পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা ইতিহাসবেত্তা, শেকড় সন্ধানী বাঙালি লেখক, শিক্ষাবিদ, বাগ্মী, ইসলামী চিন্তাবিদ গোলাম আহমদ মোর্তজা (১৯৩৫-২০২১) গত ১৫ এপ্রিল কলকাতার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তাকে পশ্চিমবঙ্গের লোকজন ‘জীবন্ত ইতিহাস’ বলে শ্রদ্ধার সাথে সম্বোধন করতেন। লেখক ও গবেষক হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন ভালো বক্তা। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাসহ আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যেও তিনি বিভিন্ন ইসলামী সম্মেলন ও ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য রাখতেন। ইতিহাসের অজানা তথ্য বর্ণনা করে শ্রোতাদেরকে সম্মোহিত করে রাখার অদ্ভুত পারঙ্গমতা ছিল তার। জনগণের কাছে ‘বক্তাসম্রাট’ উপাধি লাভ করেন তিনি। তার ইন্তেকালে ভারতে একজন ইতিহাসঅন্বেষী নিষ্ঠাবান লেখক-গবেষকের বর্ণাঢ্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটল। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বাংলাদেশেও সমানভাবে সমাদৃত ছিলেন প্রথিতযশা এই ইতিহাসবিদ। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা থেকে তার বহু গ্রন্থ বেরিয়েছে। এসব গ্রন্থ ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে।
১৯৩৫ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার মেমারিতে জন্মগ্রহণ করেন গোলাম আহমদ মোর্তজা। এই ইতিহাসবিদের বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। গ্রামের মাদরাসায় তিনি হিফজুল কুরআন সম্পন্ন করেন এবং মাদরাসায় পড়ালেখা করেন। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি তার ছিল না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, নিজের প্রচেষ্টায় তিনি মাতৃভাষা বাংলাসহ আরবি, ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় পারঙ্গমতা অর্জন করেন। দিনরাত অধ্যয়নে নিমগ্ন থাকতেন। ভারতবর্ষ নিয়ে লেখা এ দেশীয় ও ইংরেজ ইতিহাসবিদদের প্রতিটি গ্রন্থের বিষয়বস্তু ছিল তার নখদর্পণে। ইতিহাসের বাইরে সমাজ, রাজনীতি ও সাহিত্যবিষয়ক গ্রন্থাবলি ছিল তার অধীত। তার লিখিত গ্রন্থের পাতায় পাতায় অসংখ্য উদ্ধৃতি চোখে পড়ার মতো। তিনি তার বক্তব্যকে জোরালো ও দালিলিক করার জন্য প্রয়োজনীয় রেফারেন্স দিতে কার্পণ্য করেননি। প্রথাগত ইতিহাস রচনার পথ এড়িয়ে সমালোচনাধর্মী ও আসল সত্য বের করতে তিনি ছিলেন সচেষ্ট। যে ইতিহাসকে চাপা দেয়া হয়েছে অথবা যে ইতিহাস মানুষ ভুলে গেছে, তা পুনরাবিষ্কারে তার নিরলস প্রয়াস ও কৃতিত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। কঠোর অধ্যবসায় ও পরিশ্রম করে ২১টি মূল্যবান ঐতিহাসিক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। রাজনীতির ময়দান থেকে দূরে থেকে জ্ঞান গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত রাখাকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাকে এমপি ও মন্ত্রী হওয়ার অফার দিয়েছিল, কিন্তু এতে তিনি সম্মত হননি। ১৯৬৮ সালে নিজগ্রাম মেমারিতে জামিয়া ইসলামিয়া মদিনাতুল উলুম নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মীয় শিক্ষার