হলুদ রঙের নান্দনিক একটি ফুল সূর্যমুখী। দেখতে সূর্যের মত এবং সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে, তাই ফুলকে সূর্যমুখী বলে। সূর্যমুখী থেকে তৈরি তেলও পুষ্টিগুণ সম্পূর্ণ। বিশ্বেজুড়েই সূর্যমুখী তেলের চাহিদা এখন ব্যাপক। আমাদের দেশেও ক্রমশ চাহিদা বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন জেলায় বাণিজ্যিকভাবে সূর্যমুখীর চাষ শুরু হয়েছে। পুষ্টিবিদদের মতে, সূর্যমুখীর তেলে কোলেস্টেরলের মাত্রা খুবই কম এবং হৃদরোগীদের জন্য বেশ কার্যকর। এতে রয়েছে ভিটামিন এ, ডি এবং ই। এই তেল শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
বাসস জেলা প্রতিনিধিদের সহযোগিতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে সূর্যমুখী চাষের চিত্রটুকু তুলে ধরার প্রয়াসে ‘দেশজুড়ে বাড়ছে সূর্যমুখীর আবাদ’ শীর্ষক ধারাবাহিক প্রতিবেদন তুলে ধরা হচ্ছে। আজ থাকছে কুড়িগ্রাম জেলায় সূর্যমুখী চাষের চিত্র-
কুড়িগ্রামে ধরলার চরে সূর্যমূখীর হাসি। ধরলার চর মাধবরাম। গত বন্যায় এই গ্রামের পুরোটাই ডুবেছিলো থৈ-থৈ পানিতে। উজানে জগমোহনের চরে ছিলো প্রলয়ঙ্করী ভাঙন। তাই বালুপড়ে অনাবাদী হয়েছে এই চরের শত-শত একর জমি। এবার সেই বালুকাময় জমিতে সূর্যমুখীর হাসি দেখে বুক ভরে গেছে কৃষকের। সারি-সারি হৃষ্টপুষ্ট সূর্যমুখী গাছের ডগায় বড়-বড় আকারের ফুল। যেন দিগন্তজুড়ে হলুদের উৎসব।
স্থানীয় কৃষি বিভাগ আশা করছে, কুড়িগ্রামের চর ভূমিতে সুর্যমুখী চাষ সম্প্রসারণ করে চরের কৃষকের ভাগ্য বদলে যাবে। সেই সঙ্গে বদলে যাবে অনুন্নত এই জেলার অর্থনৈতিক চিত্র।
কৃষি বিভাগ সুত্রে জানা গেছে, কুড়িগ্রামে রয়েছে ১৬টি নদ-নদী আর ৫ শতাধিক চর। এই চরের পতিত জমিতে সূর্যমূখী চাষ করে সাফল্য পাচ্ছে চাষীরা। বাড়ছে আবাদ। এতে করে একদিকে যেমন আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে পতিত অনাবাদি জমিকে কাজে লাগিয়ে লাভবান হচ্ছে কৃষক। গতবছর জেলায় ২০ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখীর আবাদ হলেও এবার আবাদ হয়েছে ২০০ হেক্টর জমিতে। প্রতি হেক্টরে ২ টন সূর্যমূখী তেলবীজ উৎপাদন হয়। বর্তমানে প্রতি কেজি বীজের দাম ৮০ টাকা। সে হিসেবে এবার জেলায় কমপক্ষে ৩২ কোটি টাকার সুর্যমুখীর তেলবীজ বিক্রি হবে। দাম বাড়লে এই অংক আরো বাড়বে।
কৃষকরা জানান, প্রতি হেক্টর জমিতে উৎপাদন খরচ পড়ে ৫০-৬০ হাজার টাকা। আর বিক্রি হয় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার তৈলবীজ। নভেম্বরে বীজ বোনার পর মার্চে ফসল ঘরে ওঠে। তারা জানান, সূর্যমূখী থেকে পাখির খাবারের পাশাপাশি কোলস্টরেল মুক্ত তেল উৎপাদন করে ক্ষতিকর পামওয়েল ও সয়াবিন এর স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে রেহাই পাবেন ভোক্তারা। আর সুর্যমুখীর গাছে চাহিদা মিটছে জ্বালানির। ইতিমধ্যে ভালো মার্কেটিং-এর সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় সূর্যমূখী চাষ করে হাসি ফুটেছে কৃষকের মুখে।
কুড়িগ্রাম পুরাতন হাসপাতাল পাড়ার কৃষক আবু বক্কর সিদ্দিক সদর উপজেলার চর মাধবরামে গত দু’বছর ধরে চরের জমিবিঘা প্রতি ৫-৬ হাজার টাকায় লিজ নিয়ে সূর্যমূখির চাষ করেছেন। গতবছর ২১ বিঘা জমিতে আবাদ করে এক লাখ টাকা লাভ করেছেন। এবার ৫০ বিঘা জমিতে আবাদ করেছেন সূর্যমুখী। খরচ পড়েছে ৪ লাখ টাকা। প্রায় সব গাছে ফুল ধরেছে। ক্ষেতের অবস্থা দেখে এবং এবছর বাজার ভালো থাকায় উৎপাদন খরচের তিনগুণ টাকা লাভের আশা করছেন। তার সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে এলাকার অনেক কৃষক ঝুঁকে পড়েছেন সুর্যমুখী চাষের দিকে। এদের একজন লালমিয়া। তিনি জানান, চরের জমিতে সূর্যমুখীর ভালো ফলন দেখে তারাও উপজেলা কৃষি অফিসের সহায়তায় চাষ করেছেন সুর্যমূখীর। ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলে বাণিজ্যিকভিত্তিতে সুর্যমুখীর চাষ বাড়বে বলে জানান কৃষকরা।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার কৃষি অফিসার মো. জাকির হোসেন জানান, সদর উপজেলার ২০ একর জমিতে এবছর সূর্যমুখীর চাষকরেছেন চাষীরা। কৃষি বিভাগ থেকে তাদের বীজ সহায়তা দেয়া হয়েছে।
কৃষি বিভাগের কর্মকর্তার াজানান, বন্যার পর চর এলাকার বালুকাময় অনেক জমি পতিত থাকে। ফসল চাষের চেষ্টা করে লাভবান না হয়ে উল্টো ক্ষতিরমুখে পড়ে চাষীরা। এসব জমিতে সূর্যমুখী চাষ করে ভালো ফলন পাওয়া যাচ্ছে। তাই আগামীতে জেলার চরা লের পতিত জমি গুলোকে চাষের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে কৃষি বিভাগের।
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মঞ্জুরুল হক জানান, জেলার ৪৬ হাজার চরভূমির বেশির ভাগে সুর্যমুখী চাষের অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। জেলার দারিদ্র্য বিমোচনে সূর্যমুখী চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ রংপুর অ লের অতিরিক্ত পরিচালক খন্দকার আব্দুল ওয়াহেদ জানান, রংপুর অ লে এবার ১ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে সুর্যমুখীর চাষ হয়েছে। যা গতবছরের চেয়ে চারগুণ বেশি। বর্তমানে দেশে ভোজ্যতেলের দাম অনেক বেড়ে গেছে। সরিষা চাষে সময় মেলানো কঠিন হয়, ফলনও কম। সরিষার চেয়ে সুর্যমুখীর বাজারও ভালো। ভালো মাকের্টিং করতে পারলে এবং উদ্যোক্তরা তেল উৎপাদনে এগিয়ে আসলে সূর্যমুখী তেল দিয়েই দেশের ভোজ্যতেলের চাহিদা অনেকাংশে মেটানো সম্ভব।