজও লোকের মুখে মুখে কণ্ঠে কণ্ঠে গান হয়ে বাজছে। এটা সেই সময়ের কথা যখন আরাকান ছিল স্বাধীন রাজ্য। আরাকানের তৎকালীন অধিপতি থিরিথু ধম্মা বা শ্রী সুধর্মার লস্কর উজির বা সমর সচিব পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন আশরাফ খান লস্কর। সব ধর্মের মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করত। তিনি তার বাবার নিকট থেকে জেনেছেন, আশরাফ খান লস্কর ছিলেন তাদেরই পূর্বপুরুষ। আস্তে আস্তে মাঝির গান থেমে যায়। মাঝি হাঁক ছাড়ে: ‘ নাও ঘাটে ভিড়েছে। নামেন।’
সিতাবকে কোলে নিয়ে খুব সতর্কভাবে নামেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সাহেব। তার পিছে পিছে নামেন সিতাবের মা। নূর আল ইসলাম ওর চাচার হাত ধরে আস্তে আস্তে নামে। ডাক্তার খানার পথ বেশী দূরে নয়। তারপরও ওরা একটা পাইক্যা ( মিয়ানমারে রিকসার বিকল্প বাহন) নেয়। মংডুতে রিকশা নেই। শুধু মংডু নয়, সারা মিয়ানমারে রিকশার বদলে পাইক্যা চলে।
নূর আল ইসলাম সেই কবে মংডু এসেছিলো ওর মনে নেই। যা কিছু দেখছে সব ওর কাছে নতুন লাগছে। সে অবাক চোখে দেখছে। রাস্তার দু’পাশে ছোট ছোট ঝুপড়ি দোকান। অধিকাংশ দোকানেই বসে আসেন দোকানিরা। তাদের অধিকাংশই মহিলা। মংডুর পথে চলছে দলে দলে মানুষ বাড়ির সামনে, দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কেউ কেউ। যুবক, যুবতী, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ। ছেলেমেয়ে সবার পরনে লুঙ্গি। মেয়েরা লুঙ্গির সাথে পরেছে নানা রঙের বাহারি ব্লাউজ জাতীয় জামা বা গেঞ্জি। চুলে ফুল গোঁজা, চিরুনি ও রিবন-ফিতে। পাশ দিয়ে পাইক্যা চলে যাচ্ছে। নূরের কাছে মনে হচ্ছে সে যেন এক নতুন পৃথিবী দেখছে। অথচ তার প্রিয় গ্রাম সুধার পাড়া আর মংডুর মাঝে মাত্র একটি নদী- সুধার ডিয়ার। তাতেই তার মনে হচ্ছে যে সাত সাগর তের নদীর ওপারে এসেছে বন্ধু সিতাবকে দুষ্ট ডাইনির হাত থেকে বাঁচাতে।
ওদের বহনকারী পাইক্যা একটি ক্লিনিকের গেটে এসে থামলো। নূর বানান করে পড়ে নিরাময়। ক্লিনিকটির নাম নিরাময়। দু’জন বেয়াড়ার একটি ট্রলি নিয়ে দৌড়ে এলো। তাদের আচরণে মনে হলো ওরা অধ্যাপক সাহেবকে চিনেন। তাদের একজন সালাম দিয়ে বলল:‘ স্যার কেমন আছেন?’ অধ্যাপক সাহেব সালামের উত্তর দেয়ার পর বাকী কথা শোনার সময় ওদের হাতে নেই। তাড়াতাড়ি সিতাবকে ট্রলিতে তুলে জরুরি বিভাগের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। তাদের পিছে পিছে চলেন অধ্যাপক সাহেব, সিতাবের মা, নূর আল ইসলাম ও ওর চাচা।
অধ্যাপক সাহেবকে দেখে হাসি মুখে একজন ডাক্তার এগিয়ে এসে বললেন:‘ রফিক সাহেব, আপনি, কাকে নিয়ে এসেছেন?’
