করোনাকালে কৃষকদের নিয়মিত ঋণ দেয়ার পশাপাশি প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ বিতরণ করার কথা ব্যাংকগুলোর। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর, এ ছয় মাসে ব্যাংকগুলো কৃষকদের ঋণ দিয়েছে ১২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। বিপরীতে একই সময়ে কৃষকদের কাছ থেকে আদায় করেছে ১৪ হাজার ৯১ কোটি টাকা। সে হিসেবে গত ছয় মাসে ব্যাংকগুলো বিতরণের তুলনায় ২২ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেশি কৃষিঋণ আদায় করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃত কৃষকরা কখনই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হন না। এ কারণে ছাড় পেয়েও কৃষকরা ব্যাংকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ করেননি। অন্যদিকে সুযোগ পেয়েই দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বড় বড় শিল্প গ্রুপগুলো ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছে না।
করোনার কারণে ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধে বাধ্যবাধকতায় ছাড় ছিল বিদায়ী বছরজুড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নীতি ছাড় বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছেন বৃহৎ শিল্পোদ্যোক্তারা। মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বড় অংশও এ সুযোগ নিয়েছেন। তবে ছাড় পেয়েও কিস্তি পরিশোধ থেকে বিরত থাকেননি কৃষকরা। পরিসংখ্যান বলছে, মহামারীকালে অনুপাতিক হারে কৃষকরাই সবচেয়ে বেশি অর্থ পরিশোধ করেছেন। এ সময়ে ব্যাংকগুলো কৃষকদের যে পরিমাণ ঋণ দিয়েছে, তার চেয়েও বেশি ঋণ আদায় করেছে।
দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হয়েছিল ২০২০ সালের মার্চে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে দেশের বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অংশই ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ করে দেয়। ওই প্রান্তিকে মাঝারি, ক্ষুদ্র ও কৃষিঋণ আদায়ে প্রবৃদ্ধি হলেও বৃহৎ শিল্পের ঋণ আদায় কমেছিল প্রায় ১৬ শতাংশ। এরপর মাহামারীর বিস্তৃতি ঘটলে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে সব ঋণের কিস্তি আদায়ে ধস নামে। ওই প্রান্তিকে বৃহৎ শিল্পের ঋণ আদায় কমেছিল ৫৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। একই সময়ে মাঝারি শিল্পে ৪০ দশমিক ৯২ শতাংশ ও ক্ষুদ্র শিল্পে ৪৪ দশমিক ১৮ শতাংশ ঋণ আদায় কমে গিয়েছিল।
মহামারীতে অর্থনৈতিক কর্মকা- প্রায় স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার সময়েও অন্যদের তুলনায় বেশি ঋণ পরিশোধ করেছিলেন কৃষকরা। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে কৃষকদের কাছ থেকে ঋণ আদায় কমেছিল ৩৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। যদিও ওই সময়ে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত ছিল।
শিল্পোদ্যোক্তাদের তুলনায় কৃষকরা বেশি ঋণ পরিশোধ করেছেন জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকেও। এ প্রান্তিকে বৃহৎ শিল্পে ঋণ আদায় কমেছিল ৪৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। একই সময়ে মাঝারি শিল্পে ২৭ দশমিক শূন্য ৫ ও ক্ষুদ্র শিল্পে ৪৮ দশমিক ১০ শতাংশ ঋণ আদায় কমেছিল ব্যাংকগুলোর। কিন্তু জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে কৃষকরা ২০১৯ সালের একই সময়ের তুলনায় ৪৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি অর্থ ব্যাংকগুলোকে পরিশোধ করেছেন।
আগের বছরের তুলনায় কৃষকরা বেশি অর্থ পরিশোধ করেছেন অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকেও। সব মিলিয়ে মহামারীর মধ্যে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে কৃষকরা ঋণ পরিশোধ করেছেন ১৪ হাজার ৯১ কোটি টাকা। যদিও ২০১৯ সালের একই সময়ে কৃষকরা ১১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেছিলেন।
ব্যাংক এশিয়ার শীর্ষ নির্বাহী মো. আরফান আলী বলেন, কৃষক ও কৃষি হলো বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ। মহামারীর মধ্যে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অনেক বড় গ্রাহক ব্যাংকের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেননি। শিল্পপতিরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কৃষকরা সে সুযোগ নেননি। বরং বেশির ভাগ কৃষকই ব্যাংকের ঋণের কিস্তি যথাসময়ে পরিশোধ করেছেন। কৃষকরা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা আগামী দিনে ব্যাংকগুলোর ঋণ নীতিমালা প্রণয়নে ভূমিকা রাখবে। প্রতিটি ব্যাংক গড়ে ২ হাজার কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণ করলেও ব্যাংক খাতের কৃষিঋণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা। আশা করছি, আগামী দিনে কৃষিঋণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য স্বল্প সুদের ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক প্যাকেজটির আওতায় ঋণ বিতরণের সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিল ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু ব্যাংকগুলোর ব্যর্থতার কারণে কয়েক দফায় এ সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। বছর শেষ হলেও প্রণোদনা প্যাকেজের অর্ধেক ঋণও এখনো ব্যাংকগুলো বিতরণ করতে পারেনি। একই সঙ্গে কৃষিঋণ নীতিমালা অনুযায়ী নির্ধারণ করা ঋণও বিতরণ করতে পারেনি বেশির ভাগ ব্যাংক। ফলে ২০২০ সালের জুনের তুলনায় ডিসেম্বরে কৃষিঋণের কিস্তি দেড় হাজার কোটি টাকা কমেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে দেশের কৃষি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৪৫ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে কৃষিঋণের এ স্থিতি ৪৪ হাজার ৮৯ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
দেশে সবচেয়ে বেশি কৃষিঋণ বিতরণ করে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি)। সরকারি বিশেষায়িত ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহী মো. আলী হোসেন প্রধানিয়া বলেন, মহামারীর মধ্যে আমরা ঋণ পরিশোধের জন্য কৃষকদের কোনো চাপ দিইনি। তার পরও বেশির ভাগ কৃষক ব্যাংকের ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ করেছেন। ২০২০ সালে আমরা ৪ হাজার ৬৩৬ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছি। মহামারীর মধ্যেও বিদায়ী বছর কৃষি ব্যাংকের ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ আদায় হয়েছে। প্রকৃত কৃষক ঋণ পেলে কখনই খেলাপি হন না। মহামারীর মধ্যে আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি।
বিকেবির এ শীর্ষ নির্বাহী জানান, ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ১ হাজার ৪৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। এর মাধ্যমে খেলাপি ঋণ থেকে নগদ আদায় হয়েছে ৬৫ কোটি টাকা। কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশে নেমে এসেছে। দুই বছর আগেও এ হার ২০ শতাংশের বেশি ছিল।
কৃষি খাতে ঋণ বিতরণে জোর দিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, মহামারীতে আমাদের কৃষকরাই অর্থনীতির হাল ধরে ছিলেন। পাশাপাশি তারা অন্যদের তুলনায় ব্যাংকের অর্থও বেশি পরিশোধ করেছেন। এটি দেশের শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য একটি বার্তা। সিরাজুল ইসলাম জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থবছরের শুরুতেই ব্যাংকগুলোকে কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। কোনো ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হলে সমপরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের হিসাব থেকে কেটে রাখে। পরবর্তী বছরের লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে আগের ব্যর্থতার অংশটি জুড়ে দেয়া হয়। এভাবেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে।