শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৪০ অপরাহ্ন

হারিয়ে যাচ্ছে করাতি সম্প্রদায়

মোল্লা আব্দুর রব বাগেরহাট প্রতিনিধি :
  • আপডেট সময় বুধবার, ৩ মার্চ, ২০২১

প্রাচীন যুগে মানুষ বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ের গুহায় বসবাস করতো।মধ্যযুগে এসে একটু একটু করে মানুষ যখন সভ্যতা বুঝতে শিখে, তখন বনের কাঠ-বাঁশ, ডালপালা, লতাপাতা দিয়ে ঘর বানাতে শুরু করে। ধীরে ধীরে উন্নয়ন ঘটতে থাকে সভ্যতার। সৌন্দযর্ প্রিয় হয়ে উঠতে থাকে মানব জাতি।উন্নয়ন ঘটে রুচি বোধেরও। আর তখন থেকেই নিরাপদ বসবাসের জন্য শুরু হয় ঘরবাড়ি নির্মাণ। মানুষ একসময় প্রয়োজনবোধ করে ভালো বাড়ি বাননোর। সুন্দর ও মজবুত বাড়ি বানাতে প্রয়োজন পড়ে গাছ কাটার। শুরুর দিকে লোহার করাতের আবিষ্কার বা ব্যবহার না জানলেও গাছ কাটার বিকল্প উপায় বের করে মানুষ। সঠিক দিনক্ষণ জানা নেই। তবে সভ্যতার বিবর্তনে এক সময় আবিষ্কার হয়ে যায় লোহার হাত করাতের। এর পর থেকেই প্রচলন হয় করাত দিয়ে কাঠ চেরাইয়ের। করাতি সম্প্রদায় গড়ে ওঠে সমাজে। কিন্তু সভ্যতার শুরুতে গড়ে ওঠা সেই করাতি সম্প্রদায় এখন প্রায় বিলুপ্ত। সচরাচর দেখা মেলে না এদের। অঞ্চল ভেদে করাতি সম্প্রদায়ের হাতেগোণা দু-একটি পরিবার ধরে রেখেছে তাদের এই পুরনো ঐতিহ্য। তবে, যান্ত্রিক করাত কলের বিস্তার ঘটায় এখন তাদের আর আগের মতোন কদর নেই। আগে তাদের মূল পেশাই ছিল এটি। সারা বছর গ্রামে গ্রামে ঘুরে কাঠ চেরাইয়ের কাজ করতো তারা। গ্রামের পথে ঘাটে হাটলে প্রায় বাড়িতেই শোনা যেতো হাত করাতের টানের এক অন্যরকম ছন্দ। কিন্ত এখন তা অতীত। দুর্দিন তাই জীবন-জীবীকার তাগিদে অন্য পেশা বেছে নিয়েছে করাতি সম্প্রদায়ের লোকেরা। বর্তমানে অন্য পেশার পাশাপাশি বছরের মাত্র কয়েক মাস এই কাঠ চেরাইয়ের কাজ করে তারা। সম্প্রতি বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার আমড়াগাছিয়া গ্রামে দেখা মেলে এই সহিষ্ণু হাত করাতি সম্প্রদায়ের একটি দলের।খুলনার কয়রা উপজেলার মহারাজপুর গ্রাম থেকে এসেছেন তারা। দলের সদস্য তিনজন। এটি এখন আর মূল পেশা নেই তাদের। কৃষি ও অন্যান্য শ্রমিকের কাজ করেন তারা। শুষ্ক মৌসুরে কয়েকমাস করেন এই করাতির কাজ। তারা শরণখোলাসহ উপকূলের মঠবাড়িয়া, পাথরঘাটার বিভিন্ন গ্রামে কাঠ চেরাইয়ের কাজ করছেন গত ১০-১২বছর ধরে। করাতি দলের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য বাবর আলী গাজী ১২বছর বয়েস থেকেই এই পেশায়। এখন তার ৭০। তিনি বলেন, আমার বাপ-দাদারা এই কাজ করতেন। আমি কাজ শুরু করি মামা হাসিব মল্লিকের সঙ্গে। তখন সাতক্ষীরা, খুলনা, কুষ্টিয়া, গোপালগঞ্জ, যশোর অঞ্চলে কাজ করতাম। সেসময় সারা বছরই কাজ হতো। বাপ-দাদার পুরনো পেশা ধরে রাখতেই এখন বছরে দু-চারমাস করি। অন্য সময় এলাকায় কৃষি কাজ করি। বাবর আলী হতাশা প্রকাশ করে বলেন, কারেন্টের করাত কল গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে গেছে। মানুষ এখন সবকিছু সহজে করতে চায়।