সাথে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় এই মাদরাসার বৈশিষ্ট্য। কুরআন, হাদিস, ফিকহ, আরবি সাহিত্য ও ইতিহাসের পাশাপাশি সমাজ, ভূগোল, অর্থনীতি, পৌরনীতি, ইংরেজি, গণিত, জীববিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থ ও উচ্চতর গণিত শিক্ষা দেয়া হয় এতে। বর্তমানে দু’টি বিভাগে পাঠদান করা হয়, মানবিক ও বিজ্ঞান। এই মাদরাসা আলিগড় মুসলিম বিশ^বিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। এখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পাস করে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে আলিগড় বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ অবারিত। শিক্ষার্থীরা যাতে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে এজন্য মাদরাসায় রয়েছে সেলাই, কম্পিউটার ও পুস্তক বাঁধাই বিভাগ। চক্ষুপ্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে ব্রেইল পদ্ধতির শিক্ষাদান। এই মাদরাসায় আবাসিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক হাজার। গোলাম আহমদ মোর্তজা ছিলেন শিক্ষানুরাগী। ভারতের পিছিয়ে পড়া পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুসলমানদেরকে সুশিক্ষিত করার মহান প্রত্যয় নিয়ে তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। একটি মাদরাসা এবং একটি বালক ও অপরটি বালিকা বিদ্যালয়। ২০০৬ সালে মেমারি গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন মামুন ন্যাশনাল স্কুল। ২০১৫ সালে পানাহঘর এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন মামুন গার্লস স্কুল। স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য সালাত আদায় বাধ্যতামূলক। মাদরাসা ও স্কুলদ্বয়ে মানসম্মত পাঠদানের কারণে পুরো রাজ্যে প্রতিষ্ঠানত্রয়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। হিন্দু ও খ্রিষ্টান শিক্ষার্থীদেরও এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। গোলাম আহমদ মোর্তজা ইতিহাসের অনেক অজানা অধ্যায় বাংলাভাষী পাঠকদের সামনে তুলে ধরে শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হয়েছেন। তার লেখা গ্রন্থগুলোর মধ্যে- ১. চেপে রাখা ইতিহাস, ২. ইতিহাসের ইতিহাস, ৩. বজ্রকলম, ৪. পুস্তক সম্রাট, ৫. সৃষ্টির বিস্ময়, ৬. অনন্য জীবন, ৭. রক্তাক্ত ডায়েরি, ৮. রক্তমাখা ছন্দ, ৯. সেরা উপহার, ১০.বাজেয়াপ্ত ইতিহাস, ১১.বিভিন্ন চোখে স্বামী বিবেকানন্দ, ১২. এ এক অনন্য ইতিহাস, ১৩. জাল হাদিস, ১৪. ইতিহাসের এক বিস্ময়কর অধ্যায়, ১৫. ৪৮০টি হাদিস ও বিশ্বসমাজ, ১৬. এ সত্য গোপন কেন? ১৭. ধর্মের সহিংস ইতিহাস, ১৮. মুসাফির, ১৯. ভারতে মুসলিম গণহত্যা, ২০. মহানবী মুহাম্মদ সা: ও ২১. সিরাজুদ্দৌলার সত্য ইতিহাস ও রবীন্দ্রনাথ। ১৯৮১ সালে ইতিহাসের ইতিহাস গ্রন্থটি পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাজেয়াপ্ত করে দেয়। ২০০৪ সালে মাওলানা মুহিউদ্দিন খান তার নিজের প্রতিষ্ঠান ঢাকার মদিনা পাবলিকেশন্স থেকে গ্রন্থটি পুনঃপ্রকাশের ব্যবস্থা করে ছিলেন।
