গতকালের পর
মহান আল্লাহর এ কথা বলার তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, মানুষ অনেক সময় নিজ সন্তান ও আপনজনদের ভালোবাসায় আচ্ছন্ন হয়ে তাদের রাষ্ট্রীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ কর্তৃত্ব দিয়ে বসে। অযোগ্যকে ক্ষমতার অধিকারী বানিয়ে দেয়। এটা অবশ্যই আল্লাহর আমানতে খেয়ানত ছাড়া কিছু নয়। এমনিভাবে সম্পদের প্রাচুর্য ও অর্থের পাহাড় গড়ে তোলার ব্যাপারে তার আগ্রহের শেষ থাকে না। তার এই সম্পদপ্রীতি তাকে অযোগ্য ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিতে এবং অন্যায়ে প্রবৃত্ত হতে বাধ্য করে। সে অন্যায়, অবৈধ পন্থায় সম্পদ লাভ করতে গিয়ে জনগণকে শোষণ করে। কোনো কোনো এলাকার আঞ্চলিক শাসক বা বড় সরকারি কর্মকর্তা এমন চরিত্রের হয়ে থাকে যে, সে ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিকে তোষণে পারদর্শী। ফলে তোষামোদি লোকদের অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও আপন লোকদের দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করে বসে। এহেন ব্যক্তি নিঃসন্দেহে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সা: সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও আমানতের খেয়ানত করে। দায়িত্বপূর্ণ সরকারি ব্যক্তি যদি আল্লাহকে ভয় করে লোভ সংবরণ করতে পারে এবং নিজ ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে বিরত থাকতে সক্ষম হয়, তাহলে আল্লাহ তাকে ন্যায়নীতির ওপর অটল থাকতে সাহায্য করেন। তাকে সব প্রতিকূলতা থেকে হেফাজত করেন। যে শাসক নিজ প্রবৃত্তির দাস, আল্লাহ তাকে শাস্তি দেন। তার উদ্দেশ্য ও আশা আকাক্সক্ষার স্বপ্নসৌধকে ভেঙে চুরমার করে দেন। তার সন্তান-সন্ততি ও পরিবার-পরিজনকেও অসম্মানজনক অবস্থায় রাখেন। সে হারায় তার অবৈধ পন্থায় অর্জিত সম্পদসমূহ। (এ সম্পর্কে একটি বিখ্যাত ঘটনা আছে যে, আব্বাসী শাসকদের একজন একবার আলিমদের ডেকে বললেন, আপনারা নিজেদের দেখা কিংবা শোনা কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ করুন। আমি দেখেছি একবার ওমর ইবনে আবদুল আযীয রা:কে জনৈক ব্যক্তি এসে বলল, ‘আমিরুল মু’মিনিন! আপনি আপনার সন্তানদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ থেকে দূরে রেখেছেন। তাদের ফকির ও অসহায় অবস্থায় রেখে যাওয়ার পথ করেছেন। তাদের জন্য আপনি কিছুই রেখে যাচ্ছেন না।’ ওমর ইবনে আবদুল আযীয রা: তখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত। তিনি বললেন, ঠিক আছে, সন্তানদের আমার সামনে হাজির করো। তাদের সবাইকে সামনে হাজির করা হলো। খলিফার সন্তান সংখ্যা ছিল দশের ঊর্ধ্বে। তাদের সবাই ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক। সন্তানদের দেখে তিনি কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, বৎসগণ! তোমাদের যা হক ছিল তা আমি তোমাদের পুরোপুরি দিয়ে দিয়েছি- কাউকে বঞ্চিত করিনি। এ ছাড়া জনসাধারণের কোনো সম্পদ আমি তোমাদের দিতে পারব না। তোমাদের প্রত্যেকের অবস্থা তো এই যে, হয় তোমরা সৎ সাধু ব্যক্তি হবে। আর আল্লাহ তাঁর সৎকর্মশীল বান্দাদের অভিভাবক ও সাহায্যকারী, নয় তোমরা অসৎ ও অসাধু হবে। আমি অসৎ ও অসাধু ব্যক্তিদের জন্য কিছুই রেখে যেতে চাই না। কারণ ওই অবস্থায় তারা আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হবে। যাও, সবাই এবার আমার কাছ থেকে যেতে পারো, এটুকুই আমার কথা।’