:‘ আমার ছেলের বন্ধু।’ অধ্যাপক সাহেব বললেন।
ডাক্তার সাহেব সিতাবকে ভাল করে পরীক্ষা করে বললেন: ‘ হাসপাতালে নিয়ে এসে খুব, ভাল করেছেন। দ্রুত চিকিৎসা দরকার। দেরি করলে নিউমনিয়ার আশংকা আছে। এখনই ওকে ভর্তি করে নিচ্ছি। দু’দিন আমাদের তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে ওকে।’
ভর্তির আনুষ্ঠানিকতা সেরে রফিক সাহেব সিতাবের বাবা সিংমংকে ফোন করলেন, ছেলের অবস্থা জানাতে। সিতাবের বাবা তার মায়ের সাথেও কথা বললেন। তিনি তাকে জানালেন, আজই ছুটি নিয়ে মংডুর দিকে রওনা করবেন।
পর্ব-৯
আজ ঘোর অমবশ্যা। চার দিক অন্ধকার। কোথাও কোন আলো নেই। বাবার কোলে মাথা রেখে সিতাব শুয়ে শুয়ে গল্প করছে। সে এখন সুস্থ। আগামীকাল ভোরে সিতাবের বাবা নেপিদ চলে যাবেন। তাই সিতাবের মন খারাপ। তার বাবা তাকে বুঝাচ্ছেন, স্কুল সমাপনী পরীক্ষার পরই তিনি সিতাব ও ওর মাকে নেপিদ নিয়ে যাবেন। সিতাব ওর বাবার কাছে জানতে চায়:‘ নূর আল ইসলামের বাবাকে নেপিদের কোন কলেজে চাকরি দেয়া যায় না?’
: ‘কেন, বাবা, হঠাৎ এ প্রশ্ন করছো কেন?’ সিতাবের বাবা ছেলেকে পাল্টা প্রশ্ন করেন।
: তাহলে আমরা দু’জন একই কলেজে পড়তে পারবো।
: ‘সে তখন দেখা যাবে।’ বলে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়েন সিতাবের বাবা। কারণ তিনি জানেন, সেটা হয় তো কোন দিন সম্ভব হবে না। কারণ দিন দিন পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরো খারাপ হচ্ছে। ওদের পক্ষে কথা বললে তাদেরও ওপর নেমে আসছে ফু্িঙ্গদের অকথ্য নির্যাতন। সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী এমন কি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও তারা পাত্তা দেয় না।
হঠাৎ গুলির শব্দ আর হৈচৈ শোনে চমকে ওঠে সিতাব ও ওর বাবা। ভাল করে খেয়াল করে সিতাব বলে: “বাবা, নূরদের বাড়ির দিক থেকে শব্দ আসছে না।’
;‘ তাই তো মনে হচ্ছে।’
: ‘চলো ওদের নিয়ে আসি।’
: ‘এখন বের হওয়া ঠিক হবে না, গোলাগুলি বন্ধ হোক। তারপরও বের হতে হবে।’