অনেক সময় ইতিহাসে ভেজাল থাকে। সত্যমিথ্যার সংমিশ্রণে ইতিহাসের আসল তথ্য চাপা পড়ে যায়। ক্ষমতাসীন সরকার তাদের নিজস্ব লোক দিয়ে ইতিহাস রচনা করান। ইতিহাসবিদের পক্ষে সঙ্গতকারণে সত্য ইতিহাস লেখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কলম ধরতে হয়। অনেকে নেতিবাচক দিকগুলো বাদ দিয়ে ইতিবাচক দিকগুলোকে হাইলাইট করে থাকেন। স্তুতির ফুলঝুরি দিয়ে ইতিহাসের ডালি সাজাতে গিয়ে বহু বানোয়াট ও কল্পিত ঘটনার আশ্রয় নেন। বিখ্যাতদের অখ্যাত করার এবং অখ্যাতদের বিখ্যাত করার ষড়যন্ত্র সব সময়ে চলেছে। এই ব্যুহ ভাঙা কঠিন; তবে দুঃসাধ্য নয়। ইতিহাসের পেছনেও ইতিহাস থাকে; তা খুঁজে বের করা যথেষ্ট আয়াসসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ। গোলাম আহমদ মোর্তজা উদ্ধৃতি সহযোগে ইতিহাসের অলিখিত সত্যকে বলিষ্ঠ প্রয়াসে তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। এটা ইতিহাসের নব মূল্যায়ন এবং জাতীয় গণমানস পুনর্গঠনে ইতিবাচক পদক্ষেপ।
‘আনন্দবাজার, যুগান্তর ও বসুমতির প্রশংসিত গ্রন্থ ‘বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস’-এর প্রথম খ-ে শ্রী ধনঞ্জয় দাস মজুমদার লিখেছেন, ‘ইংরাজগণ তখন শাসকজাতি ছিলেন। ভারতের আর্যগোষ্ঠীর বহির্ভূত প-িত ও ঐতিহাসিকগণের মধ্যে বাংলার ইংরাজের সংস্কৃতিতে অভিজাত ও বেতনভুক ঐতিহাসিক ও শাস্ত্রকারগণ তাদের ইচ্ছামতো শাস্ত্রগ্রন্থের বহু তালপত্র বদলাইয়া ইচ্ছামতো শ্লোক প্রক্ষিপ্ত করেন। আবার বহু তালপত্র ধ্বংস করিয়াছেন। এই শাসকগোষ্ঠীর ভারত শাসনের সুবিধার জন্য তারা হিন্দুশাস্ত্রের বহু তথ্য গোপন, বহু তথ্য বিকৃত এবং বহু তথ্য প্রক্ষিপ্ত করিয়া যে মিথ্যা ইতিহাস প্রস্তুত করিয়াছেন, তাহার বহু প্রমাণ দেওয়া হইয়াছে। বিভেদের সুযোগে ইংরাজ রাজত্ব চিরস্থায়ী করিতে চেষ্টা করেন। এই জন্য তারা তাদের নবাগত হিন্দুদিগকে এরূপ মিথ্যা ইতিহাস লিখিতে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন’ (শ্রী ধনঞ্জয় দাস মজুমদার, বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস, পৃ. ৬৬-৬৭)। সরকারি ইতিহাস ও বেসরকারি ইতিহাসের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। ক্ষমতাসীন দল বা সরকার নিজেদের মতো করে ইতিহাস সাজায়। নিজেদের স্বার্থকে বড় করে দেখায়। এগুলো স্কুল কলেজে পাঠ্যভুক্ত করে দেয়। সরকার পরিবর্তন হলে এগুলো আবার পাল্টে যায়। এ প্রসঙ্গে ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘ইহা কিছুতেই ভুলিলে চলিবে না, সরকারি ইতিহাস এবং প-িতসুলভ (অপধফবসরপ) ইতিহাসের মধ্যে আদর্শ, উদ্দেশ্য এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য থাকিবেই। সেজন্য বেসরকারি ইতিহাসের একটি বিশেষ দায়িত্ব হইল, সরকারি ইতিহাসের প্রকৃতির ওপর দৃষ্টি রাখা। ভারতের জাতীয়তাবাদী ইতিহাস, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিবৃত্তও নিরপেক্ষ গবেষণার কষ্টিপাথরে যাচাই হওয়া উচিত। হয়তো তাহার ফলে প্রচলিত কিছু অলীক ধারণা ধূলিস্যাৎ হইবে। ব্যক্তিবিশেষের প্রতিষ্ঠার বুনিয়াদ ভাঙ্গিয়া পড়িবে। তাহার ফলেই প্রমাণ হবে প্রকৃত ইতিহাস রচনার সার্থকতা। সা¤প্রতিককালে সরকারি নির্দেশ মতে সত্যকে এবং ইতিহাস রচনাশৈলীর মৌলনীতিকে জলাঞ্জলি দিয়া ইতিহাস রচনার প্রয়াসকে সমর্থন করা যায় না’ (ড. আর সি মজুমদার, ভারতে ইতিহাস রচনা প্রণালী, পৃ. ৬০৬১)।
