যুগে যুগে ঐক্যবদ্ধতার ফলাফল বিজয়। মুসলিম ঐক্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা রাসূল সা: বলে গেছেন। ঐক্যের ব্যাপারে কঠিন নির্দেশনা কুরআনেও বারবার এসেছে। কোনো জাতির ভেতরে শত্রুর আগমন তখনই সম্ভব হয় যখন সেই জাতি দলছুট হয়ে ঐক্যবদ্ধ বন্ধন থেকে দূরে চলে যায়।
দলবদ্ধতার সুফল এটাই যে, সব ধরনের হিংস্র আক্রমণ থেকে নিজের জাতিকে রক্ষা করা যায়। আর আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রশিকে (ধর্ম বা কুরআন) শক্ত করে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো; তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করলেন। ফলে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকুণ্ডের (দোজখের) প্রান্তে ছিলে, অতঃপর তিনি (আল্লাহ) তা থেকে তোমাদের উদ্ধার করেছেন। এরূপে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর নিদর্শন স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন, যাতে তোমরা সৎপথ পেতে পারো’ (সূরা ইমরান-১০৩)।
আল্লাহকে ভয় করার কথা বলার পর ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রশিকে শক্ত করে ধরো’ এর আদেশ দিয়ে এ কথা পরিষ্কার করে দিলেন যে, মুক্তিও রয়েছে এই দুই মূল নীতির মধ্যে এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে এই মূল নীতিরই ভিত্তিতে। ‘পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ এর মাধ্যমে দলে দলে বিভক্ত হওয়া থেকে নিষেধ করা হয়েছে। উল্লিখিত দুটি মূল নীতি থেকে যদি তোমরা বিচ্যুত হয়ে পড়ো, তাহলে তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং ভিন্ন ভিন্ন দলে তোমরা বিভক্ত হয়ে যাবে। বর্তমানে দলে দলে বিভক্ত হওয়ার দৃশ্য আমাদের সামনেই রয়েছে। কুরআন ও হাদিস বোঝার এবং তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ নিয়ে পারস্পরিক কিছু মতপার্থক্য থাকলেও তা কিন্তু দলে দলে বিভক্ত হওয়ার কারণ নয়। এ ধরনের বিরোধ তো সাহাবি ও তাবেইনদের যুগেও ছিল, কিন্তু তারা ফির্কাবন্দী সৃষ্টি করেননি এবং দলে দলে বিভক্ত হয়েও যাননি। কারণ, তাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও সবার আনুগত্য ও আকিদার মূল কেন্দ্র ছিল একটাই। আর তা হলো- কুরআন এবং হাদিসে রাসূল সা:। কিন্তু যখন ব্যক্তিত্বের নামে চিন্তা ও গবেষণা কেন্দ্রের আবির্ভাব ঘটল, তখন আনুগত্য ও আকিদার মূল কেন্দ্র পরিবর্তন হয়ে গেল। আপন আপন ব্যক্তিরা এবং তাদের উক্তি ও মন্তব্যগুলো প্রথম স্থান দখল করল এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উক্তিগুলো দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী হলো। আর এখান থেকেই মুসলিম উম্মাহর মাঝে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা শুরু হলো; যা দিনে দিনে বাড়তেই লাগল এবং বড় শক্তভাবে বদ্ধমূল হয়ে গেল। এই অবাধ্যতা এবং বিচ্ছিন্নতা আল্লাহর পক্ষ থেকে আজাবেরই লক্ষণ। কারণ আল্লাহ এই আজাব দেয়ার কথা কুরআনে বলে দিয়েছেন, ‘বলুন তোমাদের ওপর থেকে বা নিচ থেকে শাস্তি পাঠাতে বা তোমাদেরকে বিভিন্ন সন্দেহপূর্ণ দলে বিভক্ত করতে বা এক দলকে অন্য দলের সংঘর্ষের আস্বাদ গ্রহণ করাতে তিনি (আল্লাহ) সক্ষম। ‘দেখুন, আমরা কিরূপে বিভিন্নভাবে আয়াতসমূহ বিবৃত করি যাতে তারা ভালোভাবে বুঝতে পারে’ (সূরা আনআম-৬৫)।