সিতাব চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। কিছু ক্ষণ পর গুলির শব্দ কমে আসে। সিতাবের বাবা হারিকেন নিয়ে বের হন। কিন্তু বেশী যাওয়ার সাহস পান না। পুরো মুসলিম পাড়া ফুঙ্গিরা ঘিরে রেখেছে। দলে দলে লোকদের বের কওে লাইনে দাঁড় করিয়ে চেক করছে। হারিকেনের আবছা আলোয় তিনি দেখতে পান কে যেন এদিকে আসছে। তিনি ভাল করে খেয়াল করে দেখেন। একজন মহিলা আর দুটি শিশু সন্তান তাদের বাড়ির দিকেই আসছে। তিনি সাহস করে এগিয়ে যান। হ্যা তার ধারণা মিথ্যে নয়। নূর আল ইসলামের মা, নূর আল ইসলাম আর ওর ছোট বোন জায়েদা। তিনি এগিয়ে গিয়ে তাদের নিয়ে আসেন। নূরের মা তাকে জানান ফুঙ্গিরা নূরের বাবা, দাদা, চাচা আর নূরের বড় ভাই জায়েদ ধরে নিয়ে গেছে। তিনি দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে কোন মতে পালিয়ে এসেছেন। যাদের ওরা ধরে নিয়ে গেছে তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে, আল্লাহ ছাড়া কেউ বলতে পারবে না।
পর্ব-১০
মুসলিম পাড়ায় এখনো আগুন জ্বলছে। পোড়া গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। সিতাবের বাবা নূরের বাবা, দাদা আর চাচাদের খোঁজ খবর করতে গিয়ে জানতে পারলেন। সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে তাদের সবাইকে ধরে গিয়ে গেছে। কোথায় রেখেছে তা কেউ বলতে পারছে না। এদেশে এখন এর চেয়ে বেশী কিছু জানতে চাওয়া মানে নিজের বিপদ নিজে ডেকে না। কারণ মিয়ানমারের মুসলিম নাগরিকদেরকে ফুঙ্গিদের প্ররোচণায় সরকার রোহিঙ্গা, বাঙালি. বেজাতি প্রভৃতি নামে আখ্যায়িত করে হেন অত্যাচার নেই করছে না। হত্যা,গুম খুন, সাগরে ভাসিয়ে দেয়া, বাংলাদেশ সীমান্তে পুন-ইন করা এখন মিয়ানমারের নিত্য দিনের ঘটনা। সিতাবের বাবা সিংমং বুকের অব্যক্ত ব্যথা বুকে লুকিয়ে রেখে ফিরে এলেন।
তিনি ফিরে এলে নূরের মা বললেন: ‘ওদের কোন খোঁজ পেলেন?’
: না, ভাবী কেউ কিছু বলতে পারছে না।
: তাহলে কি আর করব? আমরা বাড়ি চলে যাই।
: পরিবেশ খুব খারাপ। এই মুর্হূতে বাড়ি যাওয়া যাবে না।
: তাহলে এখানে থাকাও তো নিরাপদ নয়, আপনাদেরও বিপদ হতে পারে।
: কি করতে চান?
: আমাদেরকে বাংলাদেশে হয় তো মালেশিয়ায় পাঠিয়ে দিন। পরিবেশ স্বাভাবিক হলে আবার ফিরে আসবো। আমাদের ঘর-বাড়ি আর স্বজনের খোঁজ খবরের দায়িত্ব ভাই, আপনাকে দিয়ে গেলাম।
: বাংলাদেশে কোথায় যাবেন, কে আছে আপনার?
: মুসলমান দেশ, তারা আমাদের বিপদে সাহায্য করবেই, অনেকেই তো সে দেশে আশ্রয় নিয়েছে। কাউকে না কাউকে তো অবশ্যই পাবো। আল্লাহর এই বিশাল দুনিয়ায় একটা ব্যবস্থা হবেই। নিজের জীবনের চিন্তা করি না, ভাই। ছেলে আর মেয়েটাকে তো বাঁচাতে হবে।
: আমাদের সাথে থাকেন.
