মহামারি করোনা নিয়ন্ত্রণে ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করেছে সরকার। এরপরও প্রাদুর্ভাব থামাতে ৭ দিনের লকডাউনে যাচ্ছে দেশ। কিন্তু দেশের একটি বড় অংশ দিন আনে দিন খায়। তারা বলছেন, করোনাভাইরাস বিপজ্জনক কিন্তু লকডাউনের কারণে জীবন-জীবিকার শঙ্কায় ভুগছেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ।
।এর আগে শনিবার (৩ এপ্রিল) সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আগামী ৫ এপ্রিল, সোমবার থেকে সাতদিনের জন্য লকডাউনের ঘোষণা আসতে পারে।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আজ রোববার জানানো হবে। এছাড়া লকডাউনের ব্যাপ্তি কী হবে, কী কী খোলা থাকবে আর কী কী বন্ধ থাকবে- সে বিষয়েও বিস্তারিত জানানো হবে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এক ভিডিও বার্তায় লাকডাউন প্রসঙ্গে বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধের স্বার্থে সরকার দু-তিনদিনের মধ্যে সারা দেশে এক সপ্তাহের লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে লকডাউন চলাকালে শুধু জরুরি সেবা দেয় এমন প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। আর শিল্প-কলকারখানা খোলা থাকবে, যাতে শ্রমিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিভিন্ন শিফটে কাজ করতে পারে।
লকডাউনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ১২ দিনের সম্পূর্ণ লকডাউনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকার বলেছে প্রথম এক সপ্তাহ হবে। পরিস্থিতি দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তিনি বলেন, লকডাউনকালে অত্যাবশ্যকীয় সেবা ছাড়া সবকিছু বন্ধ থাকবে। সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ঘরের বাইরে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। এছাড়া গণপরিবহন, দূরপাল্লার বাস, ল , বিমান ও ট্রেন চলবে কি না, সে বিষয়ে রাতেই (শনিবার) নির্দেশনা তৈরি হবে, যা রোববার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানানো হতে পারে। লকডাউন চললে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও হাসপাতালে স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক ও নার্সের ছুটি আপাতত স্থগিত থাকবে।
যদিও স্ব স্ব মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও কর্তৃপক্ষ সরকারি প্রজ্ঞাপনের আগেই ল , ট্রেন ও অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইট বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে।
সরকারের এমন সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয় বাংলাদেশ জার্নালের পক্ষ থেকে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি হোটেলে কাজ করেন সেলিম হোসেন। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে ঢাকায় এসে এখানে কাজ নিয়েছি। সামনে রমজান ও ঈদ। কিছু টাকা উপার্জন করে পরিবারের কাছে ফিরতে চেয়েছিলাম। লকডাউনের কারণে এখন কিছুই মাথায় আসছে না। সংসার চালাব কীভাবে?
গাবতলী বাস টার্মিনালের ব্যবসায়ী মকবুল বলেন, গতবছর লকডাউনের কারণে ১০ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। বছর পার না হতেই আবার লকডাউন। এবার পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তবে সরকারের উচিত রমজানের আগে লকডাউন শেষ করা।
রায়েরবাজার এলাকার রিকশা চালক জাহেরুল ইসলাম বলেন, লকডাউন দিলেতো আমাদের কিছুই করার নেই। তবে সরকারের উচিত আমাদের কথা ভেবে বিকল্প উপায়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা। নয়তো বাড়িতে ছেলে-মেয়ে না খেয়ে থাকবে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা তোহিদ রহমান নামে একজন বলেন, লকডাউন দেয়ার দরকার ছিলো আরো ১৫ দিন আগে। করোনাতো এখন বাড়েনি এটা অনেক আগেই বেড়েছে। তখন দিলে পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে থাকত। সামনে রমজান ও ঈদ। করোনার পরিস্থিতি থেকেও ভয়াবহ পরিবার-পরিজনকে নিয়ে না খেয়ে থাকা।
