আর্থিক খাতে দুর্যোগের অশনিসংকেত নিয়ে এসেছিল কভিড-১৯। এ পরিস্থিতি সামাল দেয়ায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নেয়া হয়েছে চাহিদা অনুযায়ী তারল্যের জোগান, নীতি সুদহারে কাটছাঁট, লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা-বাস্তবায়নসহ নানামুখী উদ্যোগ। তবে দেশের অর্থনীতিকে টেনে তোলার সফলতার কৃতিত্ব পাওয়া দূরের কথা, সাম্প্রতিক সময়ে নানা কারণে সমালোচনায় বিদ্ধ হতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক্ষেত্রে মূলত ২০১০-পরবর্তী ছয় বছরের কৃতকর্মের ফলই ভোগ করতে হচ্ছে দেশের ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটিকে।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সে সময় বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদেরও। তারও আগে থেকে দেশের ব্যাংক খাতের বড় বড় কেলেঙ্কারির ঘটনায় প্রশ্নের মুখে পড়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্তৃত্ব। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত ঘুষ নেয়ার অভিযোগও উঠতে শুরু করেছে। লুণ্ঠনের শিকার ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল হক ও পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী সম্প্রতি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তা আরো বিব্রতকর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিএম, জিএম, নির্বাহী পরিচালক ও ডেপুটি গভর্নররা ঠগবাজ, প্রতারক ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেশাগতভাবে সৎ কর্মকর্তারাও মানসিক পীড়ায় ভুগতে শুরু করেছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক, মহাব্যবস্থাপক, উপমহাব্যবস্থাপক, যুগ্ম পরিচালকসহ বিভিন্ন স্তরের কয়েক ডজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে বণিক বার্তা। এদের মধ্যে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির কর্মকর্তারা যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন যাদের ঘিরে অভিযোগ উঠছে তারাও। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাদের প্রত্যেকেই নিজেদের অস্বস্তি ও মানসিক পীড়ার কথা অকপটে জানিয়েছেন।
২০০২ থেকে এ পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিযুক্ত কর্মকর্তাদের সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে আদালতের পর্যবেক্ষণে। উচ্চ আদালতের এ পর্যবেক্ষণ ঘিরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও অনাস্থার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে এরই মধ্যে সাত সদস্যের ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং’ কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, পিকে হালদারের নেতৃত্বে লুণ্ঠনের শিকার দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান-এমডিরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোয় এ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইছেন। উচ্চ আদালত দুই দশক ধরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের তদন্তের আওতায় আনতে বলেছেন। এতে আরো বেশি বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ সময় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিদর্শন ও নীতি প্রণয়নে অনেক কর্মকর্তাই যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে কনিষ্ঠ কর্মকর্তারা ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশ পালন করেছেন মাত্র।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অধিকাংশ কর্মকর্তাই সৎ বলে মনে করেন সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। এ অর্থনীতিবিদ বণিক বার্তাকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আমরা ‘মরুভূমির মধ্যে মরূদ্যান’ মনে করতাম। কিন্তু সে প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে যে ধরনের বিতর্ক উঠছে তা অপ্রত্যাশিত ও অগ্রহণযোগ্য। হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে যেসব বক্তব্য উঠে এসেছে, তা উদ্বেগজনক। গভর্নর হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধিকাংশ কর্মকর্তা সৎ ও কর্মঠ। অল্প কিছু কর্মকর্তার লোভ ও অপকর্ম সৎ কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে দিচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সৎ কর্মকর্তারা পিছিয়ে পড়েন।
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের পর্যবেক্ষণ হলো, ২০০৯ সাল থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে। ঋণখেলাপিদের বিষয়ে নীতি শৈথিল্যের যে চর্চা তখন শুরু হয়েছিল, তাই এখন বিষফোড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব হবে, অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্তদের খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংস্কার খুব বেশি দরকার। এক্ষেত্রে তিন বছরের জন্য একটি শক্তিশালী ‘সংস্কার কমিটি’ গঠন করা দরকার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোটা দাগে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) যেসব অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থ লোপাটের ঘটনা নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলোর সূত্রপাত এক দশক আগে। ২০১১ সালের দিকে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি ধরা পড়লে দেশের ব্যাংক খাতে তোলপাড় শুরু হয়। তারপর থেকে ধরা পড়তে থাকে বেসিক ব্যাংকের লুণ্ঠন, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ফারমার্স ব্যাংক, এননটেক্স, ক্রিসেন্ট গ্রুপের মতো বৃহৎ কেলেঙ্কারিগুলো। বড় বড় কেলেঙ্কারির