শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৮:৫৬ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতায় কমছে বিদ্যুৎ উৎপাাদন গাজীপুর মিডিয়া ক্লাবের উদ্যোগে ইফতার ও দোয়া মাহফিল ফটিকছড়িতে ন্যাশনাল লাইফ ইন্সুইরেন্সের ইফতার মাহফিল আলোচনা সভা টুঙ্গিপাড়া প্রেসক্লাব এর সভাপতি সওকত হোসেন মুকুল, সাধারণ সম্পাদক মোঃ আফজাল হোসেন নির্বাচিত জামালপুরে ৩৫ বিজিবির পক্ষ থেকে অসহায় দুস্থদের মাঝে ইফতার ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ উদ্বোধন ঈদের পোশাকের দাম গরিবের হাতের নাগালের বাইরে তাড়াশে প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে ছাগল প্রদান বরিশালে সাশ্রয়ী মূল্যে ডিম বিক্রির কার্যক্রম উদ্বোধন বাগেরহাটে গাঙচিলের উদ্যোগে ইফতার মাহফিল

কর্মহীন মানুষের ভিড় বাড়ছে

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২০

মানুষের ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এলেন ষাটোর্ধ্ব এক নারী। নাম ফাতেমা বেগম। বললেন, ‘ঝুলির ওপর সংসার। ভোর হলে দু’জন দু’দিকে চলে যাই। সারাদিন ঘুরলেও ঝুলিতে দু’মুঠো চাউল মেলে না। কে কারে সাহায্য দেবে?’ নোটবুকে লিখতে হবে তার নাম; ছবিও তুলতে হবে- আকুতি তার।
গ্রামের কোথাও বাইরে থেকে আসা লোক দেখলেই মানুষ এভাবেই ছুটে আসে। নাম লেখাতে চায়। কথা বলতে চায়। নাম লেখাতে পারাটাও যেন তাদের কাছে বড় প্রশান্তির। কিছু একটা সাহায্য পাওয়ার আশা জাগে তাদের মনে। স্বামী বাবর আলীসহ ফাতেমা বেগম সারা গ্রাম ঘুড়ে চেয়েচিন্তে তাদের জীবন চালিয়ে আসছিলেন বহু বছর ধরে। একে একে সব হারিয়েছেন। এখন কিছুই অবশিষ্ট নেই। কোনোমতে থাকার একটা ঘর আছে। সেটাও ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন ঘর থেকেও নেই। কারণ সেখানে থাকার উপায় নেই।
বহু মানুষের রোজগারের ভরসা এই নৌকা: সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগরের কুড়িকাহুনিয়া কাঠালতলা গ্রামের এই ছবি বলে দেয় কেমন আছে বাংলাদেশের পশ্চিম উপকূলের ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার মানুষ। মাত্র ছয় মাস আগে ২০ মে রাতে যে প্রলয় এই এলাকায় বয়ে গিয়েছিল তার দগদগে ক্ষত এখনও স্পষ্ট। কৃষি কাজ, চিংড়ির ঘের, মাছ ধরা, অন্যান্য মজুরির কাজ দিয়ে ভালোই ছিলেন মানুষগুলো। কিন্তু ছয় মাসের ব্যবধানে গ্রামের পর গ্রাম বিরাণ জনপদে পরিণত হয়েছে। কাজ নেই, আয় রোজগারে ভাটা পড়েছে। এই সঙ্গে তিনবেলা খাবার যোগাড়েও হিমশিম খাচ্ছে তারা। শুধু প্রতাপনগর নয়, শ্যামনগরের গাবুরা, পদ্মপুকুর, কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশি, দক্ষিণ বেদকাশিসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের ছবি একই রকম। এসব এলাকায় চারদিকেই খবরের ছবির ফ্রেম। যেন যে ছবিটাই তোলা হোক না কেন, প্রত্যেকটা ছবিরই আছে অনেক বড় গল্প। কুড়িকাহুনিয়া-কাঠালতলা গ্রামের খানিক দূর এগোতেই আবদুস সাত্তার গাজীর বাড়ি। ছোট খাল