রাজনীতির ভাষা আছে। আছে তার নিজস্ব বিষয় বৈশিষ্ট্য। আছে স্থান কাল পাত্র ভেদ। রাজনীতিকরা নিজ নিজ রাজনীতির ভাষায় কথা বলেন। একেক জনের একেক স্টাইল ও ধরন-ধারণ। আদর্শিক রাজনীতিকরা সাধারণত মেধা ও মনন দিয়ে কথা বলেন। আর সম্মোহনী নেতৃত্ব কথা বলেন ওজস্বিনী ভষায়। জনগণকে আবিষ্ট ও আকর্ষণ করার অপূর্ব ক্ষমতা থাকে তাদের। আমাদের রাজনীতির ইতিহাসে শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক ছিলেন সেরূপ সম্মোহনী এক নেতা । মানুষ মুগ্ধ হয়ে দরাজ গলায় তার বক্তৃতা শুনত। তারা মোহিত হতো। অনুপ্রাণিত হতো। আবেগময় অনুসারী হতো। জীবন দিতেও দ্বিধা করত না তারা। এ যেন হ্যামিলনের বংশীবাদক। অবশ্য এর ছন্দপতন আছে। আছে যোগ-বিয়োগ-পূরণ-ভাগের বৈচিত্র্যময় ইতিহাস। রাজনীতির ভাষার তাত্ত্বিক দিক আছে। আছে বাস্তব দিক। ঘোষণা- কর্মসূচি-পরিকল্পনা ও মেনিফেস্টো। আছে তাদের বক্তৃতা বিবৃতি ও স্লোগান। বক্তৃতায় তেজ থাকলে নেতা তেজী হয়ে ওঠেন। প্রতিষ্ঠার জগৎ প্রসারিত হয়। শেরেবাংলা বাগ্মীপুরুষ ছিলেন। উপমহাদেশের মানুষকে যারা ব্যাপকভাবে আন্দোলিত করেছেন, তাদের একজন ছিলেন তিনি। তার রাজনীতির ভাষায় স্বকীয়তা ছিল, নিজস্ব মাধুর্য ছিল।
শেরেবাংলা বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন। ঘরে-বাইরে একই রকম। এমন কি রাজনৈতিক বক্তৃতা- তা যেখানেই হোক যে সময়ে হোক ভাষার ব্যতিক্রম ছিল না। সে ভাষা ছিল নিখাদ, অকৃত্রিম। একান্তই মাটি ও মানুষের ভাষা। তিনি জনগণের মন-মগজ, স্বভাব-চরিত্র, চাওয়া-পাওয়া ও কালচার শতভাগ বুঝতেন। তাদের নাড়ির টান টের পেতেন। তাদের গায়ের গন্ধ শুঁকে নিতে পারতেন তিনি। আহারে-বিহারে, চলনে-বলনে, পোশাকে-আশাকে, আচার-ব্যবহারে তিনি ছিলেন একান্তই মাটির সন্তান। শতাব্দীব্যাপী তার জীবনধারা সন্ধান করলে ওই সত্যই ফুটে ওঠে। আমার ধারণা, বাংলাদেশের আর কোনো নেতা এত করে তাদের হৃদয়ের ভাষা, মনস্তত্ত্ব, সুখ-দুঃখ, অনুভব করেননি। রাজনীতিক হিসেবে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললেও তার সব কথা ও কাজ বিশুদ্ধ ছিল এ কথা বলা যাবে না। সবটাই ছিল রাজনীতি। রাজনীতির ছলা-বলা-কলাকৌশল কখনো কখনো উদ্দেশ্যমূলক। প্রতিপক্ষের প্রতি শৈপ্লিকভাবে বিরোধী।
শেরেবাংলার এলাকার মানুষ আমি। শিশুকাল থেকে তার স্মৃতি ও শ্রুতি শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। এরকম কিছু সহজ-সরল রাজনীতির ভাষাই আজকের অবতারণা। এটা অসম্ভব গবেষণা প্রসূত কিছু নয়। আবার অসত্যও নয়।
ক. ১৯৪৬ সালের কথা। শেরেবাংলা নির্বাচন করছেন পটুয়াখালীর বাউফল থেকে। সেটি ঢাকার নবাবদের জমিদারি। তার প্রতিদ্বন্দ্বী খাজা নাজিমুদ্দিন। পাশাপাশি নির্বাচনী সভা করছেন। ধরুন নাজিমুদ্দিন এক নির্বাচণী সভায় বক্তৃতা করছেন। শোনা গেল শেরেবাংলা আসছেন। মানুষ হুড়মুড় করে চলে গেল শেরেবাংলার সভায়। শেরেবাংলা সম্পর্কে বলা হয়, তিনি পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত মুসলমান। তার প্রমাণ দেখা গেল তার পোশাকে। আচকান ও মাথায় রুমি টুপি। জনসভায় টুপিটি নামিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘আমি অনেক ক্লান্ত। খুব খারাপ লাগছে। রোজায় কাহিল হয়ে গেছি।’ সে দিন রমজানের রোজা ছিল না। তিনি আইয়াম বিজের নফল রোজা রেখেছেন- জনতাকে বললেন। তিনি বক্তৃতা শুরু করলেন। জনগণের গ্রামীণ ‘বরিশাইল্যা’ ভাষায়। বক্তৃতার সারবস্তু হলো এরকম- ‘আমি আপনাগো পোলা। যে বেডায় আইছে হে কেডা? খাজা-গজা নবাব। আমি গরিব মানুষের হক সাহেব। বড়লোকের ভালো চাইলে হেরে ভোট দেবেন। আর গরিবের ভালো চাইলে আমারে ভোট দেবেন’। আমার বাবা ছিলেন শেরেবাংলার অনুসারী। তিনি এভাবেই বর্ণনা করেছেন শেরেবাংলার রাজনীতির ভাষা। মানুষকে আকৃষ্ট করার অপূর্ব ক্ষমতা ছিল তার। তিনি ভোটাচার বা নির্বাচনী কলাকৌশল ভালো জানতেন। তার সম্পর্কে প্রচলিত গল্প এরকম যে- রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যখন কোনো কবরস্থান দেখতেন জিয়ারতের জন্য দাঁড়িয়ে যেতেন।
খ. ১৯৪৬ সালের আর এক ঘটনা। খুলনায় নির্বাচনী জনসভা। সোহরাওয়ার্দী তখন মুখ্যমন্ত্রী। শেরেবাংলার মূল আঘাত তাকে উদ্দেশ করে। জনসভায় শেরেবাংলা বললেন, ‘ও মিয়ারা, আমারে থুইয়া সোহরাওয়ার্দীরে মন্ত্রী বানাইছে ক্যা, হ্যা জানেন? ইংরেজরা কইছে মানষের হাড়গোড় দিয়া বোমা বানাইবে। আমি আমার মানষেরে মারতে পারমু না। সোহরাওয়ার্দী রাজি অইছে। হেই লইগ্যা হ্যারে বাইছে’। ভাষাটি হুবহু এরকম না হলেও ম্যাসেজটি ছিল এরকম। আর যায় কোথায়? পর দিন সোহরাওয়ার্দী এলেন খুলনায়। জনতা তার ইস্টিমার ভিড়তেই দেয়নি। কমরউদ্দীন আহমদের মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনীতে এর বিবরণ আছে।
গ. ১৯৫৪ সাল। যুক্তফ্র্রন্টের নির্বাচনী জয়জয়কার। পটুয়াখালীর জুবিলি স্কুল মাঠে বিশাল জনসভা। বক্তৃতা করছেন শেরেবাংলার ঘনিষ্ঠ সহচর ‘বাক সম্রাট’ বিডি হাবিবুল্লাহ। তিনি বলছেন, শেরেবাংলা ক্ষমতায় গেলে প্রাইমারি স্কুল, জুনিয়র স্কুল ফ্রি, শেরেবাংলা বিডি হাবিবুল্লাহর কোটের কোনা টেনে বললেন, ‘ক বদু হাই স্কুলও ফ্রি’। (হাবিবুল্লাহকে শেরেবাংলা বদু বলে ডাকতেন)। যথারীতি বদু বললেন, ‘বাংলার বাঘ আবার গর্জে ওঠেছেন, বলেছেন হাইস্কুলও ফ্রি করে দেয়া হবে’। এবার শেরেবাংলার বক্তৃতা। সেখানে মুসলিম লিগের শক্ত প্রার্থী শামসুদ্দিন শিকদার শানু মিঞা। তিনিই শেরেবাংলার লক্ষ্য। বক্তৃতার একপর্যায়ে তিনি বললেন, ‘ও মিঞারা, কলিক্কাত্তার রাস্তায় দেখছি একটা পোলা টিন টিন করে। গায় গোস্ত নাই। অ্যাক্কেবারে হুগনা। দেশ স্বাধীন অওয়ার পর দেহি হেই পোলা হোলছে। এতা হোলা হোলছে যে কোতাঁয় আডে না। আমি একদিন জিগাইলাম ও মিঞা হিগদারের পো- কি খাইয়া হোলছো’। এ কথা বলেই তিনি মুখে হাত দিলেন। দেখালেন যে, তিনি অসাবধানতাবশত অযাচিতভাবে কথাটা বলে ফেলেছেন। আমরা একজনকে যেভাবে সরি বলি। ওই জনসভায় উপস্থিত ছিলেন এমন একজন আপনজন বলেছেন এ সব কথা।
ঘ. অক্সফোর্ডখ্যাত বিদগ্ধ প-িত তপন রায় চৌধুরী । শেরেবাংলার সাথে ছিল তাদের একান্ত পারিবারিক সম্পর্ক। তার ‘বাঙাল নামা’ এবং ‘পরনিন্দা চর্চায়’ শেরেবাংলার রাজনীতির ভাষার অনেক বিবরণ আছে। তিনিও শেরেবাংলার মতো বরিশাইল্যা ভাষাকে জাতে তুলেছেন আন্তর্জাতিক পরিসরে। তখন পত্রপত্রিকায় শেরেবাংলা সম্পর্কে নানান ধরনের মিথ্যা খবর ছাপা হতো। কেউ যখন বলত প্রতিবাদের কথা শেরেবাংলা বলতেন, ‘আমারে যারা ভোট দেবে হ্যারা পেপার পড়ে নাহি’। এরকম এক পত্রিকা সম্বন্ধে ফজলুল হক সাহেব একদিন মন্তব্য করেছিলেন, ‘দেখো আমি হিন্দুবিদ্বেষী ছালান্নিয়া (নিখাদ) পাডা’। শেরেবাংলা যখন হিন্দুত্ববাদী শ্যামাপ্রাসাদকে নিয়ে ‘শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা’ গঠন করেন; তখন বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হন। এ সময় তিনি বরিশালে এলে এক বন্ধু তাকে বলেন, ‘তোর জন্য তো মুখ দেহাইতে পারতাছি না’। উত্তরে শেরেবাংলা বলেন, ‘মুখ দেহাইতে না পারলে পাছা দেহাইস’। এ রকম অনেক মজার মজার ঘটনা আছে তপন রায় চৌধুরীর বয়ানে।
ঙ. ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের জনসভায় শেরেবাংলা বলছেন, ‘নাজিমুদ্দি মনে করছে বাংলার বাঘ মরে গেছে। বাংলার বাঘ মরে যায়নি, শুধু তার দাঁত কয়টা পড়ে গেছে’।
চ. সম্ভাবত ১৯৫৪/৫৫ সালের কথা। শেরেবাংলা তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। গেছেন বরিশাল। জেলা স্কুল ময়দানে জনসভা। রীতি মোতাবেক মঞ্চ থেকে খানিকটা দূরে বাঁশের নিরাপত্তা বেষ্টনী। শেরেবাংলা মঞ্চে ওঠেই হুঙ্কার : ‘ও মিঞারা, অ্যা কি করছো? আমাগো মানুষ এত দূরে ক্যা ? বাঁশের ব্যারা কি লইগ্যা? আমি থাকমু অ্যা হানে আর আমার মানুষ থাকপে ওইহানে- হে গভর্নর গিরি আমার লাগবে না’। ওমনি মানুষ হুড়মুড় করে বাঁশের বেড়া ভেঙে তার কাছে এসে হাজির। আমার স্কুলশিক্ষকের বর্ণনা এটি। তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার এই গণচরিত্র অব্যাহত ছিল। তার কাছে থেকে কখনো কেউ খালি হাতে ফেরত আসত না। লোকেরা বলত- খাজা বাবার দরবারে কেউ ফেরে না খালি হাতে। দান করতে করতে উজাড় হয়েছে তার হাত। জীবনে সঞ্চয় করতে শেখেননি। ১৯৪৭ সালের পর তিনি যখন পূর্ব বাংলায় ফিরে আসেন তখন তিনি একরকম রিক্তহস্ত। যে দেশের সৃষ্টির পেছনে তার অবদান অনন্য তাকে তখন অ্যাডভোকেট জেনারেলের মতো পদেও চাকরি করতে হয়েছে। সম্মান ও মর্জাদার জন্য তার আকাক্সক্ষা ছিল। কিন্তু অর্থবিত্ত ঘুষ-দুর্নীতি কখনো তাকে স্পর্শ করেনি। জীবন সায়াহ্নে একজন অতিসাধারণ মানুষ হিসেবে জীবন যাপন করেছেন।
শেরেবাংলার জীবন ইতিহাস নিয়ে প্রকাশনা এবং গ্রন্থনা কম হয়নি। কিন্তু মৌলিক গবেষণা বড় একটা হয়নি। অবিভক্ত বাংলার শাসন পরিষদে তার বক্তৃতা ও বিবৃতি, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার কার্যবিবরণী ও রাজনৈতিক বক্তব্য সুরক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। অন্যান্য উদাহরণ থেকে ‘শেরেবাংলা পেপার্স’ হিসেবে এসব বিষয় প্রকাশ করা যায়। সব কিছু কালের কপোলে হারিয়ে যাওয়ার আগে আমাদের বিশেষত সরকারকে এ বিষয় উদ্যোগী হতে হবে।
শেরেবাংলার জীবন ও কর্ম নিয়ে অনেক গল্প আছে। তিনি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে এক কিংবদন্তি পুরুষ। তিনি তাদের প্রাণের হক সাহেব। এই দেশ জনগোষ্ঠীর আত্ম জাগৃতিতে সম্ভবত তার চেয়ে কারো অবদানই বেশি নয়। সে অনুযায়ী তার স্বীকৃতি আজো অর্জিত হয়নি। সন্দেহ নেই, তার রাজনৈতিক জীবনে সব সিদ্ধান্তই বাস্তবসম্মত ছিল না; কিন্তু এ দেশের মানুষ যখন সামন্ত প্রভু জমিদার মহাজনের অত্যাচারে জর্জরিত এবং একই সাথে প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের নিপীড়নের নিগড়ে আবদ্ধ তিনিই ছিলেন মুক্তির দূত। তার কৃষক প্রজা পার্টি, অবিভক্ত বাংলায় তার শাসনকাল এবং তার গণমুখী নেতৃত্ব এ অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক স্বাধীনতায় উদ্বেল করে তোলে। ইতিহাসের অনিবার্য ধারা-উপধারায় ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই স্বাধীনতার ভিত্তি রচয়িতার অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের এক মহান পিতৃপুরুষ।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ইমেইল: গধষ৫৫লঁ@ুধযড়ড়.পড়স