ঘটনায় সবার নজর যখন ব্যাংক খাতের দিকে, তখনই নীরবে লুণ্ঠন হতে থাকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। পিকে হালদারের লুণ্ঠনের শিকার যে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে এ মুহূর্তে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, সেগুলোর সূত্রপাতও ২০১২-পরবর্তী সময়ে। ওই সময়ে বপন হওয়া অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনাগুলোই এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাবমূর্তি ক্ষুণেœর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে কথা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপক পদে দায়িত্ব পালনকারী একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে। তাদের প্রত্যেকে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেছেন, যেসব অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে এ মুহূর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রশ্নের মুখে পড়েছে, সেসব ঘটনা অনেক আগে থেকেই ‘ওপেন সিক্রেট’ ছিল। নিচের দিকের কর্মকর্তারা অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনাগুলো তুলে ধরে ফাইল উপস্থাপন করা হলেও সেগুলো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ‘কার্পেট চাপা’ দিয়েছেন। কোন কোন কর্মকর্তা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশির ভাগ কর্মকর্তাই জানেন। পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কারা অনিয়ম করছেন, সেগুলোও সবার জানা।
তবে মূল দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘিরে নতুন নতুন বিতর্ক উঠছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, নীতিনির্ধারকদের বোঝা উচিত বাংলাদেশ ব্যাংক কখনই ‘ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ নয়। কিন্তু গত এক দশকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে রূপান্তর করা হয়েছে। কোর ব্যাংকিং থেকে সরে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘সিএসআর, গ্রিন ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং, ১০ টাকার হিসাবসহ বিভিন্ন ঐচ্ছিক কাজকে প্রাধান্য দিয়েছে। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান দায়িত্বই হলো সরকারের আর্থিক নীতির বাস্তবায়ন। মরীচিকার পেছনে ছুটতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে। একই সঙ্গে কর্মকর্তারা অনৈতিক কর্মকা-ে যুক্ত হওয়ার স্বাধীনতা পেয়েছেন।’
এ বিষয়ে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের ভাষ্য হলো, নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সেরা প্রতিষ্ঠান ছিল। আইনিভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তাও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা রক্ষায় যথেষ্ট। কিন্তু আমরা দেখছি, বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রমাগতভাবে ব্যর্থতার দিকে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুর্বল হয়ে গেলে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের আদেশ-নির্দেশ মানবে না। সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তারা বর্তমানে হতোদ্যম হয়ে যাচ্ছেন। অনেক কর্মকর্তাই মর্মপীড়ায় ভুগছেন। এ পরিস্থিতির অবশ্যই পরিবর্তন দরকার।
২০০৯ সাল পরবর্তী সাত বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ড. আতিউর রহমান। ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তুমুল সমালোচনার মুখে পদত্যাগ করেন তিনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। আমি যে গভর্নর ছিলাম, সেটিও ভুলে যেতে চাই।’
‘যেসব দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ মুহূর্তে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে, তার সূত্রপাত ২০১২ সাল পরবর্তী সময়ে। ওই সময় গভর্নর পদে আপনিই দায়িত্ব পালন করেছেন। দায়িত্ব পালনকালে অনিয়মের বিষয়গুলো আপনার নজর এড়িয়ে গেল কীভাবে?’ এমন প্রশ্নের জবাবে ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। এর বেশি কিছু বলতে চাই না।’ কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্পর্কে যেকোনো নেতিবাচক মন্তব্য দেশের ভাবমূর্তিকেই ক্ষুণœ করে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, হাইকোর্ট যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, সেটি একান্তই হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ। আবার দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান-এমডি যেসব অভিযোগ তুলেছেন, সেটিও তাদের নিজস্ব বক্তব্য। আমি ওই সব পর্যবেক্ষণ ও অভিযোগকে গ্রহণ করছি না, আবার প্রত্যাখ্যানও করছি না। তবে এসব ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে। মুদ্রাবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাবমূর্তির সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তিও জড়িত। স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের ঘটনা আমাদের জন্য বিব্রতকর। সিরাজুল ইসলাম বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশে এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি করেছে। এ কমিটির তদন্তে প্রকৃত সত্য উঠে আসবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। ব্যাংক খাতের অভিভাবক হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার দায়িত্ব পালন করছে। তবে প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরও নিজের ঘর পাহারা দেয়ার দায়িত্ব রয়েছে। এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।-বণিকবার্তার সৌজন্যে