তাছাড়া বেশিরভাগ মানুষ পাকা বাড়ি তৈরী করছে। কাঠের ঘর খুবই কম হয়। তাই আমাদের আগের মতোন কদরও নেই। করাতির কাজ করে এখন সংসারও চলে না! দলের অন্য দুই সদস্য হারুন মল্লিক(৫০) ও আলমগীর মল্লিক(৫৫) বলেন, আগে মজুরি কম হলেও কাজ বেশি হতো।তাতেই পুশিয়ে যেতো। এখন মজুরি বেশি কিন্তু কাজ কম।আগে একটি করাতের দাম ছিল ৭০০টাকা। আর এখন তা সাড়ে তিন-চার হাজার টাকা।অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও বেশি।মাসকে মাস বাইরে থেকে খাওয়া খরচও বেশি হয়ে যায়। তাই এই পেশা পরিবর্তন করে আমাদের করাতি সম্প্রদায়ের লোকেরা বেশিরভাগই অন্য পেশায় চলে গেছে। আমাদের এলাকায় বর্তমানে চার-পাঁচটি পরিবার এই পেশায় নিয়োজিত আছে। যান্ত্রিক করাত এবং হাত করাতে কাঠ কাটার গুণগত কোনো পার্থক্য আছে কি না জানতে চাইলে তারা বলেন, হাত করাতে কাঠের আশ ধরে কাটা হয়।একারণে কাঠ মজবুত হয়। মালের পরিমানও বেশি হয়। আর কারেন্টের মিলে কাটলে কাঠের অপচয় হয় বেশি।মিলে যেভাবে খুশি সেভাবেই কাটার ফলে দেখতে সুন্দর হলেও আশ কেটে কাঠ দুর্বল হয়ে যায়। তাছাড়া, হাত করাত পরিবেশ বান্ধব। আগের যুগে হাত করাত দিয়ে কাটা কাঠের ঘর একশ’-দেড়শ’ বছর বয়স পেতো।কিন্তু এখন বছর যেতে না যেতেই কাঠের ঘর ভেঙে পড়ে। যারা হাত করাতে কাটার গুনাগুণ সম্পর্কে জানে-বোঝে তারাই আমাদেরকে ডাকে। করাতিরা জানান, তাল গাছ কাটা হয় হাত হিসেবে। এক হাত তাল গাছ ১৬০ থেকে ২০০টাকা।অন্যান্য গাছের তৈরী ঘরের খুঁটি, আড়া, কাচপাইড়, পেটি আট হাতি ২০পিচ তিন হাজার টাকা। চটা, রুয়া ও অন্যান্য মালামাল আট হাতি ২০পিচ চেরাই করেন আড়াই হাজার টাকা করে। তিন-চার মাসে সমস্ত খরচ বাদে তারা একেক জন ১৮-২০হাজার টাকা আয় করেন। বাকি সময় এলাকায় অন্য কাজ করে কোনোরকম খেয়েপরে আছেন তারা। শরণখোলা সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও সমাববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এইচ এম আব্দুল হালিম বলেন, তথাকথিত জমিদাররা বাদে আগের কালে সবাই কাঠ দিয়ে ঘরবাড়ি তৈরী করতো। এজন্য হাত করতিরাই ছিল একমাত্র ভরসা। এখন এই সম্প্রদায় নেই বলেলই চলে।প্রযুক্তির উন্নয়নে হারিয়ে যাচ্ছে সম্প্রদায়টি। হাতে কাঠ কাটতে সময় ও খরচ বেশি। তাই যেটা সহজ সেটাই বেছে নিচ্ছে মানুষ। তবে, হাত করাতি সম্প্রদায় আমাদের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য বহন করে। বাঙালী ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে এই সম্প্রদায়কে রক্ষা করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com