এখানে তৃতীয় প্রকার আজাব হচ্ছে- বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে যাওয়া এবং একদল অন্য দলের জন্য আজাব হওয়া। তাই আয়াতের অনুবাদ হবে, এক প্রকার আজাব এই যে, জাতি বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পরস্পর মুখোমুখি হয়ে যাবে। এ কারণে এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসূল সা: বলেন, ‘সাবধান! তোমরা আমার পরে পুনরায় কাফের হয়ে যেও না যে, একে অন্যের গর্দান মারতে শুরু করবে’ (বুখারি-১২১)। সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস বলেন, ‘একবার আমরা রাসূল সা:-এর সাথে চলতে চলতে বনি মুয়াবিয়ার মসজিদে প্রবেশ করে দুই রাকাত সালাত আদায় করলাম। তিনি তার রবের কাছে অনেক্ষণ দোয়া করার পর বললেন, ‘আমি রবের কাছে তিনটি বিষয় প্রার্থনা করেছিÑ তিনি আমাকে দুটি বিষয় দিয়েছেন, আর একটি থেকে নিষেধ করেছেন। আমি প্রার্থনা করেছি যে- এক. আমার উম্মতকে যেন দুর্ভিক্ষ আর ক্ষুধা দিয়ে ধ্বংস করা না হয়, আল্লাহ এই দোয়া কবুল করেছেন। দুই. আমার উম্মতকে যেন নিমজ্জিত করে ধ্বংস করা না হয়। আল্লাহ এ দোয়াও কবুল করেছেন। তিন. আমার উম্মত যেন পারস্পরিক দ্বন্দ্ব দ্বারা ধ্বংস না হয়। আমাকে তা প্রদান করতে নিষেধ করেছেন’ (মুসলিম-২৮৯০)।
এসব হাদিস থেকে প্রমাণিত হয়, উম্মতে মুহাম্মদির ওপর বিগত উম্মতদের মতো আকাশ বা ভূতল থেকে কোনো ব্যাপক আজাব আসবে না; কিন্তু একটি আজাব দুনিয়াতে তাদের ওপরও আসতে থাকবে। এ আজাব হচ্ছে পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহ। তিনি প্রতি ক্ষেত্রেই হুঁশিয়ার করেছেন যে, দুনিয়াতে যদি তোমাদের ওপর আল্লাহর শাস্তি নেমে আসে, তবে তা পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহের মাধ্যমেই আসবে। অন্য আয়াতে এ বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে, তারা সর্বদায় পরস্পরে মতবিরোধই করতে থাকবে, তবে যাদের প্রতি তোমার প্রতিপালক দয়া করেন তারা নয়, আর এ জন্যই তিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং ‘আমি জিন ও মানুষ দিয়ে জাহান্নাম পূর্ণ করবই’ তোমার প্রতিপালকের এই বাণী পূর্ণ হবেই (সূরা হুদ : ১১৮-১১৮)।
অর্থাৎ, যারা অন্যায়ভাবে যুদ্ধে বা বিরোধে লিপ্ত তারা জাহান্নামে যাবে। আর যারা আল্লাহর রহমত বা দয়াপ্রাপ্ত তারা অন্যায় যুদ্ধ থেকে মুক্ত। যেমন হাদিসে বর্ণিত হয়েছেÑ নবী সা: বলেছেন, ‘জান্নাত ও জাহান্নাম একদা আপসে ঝগড়া আরম্ভ করল; জান্নাত বলল, কি ব্যাপার আমার মাঝে কেবল তারাই আসবে, যারা দুর্বল ও সমাজের নি¤œস্তরের লোক? জাহান্নাম বলল, আমার ভেতরে তো বড় বড় পরাক্রমশালী ও অহঙ্কারী মানুষেরা থাকবে। ‘আল্লাহ তায়ালা জান্নাতকে বললেন, ‘তুমি আমার রহমত, তোমার দ্বারা আমি যাকে চাইব, রহম করব।’ আর জাহান্নামকে বললেন, ‘তুমি আমার শাস্তি, তোমার দ্বারা আমি যাকে চাইব, শাস্তি দেবো। ‘আল্লাহ তায়ালা জান্নাত ও জাহান্নাম উভয়কে পরিপূর্ণ করবেন। জান্নাতে সর্বদায় তাঁর অনুগ্রহ ও দয়া থাকবে। জান্নাত খালি থাকলে পরিশেষে আল্লাহ তায়ালা এমন সৃষ্টি সৃজন করবেন যারা জান্নাতের অবশিষ্ট স্থানে বসবাস করবে। আর জাহান্নাম, জাহান্নামীদের সংখ্যাধিক্য সত্ত্বেও যখন আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, ‘তুমি পরিপূর্ণ হয়েছ কি?’ তখন জাহান্নাম ‘আরো আছে কি?’ বলে আওয়াজ দেবে। পরিশেষে আল্লাহ তায়ালা তাতে নিজ পা রেখে দেবেন, যার ফলে জাহান্নাম ‘বাস! বাস! তোমার মর্যাদার কসম!’ বলে আওয়াজ দেবে (বুখারি)। লেখিকা : গবেষক