পর্যটন নগরী মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের মাছের অভয়াশ্রম বাইক্কা বিল এখন বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কিচির-মিচির শব্দে মুখরিত। প্রতি বছরের মতো এবারও বাইক্কা বিলে এসেছে পরিযায়ী পাখিসহ ঝাঁকে ঝাঁকে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অতিথি পাখির কলরবে মুখর থাকে এই বিল। এবার বিলে আসা উল্লেখযোগ্য পাখির মধ্যে রয়েছে বিশ্বের দ্রুততম পাখি পেরিগ্রিন ফ্যালকন, সাদা বক, খয়রা কাস্তেচড়া, বেগুনিকালেম, পাতিসরালি, পানকৌড়ি, ঈগল, ধূসর বক, তিলা লালপা, ছোট ডুবুরি, রাজ সরালি, সরালি, বালিহাঁস, পাতি তিলি হাঁস, মরচে রং ভুতি হাঁস, গিরিয়া হাঁস, পিয়ং হাঁস, গয়ার বা সাপপাখি, পাতিকুট, পাতি পানমুরগি, কানিবক, ডাহুক, বিল বাটান, গেওয়ালা বাটান, কালাপাখ ঠেঙি, লাল লতিকা টিটি, মেটেমাথা-টিটি। সঙ্গে রয়েছে দেশি পাখিও। পাখিদের কিচির-মিচির ডাক, ছুটাছুটি, পানিতে ভেসে বেড়ানো, দল বেঁধে ডাঙায় বসে থাকা, আবার একসঙ্গে ডানা মেলে উড়ে যাওয়ার এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক ও পাখি-পিপাসুরা ছুটে আসছেন পাখির রাজ্য হাইল হাওরের বাইক্কা বিলে। বাইক্কা বিলে বেড়াতে আসা পর্যটক সিলেট বাইকিং কমিউনিটির সদস্য রামিম জামান জানান-শীত মৌসুমে বাইক্কা বিল দেখতে অপরূপ লাগে। অতিথি পাখিদের আগমনে বাইক্কা বিল অপরূপ সৌন্দর্যে সেজেছে। তাই আমরা বাইকাররা প্রতি শীত মৌসুমে বাইক্কা বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসি। বাইক্কা বিলে ঘুরতে আসা পর্যটক সায়মা, রাহিদ, তামি, তানজিয়া বলেন, বাইক্কা বিলের পরিবেশটা খুবই মনোরম। এখানে প্রচুর অতিথি পাখি দেখা যায়। কিছুটা সময় প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকার জন্য বাইক্কা বিলে আমাদের আসা। সত্যিই এখানে এলে যে কারও ভালো লাগবে। পাখির কলকাকলীতে বিলের চারপাশ মুখরিত। পাখির কিচিরমিচির শব্দ আর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির ওড়াওড়ি দেখে খুবই ভালো লেগেছে।
হাওরের নীল জলে পাখিদের জলকেলি আর নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে পর্যটকদের জন্য এখানে তৈরি করা হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। এ টাওয়ার থেকে শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে বিলের পাখি কাছ থেকে দেখার সুব্যবস্থা রয়েছে। বাইক্কা বিলের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের উপরে বসে সূর্যাস্ত দেখা যায়। সূর্যটা আস্তে আস্তে টুপ করে পানির মধ্যে ডুবে যায়। সরজমিনে দেখা যায়, অনেক পর্যটক ওয়াচ টাওয়ারে বসে বাইনোকুলার ও টেলিস্কোপ দিয়ে খুব সহজেই হাইল হাওরের প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন করছেন। কেউ কেউ নৌকায় চড়ে ঘুরেও বেড়াচ্ছেন হাওরে। পাখির নাম-পরিচয় জানতে বিলে একটি ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার রয়েছে। এই সেন্টারে রয়েছে তথ্য কেন্দ্র অ্যাকুরিয়াম ও ডিসপ্লে বোর্ড। গত দুই বছরের তুলনায় চলতি শীত মৌসুম-২০২৫-এ পাখির আগমন বৃদ্ধি পেয়েছে। এবছর বাইক্কা বিলে ৩৮ প্রজাতির ৭৮৭০টি জলচর পাখি এসেছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ৭৫০টি মেটেমাথা টিটি, ৬৩৯টি কাস্তেচরা, ১০০টি রঙিলা কাস্তেচরা এবং কালামাথা কাস্তেচরা। ২০২৪ সালে ৩৩ প্রজাতির ৪৬১৫ জলচর পাখি এবং ২০২৩ সালে এসেছিল ৪০ প্রজাতির ৬১৪১ পাখির আগমন হয়েছে। শনিবার (১৯ জানুয়ারি) এশিয়ান ওয়াটার বার্ড সেনসাসের অধীনে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের পরিচালনায় বাইক্কা বিলে টেলিস্কোপ দিয়ে পাখি গণনা করা হয়। জানা যায়, ২০০৩ সালে সরকার বাইক্কা বিলকে মৎস্য অভয়াশ্রম হিসেবে সংরক্ষণ করে। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, পশু ও মৎস্য সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্ট স্টাডিজ (সিএনআরএস)-এর যৌথ ব্যবস্থাপনায় হাইল হাওরের বাইক্কা বিল পরিচালিত হচ্ছে। বাইক্কা বিল রক্ষণাবেক্ষণ দায়িত্বে থাকা স্থানীয় বড়গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মিন্নত আলী জানান, পুরো হাইল হাওরেরই পাখি থাকে। তবে বাইক্কা বিলে মাছ আহরণ নিষিদ্ধ থাকায় এখানে পাখির সংখ্যা বেশি থাকে। তিনি বলেন, বাইক্কা বিলের জন্য পাঁচজন পাহারাদার আছে, পালাক্রমে এটি দেখাশোনা করেন তারা। তবে বিশাল এলাকা তাদের পক্ষে সামাল দেওয়া কষ্টকর হয়। বাইক্কা বিল পরিচালনা ও বিলে অবাধে লোক সমাগম বন্ধ করতে এখানে পুণঃপ্রবেশ ফি চালু কর জরুরি। তিনি আরও বলেন, টিকেটিং সিস্টেম চালু করলে এখান থেকে সরকারও রাজস্ব পাবেন এবং এর একটা অংশ দিয়ে লোকবল বাড়ানো যাবে। পাশাপাশি উন্নয়ন কাজও করা যাবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো দর্শনার্থী নিয়ন্ত্রিত হলে পাখিদের জন্যও নিরাপদ স্থান হিসেবে থাকবে এটি। পাখি গণনায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের অপর সদস্য সামিউল মহসিন জানান, এই বছর পাখি গণনায় উল্লেখযোগ্য ৭৫০ মেটে মাথা টিটি ( গ্র হেডেড ল্যাপউইং) এবং সর্বোচ্চ সংখ্যক কাস্তেচরা- ৬৩৯ এবং ১০০ কালা মাথা কাস্তেচরা (ব্ল্যাক-হেডেড আইবিস) দেখা গেছে। কালা মাথা কাস্তেচরা (ব্ল্যাক-হেডেড আইবিস) কালা মাথা কাস্তেচরা (ব্ল্যাক-হেডেড আইবিস)। বাইক্কা বিলের মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা সিএনআরএস’র সাইট অফিসার মনিরুজ্জামান বলেন, পাখি গণনাকারিরা তাদের জানিয়েছেন একটি মাত্র পেরিগ্রিন ফ্যালকনের দেখা মিলেছে। পাখিটি উড়ে এসে একটি ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। পেরিগ্রিন ফ্যালকন একটি বিরল প্রজাতির পাখি। পাখিটি ঘণ্টায় ৩৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিতে উড়তে পারে। এমন দ্রুতগতির কারণে একে রকেট বার্ডও বলা হয়। তবে এই পাখি মাছের সঙ্গে অন্য পাখি ধরেও খেয়ে থাকে। বিশেষ করে হাঁস জাতীয় পাখি তাদের প্রিয়। আর বাইক্কা বিলে হাঁস জাতীয় প্রচুর পাখি রয়েছে। গতকাল ২০ জানুয়ারি) গণমাধ্যমকর্মীদের পাখি গণনার তথ্যটি নিশ্চিত করে পাখি বিশেষজ্ঞ ড. পল থম্পসন বলেন, গত শনিবার বাইক্কা বিলে জলজ পাখি শুমারি ২০২৫ শেষ হয়েছে। এ শুমারিতে প্রথমবারের বাইক্কা বিলে দেখা মিলেছে পৃথিবীর দ্রুততম পাখি পেরিগ্রিন ফ্যালকনের। যাকে অনেকে ‘রকেট বার্ড’ও বলেন। এছাড়া চলতি বছরে ৩৮ প্রজাতির ৭৮৭০টি জলচর পাখি বিলে এসেছে।