: ‘কোন পরিচয়ে থাকব ভাই? আমরা তো আর অচেনা কেউ নই। আমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন, জানলে আপনাদেরও বিপদ হবে। আর অনুরোধ কইরেন না ভাই। তারচেয়ে পারলে সীমান্ত পার হওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।’
সিতাবের বাবা আর কথা বাড়ায় না। তিনি সরকারি চাকরিজীবী। তার যেমন সুবিধা আছে অসুবিধাও বেশী। ফুঙ্গিরা অন্ধ। ওরা কোন কিছু মানতে চায় না। তাই তিনি আর কথা না বাড়িয়ে বের হয়ে পড়েন সীমান্ত পারাপার করে এমন দালালের খোঁজে।
পর্ব-১১
কক্সবাজারের নয়াপাড়ার রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির। এখন মধ্যরাত। খোলা আকাশের নীচে মাদুর পেতে শুয়ে আছে নূর আল ইসলাম। ওর খুব বাবার কথা মনে পড়ছে। ভাই জায়েদ. চাচা. দাদা ওরা কেমন আছে খুব জানতে ইচ্ছে করছে। বাবার কোন খবর এত দিনেও কেউ দিতে পারেনি। ভাই জায়েদের মতো একজনের গলাকাটা লাশ নাফ নদীতে দেখা গেছেএমন খবর ওরা শুনেছে। চাচা,চাচী, চাচাতো ভাইরা কোথায় আছে ওরা জানে না। বৃদ্ধ দাদা মসজিদের মাটি আকড়ে পড়ে আছেন। জমি-জমার অধিকাংশই ফুঙ্গিরা দখলে নিয়েছে। বাড়ি ভিটে অনেক কষ্ট করে সিতাবের বাবা ধরে রেখেছেন, এই আশায় পরিবেশ স্বাভাবিক হলে নূররা ফিরে আসলে ফেরত দিবেন। দাদাকে অনেকে পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশে আসতে, তিনি রাজি হননি। তার এক কথা নিজের জন্মভূমি ছেড়ে তিনি কোথাও যাবেন না। মরতে হলে এই মাটিতেই মরবেন। নূরের খুব ইচ্ছে করে দাদার হাত ধরে ওদের ছোট মসজিদটায় নামাজে যেতে। বাবার কোলে বসে গল্প করতে। ওর প্রিয় স্কুল স্কুলের বন্ধুদের কথা খুব মনে পড়ে। সিতাবকে সে কিছুতেই ভুল পারে না।
নূর আকাশের দিকে তাকায়। এক টুকরা সাদা মেঘ ভেসে যাচ্ছে। পাশে পূর্ণিমার চাঁদ। সে ভুলে যায় বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরে একা একা শুয়ে আছে। সে মনের অজান্তেই হারিয়ে গেছে আরাকানের সুধার পাড়া গ্রামে। তার মনে হয়, বাবার কোলে মাথা রেখে দাদার গল্প শুনছে- ‘এই আরাকান একদিন স্বাধীন ছিল। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জড়বাদী সব বিশ্বাসের মানুষ সুখে-শান্তি বসবাস করত..্’
: ‘ভাইয়া।’ জায়েদার ডাকে চমকে উঠে নূর আল ইসলাম। সে বাস্তবে ফিরে আসে। তার সুখের স্বপ্ন ভেঙে যায়। বোনের হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়। তারপর বলে: ‘ জায়েদা। এই চাঁদটা আমাদের সুধার পাড়ার চাঁদের মতোই তাই না?’
:‘ আকাশটাও।’ তাই না ভাইয়া।
: হ্যাঁ। মাটিটাও যদি এমন হতো। তাহলে বাবা,দাদা, চাচা, ভাইয়াদের, দেখতে পেতাম। সিতাব, শ্যাম, আলওলদের সাথে খেলাধুলা করার সুযোগ পেতাম। আকাশে চাঁদ তারাগুলো কেমন এক সাথে মিলে-মিশে আলো ছড়াচ্ছে। ছোট বড় কোন ভেদ-ভেদ নেই। মাটির মানুষরা এমন হলে, কতই না ভাল হতো, তাই না জায়েদা।’
: ঐ যে দেখ একটা তারা কেমন জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। মনে হয় আমাদেরকে দেখছে।
বোনের কথায় শত কষ্টের মাঝেও নূর আল ইসলাম হাসতে হাসতে হাসতে বোনের হাত ধরে তাবুর দিকে পা বাড়ায়। জায়েদা বলে: ‘ভাইয়া মানুষ মরলে লাগি তাদের রাজ্যে চলে যায়? আমরা কি তারাদের রাজ্যে যাওয়ার আগে কোন দিন আরাকানে ফিরে যেতে পারবো না। বাবা, দাদা, ভাইয়া , চাচা-চাচীদের দেখতে পাব না।’
জায়েদার কথায় বাকরুদ্ধ হয়ে যায় নূর আল ইসলাম। সে অপলক চোখে বোনের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। # লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিক। ই মেইল: harunibnshahadat@gmail.com