বড় হয়ে ভাঙন এসেছে তার দুয়ারে। ঘর থেকে বের হলেই নদী এবং ভাঙন। আশপাশের বেশ কয়েকটা ঘর ভাঙনে হারিয়ে গেছে। সাত্তার গাজী নানান কৌশলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করছেন। এখন ভাঙন ঠেকাবেন, নাকি আয়-রোজগারের চেষ্টা করবেন বুঝতে পারছেন না। সাত্তার গাজী এবং তার স্ত্রী জাহেরা খাতুন প্রতিক্ষণ ঘরের সামনে নদীর দিকেই তাকিয়ে থাকেন। মনজুড়ে ভয় কখন ঘরের সামনের এক টুকরো মাটি নদীতে হারায়! জীবনের শেষ বয়সে এমন সমস্যায় পড়বেন কল্পনা করেননি। সাত্তার গাজী নদীর দিকে আঙুল তুলে বললেন, এই যে অনেক বড় নদী দেখছেন; এই নদী ছিল অনেক ছোট। নদীর তীর থেকে বালু উত্তোলন করা হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের জলোচ্ছ্বাসের চাপে যখন প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে পানি প্রবেশ করে, তখন নদীর তীরে ভাঙন দেখা দেয়। সেই ভাঙনই এখন আমার ঘরের দুয়ারে। ছেলেরা অনেক কষ্ট করে ঘরখানা উঠিয়েছিল। দালান ঘরের কাজ এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু ঘরের বাকি কাজ শেষ করা যাবে কিনা জানি না। কথা বলতে বলতে কণ্ঠস্বর আটকে আসে সাত্তার গাজীর।
কালভার্ট ভেঙে বিধ্বস্ত রাস্তা, পারাপারের ভরসা নৌকা: সাত্তার গাজীর পাশের ঘরটি ছিল আবুল কালাম গাজীর। সে ঘরটি কয়েকদিন আগেই জোয়ারের পানির চাপে নদীতে ভেসে গেছে। কালাম গাজী স্ত্রী- ছেলেমেয়েদের পাঠিয়েছেন পাশের ইউনিয়নে এক আত্মীয়ের বাড়ি। নিজে এবাড়ি ওবাড়ি কোনোমতে দিন কাটাচ্ছেন। আগে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরণের কাজ করতেন; এখন কাজকর্ম নেই। ছায়রা বেগম, রজব আলী, মাকসুদার রহমান, ছালমা বেগম, মিনারা বেগম, ইব্রাহিম খালিলসহ আর অনেকের অবস্থা একই রকম। কর্মহীন মানুষের ভিড় এই এলাকায় ক্রমেই বাড়ছে। রাস্তার ভাঙা অংশটুকু নৌকায় পেরিয়ে পায়ে হাঁটা পথ। ইট বিছানো রাস্তা ছিল গ্রামের এই পথে। কিন্তু জোয়ারের পানি উঠে সব এবরোথেবরো হয়ে গেছে। পায়ে হেঁটে চলা কঠিন। তবুও রাস্তার শেষ মাথায়, আবুল বাশার মোড়লের বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া যায়। কিন্তু এর পরের অংশে পায়ে হাঁটার আর কোনো সুযোগ নেই। বাশার মোড়লের বাড়ির সামনে এখন শাহজাহান মোড়লের খেয়াঘাট। তিনি যে জলের উপরে ডিঙি ভাসিয়ে লোকজন পারাপার করেন, সেই জলের নিচেই ছিল তার কৃষি জমি। কৃষিকাজ করে তার সংসার চলে যেত। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আম্ফান তার জীবিকা কেড়ে নিয়েছে। নৌকায় যাত্রী পারাপার করে ১০০ থেকে ১৫০ টাকার বেশি পাওয়া যায় না। ঘরের সাত জনের মুখে খাবার তুলে দেওয়া তার পক্ষে এখন খুবই কঠিন।