এদিকে, লকডাউনের খবরে জীবিকা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেলের চালকরা। তারা বলছেন, দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রতিরোধে গত ৩১ মার্চ সরকার ১৮টি নতুন নির্দেশনা দেয়। নির্দেশনার পরপরই সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বি আরটিএ) অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা বন্ধ করে দেয় দুই সপ্তাহের জন্য। রাইড শেয়ারিং বন্ধ করে দিলেও খ্যাপ (যাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে) মারতেন তারা। এতে ট্রাফিক পুলিশ বাধা দিলেও কোনোমতে দিন চলে যাচ্ছিল তাদের। কিন্তু এখন লকডাউন ঘোষণার পর এ ব্যবস্থাও বন্ধ হওয়ার পথে। আগামী দিনগুলোতে কীভাবে সংসার চালাবেন, তা নিয়ে চিন্তিত তারা।
অন্যদিকে আবার সরকারের পক্ষ থেকে জারি করা ১৮ দফায় সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সরেজমিনে দেখা গেছে রাজধানীর অনেক এলাকায় তা উপেক্ষিত হচ্ছে। হাট-বাজার, মার্কেট ও শপিংমলে যেন স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। অনেকে মাস্ক ব্যবহার করছেন না। সামাজিক দূরত্ব, সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করা নিশ্চিত করা যায়নি। গণজমায়েত নিষিদ্ধ থাকলেও সেটাও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে উপেক্ষিত হচ্ছে। গত শনিবার রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম। কিছু সময় পরপর মাইকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে আহ্বান জানানো হচ্ছে। কিন্তু তোয়াক্কা করছেন না কেউ। অনেকের মাস্ক নেমে এসেছে থুতনির নিচে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছেন না কেউই।
নিউ মার্কেটের কাঁচা বাজারে আসা ক্রেতাদের অনেকের মুখে মাস্ক থাকলেও বিক্রেতাদের মুখে ছিল না মাস্ক। মুখে মাস্ক না থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করলে সবজি বিক্রেতা শাহিন আলম বলেন, মাস্ক পরে গরমের মধ্যে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। ক্রেতাদের সঙ্গে সবজির দরদাম করতে হয়। বাধ্য হয়ে মাস্ক খুলে বসতে হয়েছে।
লকডাউন ঘোষণার পরপরই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। মূলত শনিবার দুপুর ১২ টার দিকে লকডাউনের সিদ্ধান্ত আসার পর দুপুর ২ টার পর থেকে বাজারে ভিড় বাড়তে থাকে। বেশির ভাগ মানুষ সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য-চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ ও আলু কিনছিলেন। কেউ কেউ আবার একসঙ্গে বাড়তি পরিমাণ পণ্য কিনে ঘরে ফিরছেন। অনেকেই আবার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মজুদ শুরু করেছেন। নগরীর শপিংমলগুলোতেও লোকজনের প্রচন্ড ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। লকডাউনের খবরে ঈদের কেনাকাটাও সেরেছেন কেউ কেউ। ব্যবসায়ীরা জানান, এই দুপুরে সাধারণত এমন ভিড় দেখা যায় না। লকডাউনের খবর শুনেই হয়তো ক্রেতারা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে বাজারে আসছেন।
ক্রেতারা বলছেন, লকডাউনের খবর শোনার পর রোজার বাজার করতে এসেছি। লকডাউন কত দিন থাকবে, সেতো আর বলা যাচ্ছে না। এছাড়া করোনার মাঝে বাজারে যত কম আসতে হয় ততই ভালো। তাই রমজানের বাজারসহ যতটুকু সম্ভব বাজার করলাম। এর আগে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন লকডাউনে কী খোলা ও বন্ধ থাকবে সে ব্যাপারে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, জরুরি সেবার প্রতিষ্ঠান, কাঁচাবাজার, ওষুধ ও খাবারের দোকানের পাশাপাশি পোশাক এবং অন্যান্য শিল্পকারখানা লকডাউনের আওতামুক্ত থাকবে। তিনি বলেন, আমরা চাচ্ছি লকডাউনে মানুষের চলাচল যতটা সম্ভব বন্ধ করার। কারণ, যেভাবে করোনা ছড়াচ্ছে তাতে মানুষের ঘরে থাকা জরুরি। তবে জরুরি সেবার প্রতিষ্ঠান, কাঁচাবাজার, খাবার ও ওষুধের দোকান লকডাউনের আওতামুক্ত থাকবে। এছাড়া পোশাক ও শিল্পকারখানাগুলো খোলা থাকবে। কারণ, কারখানা বন্ধ হলে শ্রমিকদের বাড়িতে ফেরার তাড়া থাকে। এতে করোনার ঝুঁকি আরো বাড়ে। কারখানায় শ্রমিকদের একাধিক শিফটে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করতে বলা হবে।