গোলাম আহমদ মোর্তজা তার গ্রন্থাবলিতে ভারত উপমহাদেশে পীর আওলিয়াদের অবদান, আর্যদের ভারত আগমন, মারাঠা শক্তির উত্থান, শিবাজী, মুঘল সম্রাটগণ, দীনে ইলাহী, মহীয়সী জেবুন্নেসা, দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ, নবাব সিরাজুদ্দৌলার হত্যাকাহিনী, অন্ধকূপহত্যা, মীরজাফর, মীর কাশিম, জগৎশেঠ, নন্দকুমার, রাজবল্লভ, সিপাহি বিপ্লব, বঙ্কিম চন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, জওয়াহেরলাল নেহরু, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, অরবিন্দ ঘোষ, স্বামী বিবেকানন্দের বোধ-বিকৃতি, বহু অজানা তথ্য, গোপন রহস্য পাঠকের সামনে তুলে এনেছেন সফলতার সাথে। এ কাজ গোলাম আহমদ মোর্তজার আগে কেউ করেছেন কি না জানা নেই। তার গবেষণা, মন্তব্য ও বক্তব্য খ-ন করে জোরালো প্রমাণ দিয়ে কেউ কোনো গ্রন্থ রচনা করেননি। এখানেই তার সফলতা নিহিত। ভারতের প্রাচীন ইতিহাস ফার্সি ভাষায় লিখিত। মুসলমানদের আগমনের পর কয়েক শতাব্দী ভারতের রাষ্ট্রীয় ভাষা ছিল ফার্সি। ইংরেজরা ফার্সি শিখে এসব গ্রন্থ ইংরেজি ভাষায় তরজমা করেন এবং প্রয়োজনমাফিক বিকৃত করতে কুণ্ঠিত হননি। হিন্দু ইতিহাসবিদরা সেকেন্ডারি সোর্স ব্যবহার করে ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে এসব গ্রন্থের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। মূল ফার্সি গ্রন্থের সাথে মিলিয়ে দেখেননি তারা। ফলে মূল ইতিহাস চাপা পড়ে গেছে। সা¤প্রদায়িকতা ও সংখ্যালঘু বিদ্বেষ ভারতে ক্যান্সারের রূপ পরিগ্রহ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিপ্রাপ্তদের মনমস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে বা এখনো হচ্ছে যে, ভারতে মুসলমানরা বহিরাগত; তারা বিদেশী। অথচ মুসলমান জাতি যে বিদেশী নয়, এ কথা প্রায় সব ভারতীয় এবং বহির্ভারতীয় মনীষী স্বীকার করেছেন। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ভারত হিন্দুদের মতো মুসলমানদেরও জন্মভূমি এবং মুসলিম শাসনের বহু বছর আগে থেকেই মুসলমানরা ভারতে বসবাস করে আসছেন।’ এ বিষয়ে গোলাম আহমদ মোর্তজা বলেন, ‘এখন তর্কের খাতিরে যদি মেনে নেয়া হয়, বিদেশ থেকে এলেই যদি ‘বিদেশী’ হয়, তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, আর্যরা কি বিদেশী নন? তারা যে বহির্ভারত থেকে আগত, তার ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে। যাদের ভারত ছাড়া আর কোন ‘স্বদেশ’ নেই, যাদের জন্ম-মৃত্যু, আয়-ব্যয় সব ভারতকে কেন্দ্র করে, তাদেরকে ‘বিদেশী’ বলার অর্থ- নিঃসন্দেহে সত্য, সততা ও ন্যায়নীতিকে নিহত করার শামিল (চেপে রাখা ইতিহাস, পৃষ্ঠা-৩৪৫-৪৬)। গোলাম আহমদ মোর্তজার মতে, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব ও ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে আলিম ওলামাদের ত্যাগ, কোরবানি, আন্দামান-নিকোবরে নির্বাসন ও সংগ্রামের সেই কীর্তিগাথা ঘটনাপ্রবাহ জাতীয় ইতিহাসে স্থান পায়নি। ফাঁসিতে গলা কাটা গেছে সাতশ’ পীর মাশায়েখের। ২৮ হাজার সাধারণ মুসলমানকে শহীদ করা হয়েছে। হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি, মাওলানা কাসেম