প্রতাপনগর ইউনিয়নের আম্ফান ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার যেদিকে চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। সবখানে ধ্বংসের চিহ্ন। এলাকার মানুষ বলেছেন, ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলার চেয়েও এবারের ঘূর্ণিঝড়ে বেশি ক্ষতি করেছে। বেড়িবাঁধ না থাকায় ঘূর্ণিঝড়ে ভোগান্তি স্থায়ী হয়েছে ছয় মাসের বেশি সময়। আরও কতদিন এই ভোগান্তির মধ্যে থাকতে হবে, জানা নেই কারো। বাসিন্দারা বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের আঘাতের সময় এই এলাকায় কিছু জমিতে ছিল বোরো ধান, আর কিছু জমিতে ছিল চিংড়ি ঘের। ধান যেমন কৃষকেরা ঘরে তুলতে পারেনি, তেমনি চিংড়িও ভেসে গেছে। উভয় ক্ষেত্রেই বড় ধরনের লোকসান গুনতে হয়েছে। অন্যদিকে এবার আমন মৌসুমে অনেক জমিতে ধান আবাদ করা সম্ভব হয়নি।
কিছু মানুষ কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করেন: প্রতাপনগর গ্রামের বয়সী ব্যক্তি আবদুস সামাদ এলাকার কৃষি এবং চিংড়ির খামারের ক্ষয়ক্ষতি তুলে ধরে বলছিলেন, এই এলাকায় প্রতি একরে ইরিধান হয় অন্তত ৫০ মণ। এর মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৭৫ হাজার টাকা। অন্যদিকে আমনের একরপ্রতি ফলন ৪৫ মণ। এর মূল্য ৬২ হাজার টাকা। ইরি ও আমনের আবাদ ঠিকঠাক তুলতে পারলে এলাকার মানুষের সংকট থাকতো না। অন্যদিকে চিংড়ির এই দুটো মৌসুম চলে যাচ্ছে। প্রত্যেক চিংড়ি চাষী অন্তত আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা লোকসান গুনবে। কৃষি এবং চিংড়ির খামারে কাজকর্ম থাকলে এলাকার বহু মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি হতো। এলাকায় জোয়ারের পানি ওঠানামা করায় কৃষি ও চিংড়ি আবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না।
কথা হলো চিংড়ি চাষি নূর ইসলামের সঙ্গে। চিংড়ি চাষি থেকে তিনি এখন নৌকার মাঝি। এই এলাকায় সাধারণত অন্যের কাছ থেকে জমি হাড়ি (লিজ) নিয়ে চিংড়ি চাষ করা হয়। জমির মালিককে মৌসুমভিত্তিক টাকা দিতে হয়। নূর ইসলাম যে জমিতে চিংড়ি চাষ করে আসছিলেন, ওই জমি এখন পানির নিচে। চিংড়ি চাষ করতে না পারলেও জমির মালিককে টাকা ঠিকই দিতে হয়েছে। এখন তার উপায় কী? এদিকে সংসার চালানোর মতো আয় রোজগারও নেই। নূর ইসলাম বাচ্চাসহ তার গাভী বিক্রি করে দিয়েছেন। জমির মালিককে টাকা শোধ করে কিছু টাকা বাঁচিয়ে একখানা ডিঙি কিনিছেন। এখন মানুষজন পারাপার করে যা পাওয়া যায়, তা দিয়েই চলে সংসারের খরচ।
বহুমূখী পেশায় মানুষের টিকে থাকার চেষ্টা: ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের মাত্র কয়েকদনি পরে যেন আরেক বিপর্যয় এলো প্রতাপনগরবাসীর জীবনে। ফুলতলা বাজারের কাছে ছিল একটি কালভার্ট। কিন্তু সে কালভার্ট পানির তোড়ে আকস্মিকভাবে ভেঙে যায়। এতে শুধু তালতলাকে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্নই করেনি, কালভার্টসংলগ্ন ছোট খালটি বড় নদীতে পরিণত হয়েছে। নদীর দুধারে সৃষ্টি হয়েছে ভাঙন। কালভার্টের এখানে মানুষজন পারাপার হয় নৌকায়। প্রতাপনগর থেকে পাশের ইউনিয়ন আনুলিয়ায় যেতে হলেও এই নৌপথের বিকল্প নেই। ছ’মাসে প্রতাপনগরের জীবন যেন থেমে গেছে। -উৎস: রাইজিংবিডি.কম




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com