করোনা সংক্রমণ রোধে জারি করা ‘কঠোর বিধিনিষেধ‘ মানার দ্বিতীয় দিন গতকাল মঙ্গলবার (৬ এপ্রিল)। সোমবার থেকে শুরু হওয়া লকডাউনের প্রথম দিনে নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে বেশকিছু অবহেলা দেখা যায়। এদিন মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে কঠোর হতে নির্দেশ দেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. শাফায়াত মাহবুব চৌধুরী স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে উল্লেখিত নির্দেশনায় যা করা যাবে, আবার যা করা যাবে না তাহলো- এই সাত দিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কোনোভাবেই ঘরের বাইরে থাকা যাবে না। অবশ্যই এসময় ঘরে অবস্থান করতে হবে। ওষুধসহ খুব প্রয়োজনীয় জিনিস না কিনতে ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না।
প্রজ্ঞাপনে দেওয়া নির্দেশনাগুলো হলো: ১. সব ধরনের গণপরিবহন (সড়ক, নৌ, রেল ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট) বন্ধ থাকবে। তবে, পণ্য পরিবহন, উৎপাদন ব্যবস্থা, জরুরি সেবাদানের ক্ষেত্রে এই আদেশ প্রযোজ্য হবে না। এছাড়া, বিদেশগামী/বিদেশ প্রত্যাগত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না।
২. আইনশৃঙ্খলা ও জরুরি পরিষেবা যেমন-ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দরসমূহের (স্থলবন্দর, নদীবন্দর ও সমুদ্র) কার্যক্রম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট, ডাক সেবাসহ অন্যান্য জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসসমূহ, তাদের কর্মচারী ও যানবাহন এ নিষেধাজ্ঞার আওতা বহির্ভূত থাকবে।
৩. সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অফিস ও আদালত এবং বেসরকারি অফিস কেবল জরুরি কাজ সম্পাদনের জন্য সীমিত পরিসরে প্রয়োজনীয় জনবলকে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় অফিসে আনা-নেওয়া করতে পারবে। শিল্প-কারখানা ও নির্মাণ কার্যাদি চালু থাকবে। শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় আনা-নেওয়া করতে হবে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ কর্তৃক শিল্প-কারখানা এলাকায় নিকটবর্তী সুবিধাজনক স্থানে তাদেরশ্রমিকদের জন্য ফিল্ড হাসপাতাল/চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া (ওষুধ ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চিকিৎসা সেবা, মৃতদেহদাফন/সৎকার ইত্যাদি) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। খাবারের দোকান ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় কেবল খাবার বিক্রি বা সরবরাহ করা যাবে। কোনও অবস্থাতেই হোটেল-রেস্তোরাঁয় বসে খাবার গ্রহণ করা যাবে না।
৫. শপিং মলসহ অন্যান্য দোকান বন্ধ থাকবে। তবে দোকানে পাইকারি ও খুচরা পণ্য অনলাইনের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই সর্বাবস্থায় কর্মচারীদের মধ্যে আবশ্যিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কোনও ক্রেতা সশরীরে যেতে পারবে না।
৬. কাঁচাবাজার এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। বাজার কর্তৃপক্ষ/স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
৭. ব্যাংকিং ব্যবস্থা সীমিত পরিসরে চালু রাখার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে।
৮. সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ঢাকায় সুবিধাজনক স্থানে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
৯. সারাদেশে জেলা ও মাঠ প্রশাসন উল্লিখিত নির্দেশনা বাস্তবায়নের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীনিয়মিত টহল জোরদার করবে।
১০. এই আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
‘দিনে না হলেও’ রাতে পালিত হচ্ছে লকডাউন: সরকার ঘোষিত লকডাউনের প্রথম দিন গতকাল সোমবার (৫ এপ্রিল) পালিত হয়েছে। রাজধানীতে দিনের বেলায় লকডাউন কতটুকু পালিত হয়েছে তা নিয়ে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে নানা প্রশ্ন, আলোচনা এবং সমালোচনা থাকলেও রাতের বেলায় লকডাউন সঠিকভাবেই পালিত হতে দেখা গেছে।
সন্ধ্যা হতেই পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে রাজপথে মানুষের উপস্থিতি ক্রমেই কমতে থাকে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে রিকশাচালকরা যাত্রীর খোঁজে দাঁড়িয়ে থাকলেও যাত্রী সংখ্যা ছিল খুবই কম। রাতের রাজপথে সুনসান নীরবতা বিরাজ করে। বড় বড় মালবাহী ট্রাক, পিকআপ ভ্যান, অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেটকার এবং মোটরসাইকেল চালকদের ফাঁকা রাজপথে দ্রুতবেগে গন্তব্যে ছুটতে দেখা যায়। চলতি বছরের গত তিন মাসে রাজধানী ঢাকার রাস্তাঘাটে এমন নীরবতা আর দেখা যায়নি। গত সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত রাজধানীর লালবাগ, ধানমন্ডি, রমনা, কলাবাগান এবং নিউমার্কেট থানা এলাকার বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা ও রাজপথ ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, পাড়া-মহল্লার ছোট-বড় দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। পাড়া-মহল্লা ও প্রধান সড়কের কোথাও কোথাও ভ্যানগাড়িতে করে শাকসবজি ও ফলমূল বিক্রেতারা দাঁড়িয়ে থাকলেও ক্রেতা না থাকায় বেচাকেনা হচ্ছে না। রাতের বেলায় কোনো ধরনের গণপরিবহনও দেখা যায়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও বারডেম দুটি হাসপাতাল থাকার কারণে শাহবাগ মোড়ে দিন-রাতের যেকোনো সময় অসংখ্য মানুষের উপস্থিতি থাকলেও আজ রাতে তা দেখা যায়নি। দিনের বেলায় বিভিন্ন রাস্তায় পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলার কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি দেখা গেলেও রাতে উপস্থিতি ছিল খুবই কম। পুরান ঢাকার লালবাগ ও আশপাশ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, হোটেল ও বেকারিসহ ফাস্ট ফুডের সব দোকান বন্ধ। এলাকাবাসী জানিয়েছে, বিকেল থেকেই পুলিশ এসে সন্ধ্যার আগেই দোকানপাট বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে গেছে। এ কারণে সবাই দোকানপাট বন্ধ করে দেন।
নিউমার্কেট, গাউছিয়া, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, এলিফ্যান্ট রোড, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটে দিনভর লকডাউনের বিরোধিতা করে মালিক কর্মচারীরা বিক্ষোভ করলেও রাতের বেলায় সেখানে তাদের কাউকে দেখা যায়নি। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মার্কেট এলাকায় মার্কেটের নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষীরা ছাড়াও পুলিশ সদস্যদের টহল দিতে দেখা গেছে।