নানুতুভী, মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী, মাওলানা জাফর থানেশ্বরী, মওলানা ফজলে হক খায়রাবাদির ও পাটনার মাওলানা ইয়াহিয়া আলীর শারীরিক শাস্তি, অমানুষিক নির্যাতন ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের কথা ইতিহাসে নেই। বিপ্লবী দল সাহারানপুরের ইংরেজদের প্রধান ঘাঁটি দখল করে নেয়। হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী হন উপদেষ্টা। মাওলানা কাসেম নানুতুভী সেনাপতি আর মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহীকে প্রধান বিচারপতি করে বিপ্লবী দল অস্থায়ী সরকার গঠন করে। এসব ধ্রুব সত্য কথা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য রচিত, ইতিহাস পুস্তকে উল্লেখ করা হয়নি (হায়াতে মাদানী ও আজাদী আন্দোলনে আলেমসমাজ, পৃষ্ঠা-৪১৯)। মালাবারের মোপলা আন্দোলন বা ফকির বিদ্রোহের কথা নবপ্রজন্মের কাছে অজানা। ভারতে স্বাধীনতার প্রথম আওয়াজ তোলেন একজন সংগ্রামী আলিম, যার নাম মাওলানা হাসরাত মোহানী। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে আহমদাবাদে কংগ্রেসের অধিবেশনে কংগ্রেসের ইংরেজ তোষণ, আংশিক স্বাধীনতা, স্বরাজ প্রভৃতি নস্যাৎ করে মাওলানা হাসরাত মোহানী পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করেন। অথচ মহাত্মা গান্ধী এর বিরোধিতা করে বলেন, ঞযব ফবসধহফ যধং মৎরবাবফ সব নবপধঁংব রঃ ংযড়ংি ষধপশ ড়ভ ৎবংঢ়ড়হংরনরষরঃু. ‘স্বাধীনতার দাবি আমাকে বেদনাহত করেছে। কারণ প্রস্তাবটি দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক (ইতিহাসের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-৩৬৩)। এসব হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে, নতুন ইতিহাস রচনায় এগিয়ে আসতে হবে নবপ্রজন্মকে।
ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি নসিহত করে গোলাম আহমদ মোর্তজা যে কথা বলেছেন, তা অনেকের চোখ খুলে দেবে, ‘আমরা শুধুমাত্র ভারতের ইতিহাসেই দেখলাম, যেখানে মুসলমানদের গভীর ধার্মিকতা, দাড়ি, টুপি, পোশাক পরিচ্ছদে ভালো মুসলমান, তাদের করা হয়েছে বিকৃত আর যারা ইসলাম ধর্মকে অবজ্ঞা আর অনাদর করেছেন মুসলমান হয়েও অমুসলমানদের মতো নিজেকে যত বেশি হারিয়েছেন, তারাই ইতিহাসে সম্মানের আসনে গৃহীত। মুসলমান জাতি এবং কমিউনিস্টদের বিপ্লবাত্মক ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। আরো দেখলাম, মুসলমান ছাত্ররা ভারতের বাইরে। স্বাধীনতার জন্য গিয়ে তারা বেশির ভাগ আর মুসলমান হয়ে ফিরে এলেন না, এলেন ‘কমিউনিস্ট’ হয়ে। তার কারণ হচ্ছে এই, শুধু ডিগ্রি, জ্ঞান বুদ্ধি আর ধর্মীয় যশই সব নয়, পবিত্র কুরআন আর হজরত মুহাম্মদ সা: -এর আদর্শ সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় জ্ঞান এবং তাতে রুচিশীল না হওয়া পর্যন্ত কাঁচা অবস্থায় শিক্ষা সংগ্রাম বা রাজনীতি সংগ্রামের গভীর জঙ্গলে কাউকে ছেড়ে দিলে তাকে ফিরে না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ভারতে ধর্মের ভ-ামির রাজত্বে ভারতীয় মুসলমানদের মেরুদ- সোজা করে যারা দাঁড় করাতে চান, তাদের কারো ধারণা- জাতির উচ্চ ইংরেজি শিক্ষা করা, রাজনীতি শিক্ষায় সচেতন হওয়া, ইতিহাস সচেতন হওয়া, মাদরাসা