শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০১:২০ পূর্বাহ্ন

গিবত নিন্দনীয় ও মুহাসাবা প্রশংসনীয়

আমিনুর রহমান হাসান:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৮ এপ্রিল, ২০২১

‘গিবত’ ও ‘মুহাসাবা’ দু’টোই আরবি শব্দ। গিবত অর্থ- সমালোচনা বা পরনিন্দা এবং মুহাসাবা অর্থ- আত্মসমালোচনা। গিবতের কারণে মানুষ নিন্দনীয় ও গোনাহগার হয় এবং আত্মসমালোচনার মাধ্যমে মানুষ প্রশংসনীয় হয়। আমাদের সমাজে গিবত যেন এক মহামারী রূপ ধারণ করেছে। গিবত যে কবিরা গোনাহ সেটা আমরা মনেই করি না। আল্লাহ তায়ালা সূরা হুজুরাতের ১২ নং আয়াতে ঘোষণা করেন- ‘তোমরা পরস্পরের গিবত করো না। তোমাদের কেউ কি তাদের মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? কখনো না। আল্লাহকে ভয় করো, নিশ্চয় আল্লাহ তাওবা কবুলকারী ও পরম দয়ালু।’ সহিহুল মুসলিম গ্রন্থে হজরত আবু হুরায়রা রা:-এর সূত্রে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা কি জানো গিবত কী?’ সাহাবিরা বলেছিলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। নবী সা: বলেছিলেন, ‘তোমাদের ভাইয়ের এমন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা, যা সে অপছন্দ করে।’ নবী সা:কে আবার বলা হয়েছিল আমি যা বলি তা যদি তার মধ্যে থাকে? (অর্থাৎ আমরা যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করি, তা যদি তার মধ্যে পুরাটাই বিদ্যমান থাকে)? নবী সা: বলেছেন, ‘সে বিষয়টা যদি তার মধ্যে থাকে তাহলেই সেটা গিবত। আর যদি সে বিষয়টা না থাকে তাহলে তা হবে অপবাদ (বুহতান যা গিবতের চেয়েও জঘন্য)। আমাদের বর্তমান অবস্থা এমন যে, গিবত যে একটি বড় ধরনের কবিরা গোনাহ, তা আমাদের মনেই হয় না। কারণ গিবত চর্চায় আমরা বেশ পারদর্শী। আমরা সবচেয়ে বেশি মজা পাই অন্য কারো আলোচনা-সমালোচনা করতে।
হজরত মুআজ রা:-এর দীর্ঘ হাদিসে পাওয়া যায়, প্রতিদিন আমল লিপিবদ্ধকারী ফেরেশতা বান্দার নেক আমল নিয়ে যখন প্রথম আসমানে যান, তখন বান্দার নেক আমলগুলো চমকাতে থাকে! যখন দ্বিতীয় আসমানে নেয়া হয়, তখন দ্বিতীয় আসমানের ফেরেশতা বলেন, এই আমল আমলকারীর মুখে ছুড়ে মারো! কারণ সে মানুষের গিবত করে।’ (তাফাক্কুর অধ্যায়, তানবিহুল গাফিলিন) হজরত হাতেম আসাম্ম র. বর্ণনা করেন, গিবতকারী জাহান্নামে বানরে পরিণত হবে। গিবতে শয়তান খুশি হয়। একদিন হজরত ঈসা আ: ইবলিস শয়তানকে দেখতে পেলেন। তার এক হাতে মধু আর আরেক হাতে ছাই। তিনি এর কারণ জিজ্ঞেস করলে শয়তান বলে- এ ছাই আমি এতিমদের মুখে নিক্ষেপ করি, যাতে তাদের চেহারা বিশ্রী হয়ে যায় এবং মানুষ তাদের থেকে দূরে থাকে। আর মধু আমি গিবতকারীর মুখে ঢেলে দেই, যাতে তার মুখ রসে ভরে যায় এবং আরো বেশি গিবত করতে পারে। (নুজহাতুল মাজালিস) একবার হজরত শেখ সাদী র. তার পিতার পাশে বসে কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন এবং পাশে কিছু মানুষ ঘুমাচ্ছিলেন। শেখ সাদী বললেন, দেখো ওরা তিলাওয়াত বাদ দিয়া গুমাচ্ছে! তখন তার পিতা বললেন, তুমিও যদি তাদের মতো ঘুমে থাকতে তাহলে ভালো হতো, অন্তত গিবত করতে না। আহ (!) তাদের জীবন আর আমাদের জীবন কত ফারাক। আমরা নিজেদেরকে গিবতে ডুবিয়ে রেখেও বুঝি না আমরা যে গিবত করছি। যিনা, ব্যভিচারের মতো গিবতও হারাম। ইমাম কুরতুবি রহ. তাফসিরে কুরতুবিতে বলেন, গিবত হারাম। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, গিবত যিনা অপেক্ষা জঘন্য। কারণ যিনার গোনাহ আল্লাহ চাইলে মাফ করে দিতে পারেন কিন্তু গিবতের ক্ষেত্রে আল্লাহর নেজাম হলো, যার গিবত করা হয়েছে সে যদি ক্ষমা না করে তাহলে সে ক্ষমা পাবে না। তাই গিবতকে যিনা অপেক্ষা জঘন্য বলা হয়েছে। হাশরের ময়দানে আল্লাহ তায়ালা একদল জাহান্নামিকে ডেকে বলবেন, কিসে তোমাদেরকে জাহান্নামে এনেছে? তারা বলবে, ‘আমরা দুনিয়ায় থাকতে নামাজ পড়তাম না, এতিমদেরকে আহার করাতাম না এবং আমরা মানুষের গিবত করতাম।’ (সূরা মুদদাসসির-৪২)
যেসব অবস্থায় গিবত বৈধ : মুসলিম শরিফের ব্যাখ্যাকার ইমাম নববী রহ. বলেন, ছয় অবস্থায় গিবত করা জায়েজ তথা বৈধ- ১. অত্যাচারীর অত্যাচার থেকে রক্ষার জন্য অত্যাচারীর গিবত করা; ২. অপরাধীর অপরাধ নির্মূল হবে এমন কারো কাছে অপরাধীর অপরাধ বর্ণনা করা; ৩. ফতোয়া জানার জন্য গিবত করা; ৪. ঈমান বিধ্বংসকারী লোকের গিবত করা; ৫. যদি কারো নাম গিবতের মাধ্যমে প্রসিদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে তার গিবত করা। যেমন- অমুক কানা কোথায়!; ৬. যে ব্যক্তি নিজের দোষ নিজে বর্ণনা করে, তার গিবত করা। আর ‘মুহাসাবা’ তথা আত্মসমালোচনা হলো- নিজেকে শুধরানোর নিয়তে নিজের দোষ খোঁজা। হাদিসে আত্মসমালোচনাকারীকে প্রকৃত বুদ্ধিমান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে গিবত পরিহার ও আত্মসমালোচনা অর্জনের মাধ্যমে তার সন্তুষ্টি লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন। লেখক : আলেম ও প্রবন্ধকার




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com