পার্থিব জীবনের নানা সীমাবদ্ধতা, এর অসম্পূর্ণতা ও ক্ষণস্থায়ীত্বকে বিবেচনা করলে যেকোনো বিবেকবান, সুস্থ ও স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী মানুষ সহজেই উপলব্ধি করতে পারে যে, আখিরাতের জীবন শুধু সম্ভবই নয় বরং অপরিহার্য। কেননা, একটি চিরন্তন জীবন ছাড়া প্রতিটি মানুষের কর্মকা-ের যথাযথ প্রতিফল এই দুনিয়ার জীবনে দেয়া আদৌ সম্ভব নয়। পৃথিবীর এই জীবন শুধু ক্ষণস্থায়ী নয় , অনিশ্চিতও বটে। এখানে কে কতদিন অবস্থান করবে সে নিজেও জানে না। ফলে কোনো মানুষের কর্মকাণ্ডের যাবতীয় প্রভাব ও ফলাফল সবটুকু তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয় না; যার ফলে তার প্রাপ্য পুরস্কার বা তিরস্কার কোনোটাই পূর্ণাঙ্গভাবে দেয়া সম্ভব নয়। অথচ ন্যায়বিচারের দাবি, প্রতিটি মানুষের কর্মের যথাযথ প্রতিদান দেয়া। উদাহরণ হিসেবে আমরা দু’য়েকটি বিষয় পেশ করতে চাই-
কোনো দুষ্কৃতিকারী একাধিক মানুষ হত্যা করলে তাকে আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা যায়। কিন্তু পার্থিব জীবনে এ শাস্তি একবারই দেয়া যায়। এখন কেউ একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করলে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হলো; কিন্তু কেউ যদি ১০ জন মানুষকে হত্যা করে তাকেও একবারের বেশি ফাঁসিতে ঝুলানো যায় না। এটাই দুনিয়ার জীবনের সীমাবদ্ধতা। কিন্তু ন্যায়বিচারের দাবি ছিলÑ ১০ জনের খুনি একজনের খুনির চেয়ে ১০ গুণ বেশি শাস্তি পাবে। তেমনিভাবে একজন শাসক দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করল, কল্যাণকর আইন প্রণয়ন করে তা কার্যকর করল যার দ্বারা লাখ লাখ মানুষ উপকৃত হয়েছে; যার প্রভাব শত শত বছর ধরে মানবসমাজে কার্যকর ছিল কিন্তু ন্যায়পরায়ন ওই শাসক অনেক আগেই মারা গেছেন। সে ক্ষেত্রে তার প্রাপ্য পুরস্কার পৃথিবীর জীবনে কিভাবে দেয়া সম্ভব? পৃথিবীতে বহু অপরাধী অপরাধ করেও পার পেয়ে যায়, তার অপরাধ প্রকাশের আগেই সে মারা যায় অথবা সে অপরাধ আদৌ প্রকাশিত হয় না; কিন্তু তার কৃত অপরাধে জ্বলে পুড়ে মরে হাজারো মানুষ, ছারখার হয় কত সাজানো সংসার! এই অপরাধীর যথাযথ প্রতিদান দেয়া কি ন্যায়বিচারের দাবি নয়? কিন্তু দুনিয়ার জীবনে এর কতটুকু সম্ভব? তেমনিভাবে অজস্র মানুষ মানুষের অগোচরে অসংখ্য জনকল্যাণকর কাজ করে থাকেন, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলেন যা মানবসমাজের অগোচরেই থেকে যায়। এদের যথাযোগ্য পুরস্কার কে কোথায় বসে দেবে? সমাজ তো জানতেই পারেনি কে এই কাজটি করল? অসংখ্য নবী-রাসূল ও সৎকর্মশীল মানুষ পৃথিবীতে এসে সীমাহীন ত্যাগ, কোরবানির মাধ্যমে সত্য, সুন্দর ও পবিত্র জীবনধারা প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে নিয়োজিত ছিলেন। তাদের প্রচেষ্টায় পৃথিবী পরিচিত হয়েছে কল্যাণের সাথে। হাজার হাজার বছর পর্যন্ত মানবসভ্যতা তাদের অবদানের ফল ভোগ করেছে; কিন্তু এ সমস্ত সৎকর্মশীল মানুষ কত আগেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। তাদের যথাযোগ্য পুরস্কার দেয়ার জন্য একটি যথাযথ আদালত ও অনন্ত জীবনের একটি জগত প্রতিষ্ঠিত হওয়া তো বিবেক-বুদ্ধিরও দাবি। তেমনি চেঙ্গিস, হালাকু , হিটলার, মুসোলিনির মতো কত সভ্যতা বিধ্বংসী স্বৈরাচারী পৃথিবীতে সামান্য সময় বিচরণ করেছিল; কিন্তু তাদের জুলুম-নির্যাতনের ফলে লাখ কোটি বনি আদম সর্বস্বান্ত হয়েছে, নিহত হয়েছে, এদের বিচার পৃথিবী আদৌ করতে পারেনি; তাদের যথাযথ বিচারের জন্য একটি অনন্ত জীবন ও মহাশক্তিমান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের একটি আদালত কি বুদ্ধি ও বিবেকের দাবি নয়? এমন একটি অনন্ত জীবন ও বিচারদিনের ব্যবস্থা না হওয়াই তো বিবেক-বুদ্ধি বিরোধী। এ আলোচনা অনেক দীর্ঘ করা যায়, কিন্তু আমরা মনে করি বুঝার জন্য এটুকুই যথেষ্ট।
মানুষের জীবনচক্রও এক অসীম ও অনন্ত জীবনের দিকেই ইঙ্গিত করে : বেশ ক’বছর আগে একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত জনৈক খ্রিষ্টান পাদ্রির একটি লেখা পড়েছিলাম, যেখানে তিনি খুব জোর দিয়ে বলেছিলেন, আখিরাতের প্রতি তিনি দৃঢ় বিশ্বাসী। মানুষের জীবনচক্র এ সাক্ষী দেয়। তার লেখাটার সারমর্ম ছিল এমন যেÑ “মাতৃগর্ভে অবস্থানরত কোনো ভ্রুণকে যদি বলা যেত যে, তুমি যেখানে আছো ওটা একটা খুবই সঙ্কীর্ণ স্থান এবং কিছু নোংরা তরল বস্তুর মধ্যে তুমি সাঁতার কাটছ। ওখানে তুমি মাত্র কয়েকটি দিন থাকবে। এর পর তুমি এমন এক পৃথিবীতে আসবে যেটি তোমার এখনকার অবস্থানের তুলনায় এক তুলনাহীন বিশাল জায়গা। এখানে পাহাড় আছে , নদী ও সাগর আছে, আছে বিশাল আকাশ যার বুকে চাঁদ-সুরুজ আলো ছড়ায়। এখানে মৃদুমন্দ সমীরণ দেহ-মন জুড়িয়ে যায়; আবার রোদের প্রচ-তায় কখনো ঝলসে যাওয়ার মতো হয়। এখানে ক্ষেত-খামারে ফসল ফলে, ফুল-পাখিদের কলরবে মাতোয়ারা হয় প্রকৃতি। এই জগতে বহুদিন বহু বছর তোমাকে থাকতে হবে। সে কিন্তু সাথে সাথে বলে উঠত, ‘আমি বিশ্বাস করি না। আমি যেখানে আছি এখানেই থাকতে চাই এবং এখানেই ভালো আছি।’ এর চেয়ে বড় কোনো জায়গা থাকতে পারে এটি তার কল্পনা ও চিন্তার অতীত। কিন্তু ৯ মাসের মধ্যেই এই ভ্রুণ একটা পরিণত মানব শিশু হয়ে পৃথিবীতে চলে আসে, আসতে বাধ্য। প্রসব বেদনার মাধ্যমে তার মায়ের উদর তাকে বের করে দেয়। মায়ের উদরের তুলনায় পৃথিবী যেমন অকল্পনীয় বড় এবং বৈচিত্র্যময়, পৃথিবীর তুলনায় মানুষের পরবর্তী গন্তব্য আরো বড় এবং চিরস্থায়ী হবে এটা তো যুক্তি ও বুদ্ধিরই দাবি। কাজেই আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি পরকালীন জীবনকে।” ভদ্রলোকের লেখাটি পড়ে আমার বেশ ভালে লেগেছিল। লেখাটিতে আমাদের চিন্তার জগতকে প্রসারিত করার মতো উপাদান আছে।
উল্লিখিত সামগ্রিক আলোচনা এটিই প্রমাণ করে, আখিরাত বা পরকালীন জীবন একটি অনিবার্য বাস্তবতা- একটি অবশ্যম্ভাবী বিষয়। বুদ্ধি-বিবেচনা এবং পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য প্রমাণ এবং সর্বোপরি আমাদের জীবনচক্র আখিরাতের অনিবার্যতার সাক্ষ্যই দিচ্ছে। এখন এমন সব সুস্পষ্ট নিদর্শনাদি দেখার পর এবং সব নবী-রাসূলদের এ বিষয়ে একমত পোষণ করার পরও কেউ যদি পরকালীন জীবনকে অস্বীকার বা অবিশ্বাস করে সেটি নিঃসন্দেহে তার জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেকের দৈন্যতা এবং হঠকারিতা ছাড়া আর কী হতে পারে? এ ধরনের একগুয়ে ও হঠকারী লোকদের তাদের নিয়তির ওপর ছেড়ে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। লেখক : সাবেক সিনিয়র ব্যাংকার