মক্তব করে মওলভী হাফেজ সৃষ্টি করা, পত্রিকার মারফত জনমত গঠন করা, অর্থনৈতিক উন্নতি করা, সমিতি ও সংস্থা সৃষ্টি করা, ধর্মীয় ফান্ড তৈরি করা প্রভৃতি এক একটি অঙ্গ সতেজ করতেই তারা বদ্ধপরিকর। যদিও প্রত্যেকটির প্রয়োজন কিন্তু আমাদের মতে সবগুলোর দরকার স্বীকার করলেও সর্বপ্রথমে প্রয়োজন সর্বপ্রকার সর্ব শ্রেণীর মুসলমান, সম্পূর্ণ জনসাধারণকে যেমন করে হোক ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ধর্মীয় জ্ঞান দান আর কুরআন ও হাদিসের আদেশের অনুকূলে জীবন গঠন করার ব্যবস্থা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। মানুষ প্রায় মিথ্যাবাদী, মিথ্যাবাদী ঐতিহাসিকদের ইতিহাসও মিথ্যাবাদী হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাই সত্যবাদিতাই হচ্ছে ইতিহাস সৃষ্টির প্রাণ। ঐতিহাসিকরা যা লিখে যান পরে তার পরিবর্তন ঘটায়। প্রকৃত সত্য ইতিহাস সত্যবাদীদের কাছ থেকেই পাওয়া যায়’ (গোলাম আহমদ মোর্তজা, ইতিহাসের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-৪৩৩)।
মনীষী গোলাম আহমদ মোর্তজা পবিত্র কুরআনের পূর্ণাঙ্গ তরজমা করেছেন সাবলীল ভাষায়। তার মতে, পবিত্র কুরআনে ব্যবহৃত পরিভাষাগুলো অনুবাদ করতে অনেকে ভুল করে বসেন। পশ্চিমবঙ্গের এক অনুবাদক কুরআনে বর্ণিত ‘আও মা মালাকাত আইমানুকুম’-এর তরজমা করেছেন ‘তোমাদের অধীনস্থ চাকরাণীগণ’। এটা মারাত্মক ভ্রান্তি। এ ছাড়া গিরিশ চন্দ্র সেন কুরআনের ‘সালাত’-এর তরজমা করেছেন ‘প্রণিপাত’। প্রণিপাত অর্থ প্রণাম। এটা কোনোক্রমেই সালাত বা নামাজ নয়। ‘মালাক’-এর অর্থ করেছেন ‘দেবদূত’। দেব, দেবতা, দেবী শব্দগুলো পৌত্তলিক; তাওহিদের পরিপন্থী। ‘ওহি’-এর অর্থ করেছেন ‘প্রত্যাদেশ’। তাহলে আদেশটা কী? ইতিহাসবিদ গোলাম আহমদ মোর্তজা যে কথা বলে গেছেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য ‘মুসলমান জাতি যদি হজরত মুহম্মদ সা:-এর অনুসরণে ও অনুকরণে চলতে থাকেন, হিন্দু ভাইবোন যদি স্বামী বিবেকানন্দের (বা কোনো আদর্শ পুরুষের) আদর্শ গ্রহণ করেন, ভারতীয় বা স্বদেশীয় খ্রিষ্টান বন্ধুরা যদি যীশুখ্রিষ্টের মহান আদর্শকে অনুসরণ করেন, শিখ ভাইবোনেরা যদি গুরু নানকের প্রকৃত আদর্শকে সাথে করে এগিয়ে যান এবং যেকোনো দল বা স¤প্রদায় যদি তাদের আদর্শ নেতার আদর্শকে সামনে রেখে চলতে থাকেন তাহলেই বিবাদহীন সুষ্ঠু সমাজ গড়ে উঠবে, হাতে হাতমিলিয়ে জনকল্যাণকর কাজ করতে থাকবে। কোনো বাধা, সা¤প্রদায়িকতা, বিচ্ছিন্নবাদিতা, প্রাদেশিকতা এবং সব রকমের সঙ্কীর্ণতা নির্মূল হয়ে গড়ে উঠবে সৌভ্রাতৃত্বের সুদৃঢ় বন্ধন (গোলাম আহমদ মোর্তজা, চেপে রাখা ইতিহাস, পৃ.৩৪৬)।
গোলাম আহমদ মোর্তজার বিশ্লেষণধর্মী লেখা লাখ লাখ মানুষের চেতনাকে শানিত করে। মানুষ নিজেদের ঐতিহ্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখে। ফরমায়েশি কথা যে ইতিহাস নয়, মানুষ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। আমরা এই গবেষক, ইতিহাসবিদ ও ধর্মপ্রচারকের রুহের মাগফিরাত কামনা করি এবং দোয়া করি, আল্লাহ তায়ালা তার সব খিদমত কবুল করুন এবং জান্নাতে উচ্চ দারাজাত নসিব করুন, আমিন। লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
ইমেইল: drkhalid09@gmail.com