এরপর তিনি (সেই আব্বাসী খলিফা) বলেন, মহাপ্রাণ ওমর ইবনে আবদুল আযীযের সেই সন্তানদেরই আমি পরবর্তীকালে দেখেছি, তাদের কেউ কেউ শত শত ঘোড়ার অধিকারী ছিলেন, সেগুলো আল্লাহর রাস্তায় দান করেছেন। ইসলামের মুজাহিদরা সেগুলোর ওপর সওয়ার হয়ে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় জিহাদ করতেন।
এরপর সেই আব্বাসী খলিফা বললেন, ওমর ইবনে আবদুল আযীয রা: ছিলেন প্রকৃতই ‘খলিফাতুল মুসলিমিন’।
পূর্বে তুর্কিদের দেশ এবং পশ্চিমে মরক্কো ও স্পেন তাঁর শাসনাধীন, সাইপ্রাস দ্বীপ, সিরীয় সীমান্তবর্তী এলাকা, তরসূস ইত্যাদিতে তাঁর শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল। দক্ষিণে ইয়ামেনের শেষ সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটেছিল তাঁর শাসনের। এতদসত্ত্বেও তাঁর সন্তানরা পৈতৃক উত্তরাধিকার থেকে অতি সামান্য কিছুরই মালিক হয়েছিলেন। নবী জীবনের আদর্শ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব, নেতৃত্ব ও শাসন ক্ষমতাও একটি আমানত এবং এই আমানত যথাযথভাবে রক্ষা করা ‘ওয়াজিব’।
আল্লাহ নেক বান্দাদের সাহায্য করেন, যেমন ‘ওমর ইবনে আবদুল আযীয’ রা:-এর সন্তানদের করেছিলেন, উত্তরাধিকার সূত্রে তারা তেমন কিছু পায়নি। কিন্তু আল্লাহ তাদের এমন সাহায্যই করেছিলেন যে, প্রত্যেকেই বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : ‘আমার অভিভাবক তো আল্লাহ, যিনি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন এবং তিনিই সৎকর্মপরায়ণদের অভিভাবকত্ব করে থাকেন। (৭: ১৯৬)
ইমাম বুখারি রহ: কর্তৃক সহিহ বুখারিতে হজরত আবু হুরায়রা রা:-এর একটি রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে যে, মহানবী সা: ইরশাদ করেছেন, ‘আমানত নষ্ট (তথা খেয়ানত) হতে থাকলে তোমরা কিয়ামতের প্রতীক্ষায় থেকো।’ বলা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! ‘আমানত নষ্ট’ বলতে কি বুঝায়? হজরত রাসূল সা: বললেন, যখন শাসনক্ষমতা ও নেতৃত্ব কর্তৃত্বের আসনে অযোগ্য ব্যক্তিদের আগমন ঘটে, তখন তোমরা কিয়ামতের প্রতীক্ষায় থেকো। (বুখারি) বলা হয়েছে যে, ইয়াতিমের অভিভাবক বা অসি, ওয়াকফ সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক তারা আমানতদার। আমানতের এই অর্থের প্রেক্ষিতেই এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ‘ইজমা’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, কোনো দায়িত্বে নিয়োজিত ইনচার্জ বা প্রতিনিধির যদি সংশ্লিষ্ট মালিকের সম্পদ থেকে ব্যয় করার প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন উত্তম পদ্ধতিতে তা ব্যয় করবে (অর্থাৎ স্বীকৃত পরিমাণের বেশি ব্যয় করবে না এবং কোনোরূপ আত্মসাৎ করবে না)। যেমন আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘ইয়াতিম বয়োঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সদুদ্দেশ্য ছাড়া তার সম্পত্তির নিকটবর্তী হয়ো না।’ শাসক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা হচ্ছেন বকরির রাখালের ন্যায় জনগণের রক্ষক বা তত্ত্বাবধায়ক। যেমন, মহানবী সা: ইরশাদ করেছেন : ‘তোমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের রক্ষক। প্রত্যেককে তার অধীনস্থদের কার্যকলাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের যিনি নেতা, তাকে তার অধীনস্থ জনগণের কার্যাবলি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীগৃহের রক্ষক। ওই ঘরে যা তার কর্তৃত্বাধীন সে ব্যাপারে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। সন্তান তার পিতৃ সম্পদের রক্ষক, সে সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। দাস বা ভৃত্য তার মনিবের মাল-সম্পদের রক্ষক। তাকে সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে। সাবধান! মনে রেখো, তোমাদের প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জন্য রক্ষক। সবাইকে নিজ নিজ অধীনস্থদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে।’
মহানবী সা: ইরশাদ করেছেন যে, ‘আল্লাহ যাদেরকে অপরের উপর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব দিয়েছেন, সে যদি তার দায়িত্ব পালনে উদাসীন থেকে মারা যায়, আল্লাহ তার জন্য বেহেশতের গন্ধও হারাম করে দেবেন।’ (মুসলিম)
একবার আবু মুসলিম খাওলানী রহ: হজরত মুয়াবিয়া রা: ইবনে আবু সুফিয়ানের কাছে উপস্থিত হয়ে তাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে মজুর! তোমার প্রতি সালাম। দরবারের সভাসদগণ বললেন- ‘আইউহাল আজীর’ না বলে ‘আইউহাল আমির’ বলুন। কিন্তু আবু মুসলিম খাওলানী একই বাক্যের তিনবার পুনরাবৃত্তি করেন। উপস্থিত লোকজন বারবার তাঁকে ‘আইউহাল আমির’ বলতে স্মরণ করিয়ে দেন। অবশেষে আমির মুআবিয়া বললেন, আবু মুসলিমকে তোমরা বলতে দাও। তার কথার অর্থ তিনিই ভালো জানেন। এরপর আবু মুসলিম বললেন, হে মুআবিয়া! তুমি একজন মজুর। এই বকরির দলের দেখাশোনা করার জন্য তোমাকে বকরির প্রভু মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগ করেছেন। তুমি যদি চর্ম রোগাক্রান্ত বকরিগুলোর তত্ত্বাবধান কর এবং রুগ্ন বকরিগুলোর চিকিৎসা করে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ কর, তাহলে বকরির মালিক তোমাকে এর মজুরি দিবেন। আর যদি চর্ম রোগাক্রান্ত বকরিগুলোর খোঁজখবর না নাও, রুগ্ন বকরিগুলোর চিকিৎসা না কর এবং সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে যথাযথ দায়িত্বের পরিচয় না দাও, তাহলে এগুলোর মালিক তোমাকে শাস্তি দিবেন।’ রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ এমন কাজ করলে তিনি খেয়ানতকারী হবেন। কারণ দেশের অর্থনীতি ও এর প্রাণসত্তা কৃষি শিল্প বাণিজ্য সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ব্যক্তি ব্যবসায়ে পণ্য উপকরণাদি অন্যায্য দামে বিক্রি করে দেবে। ভালো এবং সাধু খরিদদার, যিনি অতিরিক্ত বা ন্যায্যমূল্য দিতে প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও অকারণে বা অন্যায়ভাবে (শত্রুতা, হিংসা, বিদ্বেষ, প্রতিশোধবশতঃ অথবা কারো থেকে হুমকি, অন্য কারো সাথে বন্ধুত্ব, নিকটাত্মীয়তা ইত্যাদির দরুন) তাকে ন্যায্যমূল্যে পণ্যসামগ্রী না দেয়া খেয়ানত ছাড়া কিছু নয়। তাতে পণ্যসামগ্রীর মালিক অবশ্যই দোষী হবেন এবং নিন্দার যোগ্য হবেন। কাজেই রাষ্ট্রীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য আবশ্যকীয় কর্তব্য হলো, কোনো খেয়ানতকারী ব্যক্তিকে প্রতিনিধি বা শাসন পরিচালক না করা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও দেশের অর্থনীতি কিংবা ভূমি ইত্যাদির ব্যাপারে ভালো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে সরকারি প্রতিনিধি বা শাসক নিয়োগ করা। লেখক : ইমাম ও খতিব, দৌলতখান মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র