মহান স্বাধীনতার মাস মার্চের ১৯তম দিবস আজ । ঊনিশশ’ একাত্তরের এই দিনে সকাল ১০টায় মুক্তিকামী মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সহকর্মীদের নিয়ে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট হাউজে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে আলোচনা করতে যান। আলোচনাকালে ইয়াহিয়া বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াসের ব্রিফ অনুযায়ী আগে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের প্রস্তাব দিলে বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে তা নাকচ করে দিয়ে আগে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে তার দাবির পুনরুল্লেখ করেন। তিনি তাকে জানান যে, দেশের সংবিধান খসড়া রচনা হয়ে গেছে এবং সম্ভাব্য স্বল্প সময়ের মধ্যেই তা পেশ করা হবে। এর ফলে দেশে যে শাসনতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক জটিলতা সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে তা একটা কাল্পনিক ব্যাপার ছাড়া কিছু নয়। শেখ মুজিব তার বাসভবনে সাংবাদিকদের বলেন, আলোচনায় কিছু অগ্রগতি হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে আরো কিছু সময়ের প্রয়োজন। আমি বিশ্বাস করি জেনারেল ইয়াহিয়া বাস্তবতাকে অনুধাবন করবার চেষ্টা করছেন। তার বিপরীতে কিছু হলে তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক। একই দিন ঢাকাস্থ সোভিয়েত কনসাল জেনারেল পেট্রোভ ভলটিন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে তার সাথে দেখা করেন। মি. ভলটিন তাকে বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে সোভিয়েত সরকার ও জনগণের উদ্বেগের কথা জানান। এই দিনে ভারত উপমহাদেশের দ্বিতীয় সিপাহী বিপ্লব সংঘটিত হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাঞ্জাবী ও অন্যান্য অবাঙ্গালী অফিসাররা গাজীপুরের জয়দেবপুরস্থ সেনা ছাউনীর বাঙ্গালি অফিসার ও সিপাহীদের অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দেয়। বাঙ্গালিরা সে নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করে স্ব স্ব অস্ত্র হাতে নিয়ে নিজেদের অবস্থানে প্রস্তুত হতে থাকে। পাকিস্তানীরা যখন তাদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিতে যায় তখন সকল অস্ত্র গর্জে ওঠে। মূলত এদিন স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা ঘটে। পাকিস্তানী সৈন্যরা পাল্টা হামলা চালালে বাঙ্গালি সৈন্যরা যতটা সম্ভব অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে ছাউনী থেকে বেরিয়ে যান এবং যুদ্ধ চালাতে থাকেন। সারা রাত ধরে যুদ্ধ চলার পরদিন সকাল থেকে তা গোটা জয়দেবপুর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। দুপুরের পর গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় বাঙ্গালি সৈন্যরা যুদ্ধ বন্ধ করেন। এদিনের যুদ্ধে ১২ থেকে ২০ জন বাঙ্গালি সৈন্য নিহত ও আরো অনেক সৈন্য আহত হয়। ছোট আকারে হলেও এই বিদ্রোহ সেদিন ১৮৫৭ সালের ৭ই মে সূচিত সিপাহী বিদ্রোহের কথাই মনে করিয়ে দেয়। তবে ১৯ মার্চের সিপাহী বিদ্রোহের বিবরণ এখনো লিপিবদ্ধ হয়নি। অবশ্য স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এই দিনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তৎকালীন ১৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টের উদ্যোগে ঢাকা-ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও গাজীপুর সড়কের মিলনস্থল চান্দনা চৌরাস্তায় স্মারক ভাস্কর্য ‘জাগ্রত বাঙ্গালী’ নির্মাণ করা হয়। এতে দেখানো হয়েছে একজন মুক্তিযোদ্ধার এক হাতে রাইফেল আর অন্য হাতে গ্রেনেড। এই ভাস্কর্যটি এখনো দূর-দূরান্তের লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। জয়দেবপুরের গুলীবর্ষণের খবর ঢাকা শহরে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আমজনতা লাঠি-সোটা নিয়ে আকাশ-মাটি বিদীর্ণ করা শ্লোগানে রাজপথে নেমে আসে। সন্ধ্যা নাগাদ বহু মিছিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে আসে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সামরিক জান্তার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘ভুল, এটা ভুল, জাগ্রত বাঙ্গালি জাতিকে বুলেট বেয়নেট দিয়ে দাবিয়ে রাখা যাবে না।’ তিনি সাংবাদিকদের বললেন, ‘আপনারা নিজেরাই দেখুন। আমার শ্যামল সবুজ সোনার বাংলা কিভাবে শ্মশান হচ্ছে। জান্তার গণতন্ত্রের নমুনা দেখুন।’