শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৪:৫৮ পূর্বাহ্ন

ইয়াসে বিধ্বস্ত উপকূল: লণ্ড ভণ্ড সেন্টমার্টিন

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বুধবার, ২৬ মে, ২০২১

ভরা পূর্ণিমা ও ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বিধ্বস্ত দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেন্টমার্টিনের একমাত্র জেটির পন্টুন, দ্বীপের বাঁধ ও সড়ক। বিধ্বস্ত হয়েছে কয়েকটি ঘরবাড়ি এবং উপড়ে গেছে শতাধিক গাছপালা। ফেনীর সোনাগাজী ও বরগুনার বামনায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারের পানিতে ডুবে দুই জেলের মৃত্যু হয়েছে। একইসঙ্গে ভোলার লালমোহনে গাছ চাপায় এক রিকশা চালকের মৃত্যু হয়েছে। লালমোহন (ভোলা) সংবাদদাতা জানান, লালমোহনে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে গাছ চাপা পড়ে আবু তাহের (৪৮) নামের এক রিকশা চালকের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলার কালমা ইউনিয়নের মৃধার চৌমুহনী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আবু তাহের, স্থানীয় গফুর পাটোয়ারীর ছেলে। নিহতের স্বজনরা জানান, রাতে তিনি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঘরের বাইরে যান। এসময় প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাসে বাগানের একটি রেইনট্রি গাছের ডাল ভেঙে তার গায়ে পড়লে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। পরে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে লালমোহন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। পরে চিকিৎসকরা তাকে ভোলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১১টার দিকে তিনি মারা যান।
বামনা (বরগুনা) সংবাদদাতা জানান, গত মঙ্গলবার রাতে বরগুনার বামনায় মাছ শিকার করতে গিয়ে নান্না জোমাদ্দার (৩৫) নামে এক জেলের মৃত্যু হয়েছে। তিনি উপজেলার দক্ষিণ ডৌয়াতলা গ্রামের মতি জোমাদ্দারের পুত্র। পারিবারিক সূত্র জানায়, নান্না মঙ্গলবার রাতে বাড়ির পাশের হোতাখালে মাছ শিকার করতে গেলে হঠাৎ খালের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি পানিতে ডুবে মৃত্যু বরণ করেন।
ফেনী (সোনাগাজী) সংবাদদাতা জানান, ফেনীর সোনাগাজীতে মঙ্গলবার (২৫ মে) মাছ ধরতে গিয়ে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারের পানিতে ডুবে হাদিউজ্জামান নামে এক জেলের মৃত্যু হয়েছে। তার বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগরের শেখপাড়া গ্রামে। সোনাগাজী মডেল থানার ওসি সাজেদুল ইসলাম পলাশ বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ছোট ফেনী নদীর বাইরের চরে ১০ থেকে ১২ জন জেলে মাছের পোনা ধরতে যায়। অন্যদিনের থেকে ৪-৫ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে অন্যরা বাঁচতে পারলেও হাদিউজ্জামান নদীর পানিতে তলিয়ে যায়। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস তার মরদেহ উদ্ধার করে।
ভরা পূর্ণিমা ও ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বিধ্বস্ত দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেন্টমার্টিনের একমাত্র জেটির পন্টুন, দ্বীপের বাঁধ ও সড়ক। বিধ্বস্ত হয়েছে কয়েকটি ঘরবাড়ি এবং উপড়ে গেছে শতাধিক গাছপালা। এতে আতঙ্ক ভর করেছে দ্বীপের ১০ হাজার বাসিন্দার মাঝে। গত মঙ্গলবার (২৫ মে) সকাল থেকে এই দ্বীপে হানা দেয় অস্বাভাবিক জোয়ারের পানি। রাতেও একইভাবে জোয়ারের ধাক্কায় ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে দ্বীপের কয়েক পাশ। সঙ্গে রয়েছে ঝড়োবৃষ্টির হানাও। গতকাল বুধবার (২৬ মে) সকালের জোয়ারেও পানির তীব্রতা মোকাবিলা করছে দ্বীপবাসী। দ্বীপের বাসিন্দা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের আতঙ্কে দ্বীপের মানুষ নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে থেমে থেমে ঝড়ো বৃষ্টি হতে থাকে। জোয়ারের পানিতে দ্বীপের উত্তর ও পশ্চিম তীরের গাছপালা উপড়ে গেছে। ভাঙছে রাস্তাঘাট। তাই আমার মতো দ্বীপের সব বাসিন্দাই ভয়ে আছেন। সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে দ্বীপের উত্তর, উত্তর-পূর্ব দিকের অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এরইমধ্যে বেশ কিছু গাছপালা উপড়ে গেছে। রাস্তাঘাট ভাঙছে। আর প্রবল জোয়ারের ধাক্কায় বালিয়াড়িতে থাকা পাঁচটি ট্রলার ভেঙে গেছে। জোয়ারের পানির তোড়ে জেটির পন্টুনটি বিধ্বস্ত হয়েছে। নানা অংশ ভেঙে পড়েছে।
কোস্টগার্ড সেন্টমার্টিন স্টেশনের ইনচার্জ লে. কমান্ডার রাসেল মিয়া বলেন, ‘দ্বীপে সব মিলিয়ে বাসিন্দা রয়েছে ১০ হাজার ২৬ জন। এরইমধ্যে দ্বীপের হোটেল, রিসোর্ট, স্কুল, ইউনিয়ন পরিষদ মিলে ৩০টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। যেখানে ৬ হাজার মানুষকে আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে প্রবল জোয়ারের পানিতে জেটির পন্টুন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর সব ধরনের ট্রলার চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। টেকনাফে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে প্রায় ৫০টি অধিক ট্রলার। আর ছোট ট্রলার, নৌকা ও স্পিডবোটগুলো দ্বীপের উপকূলে নোঙর করে রাখা হয়েছে। আশা করি, সবার সমন্বয়ে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে ক্ষতি মোকাবিলা সম্ভব হবে।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের একটি টিম, রেড-ক্রিসেন্টের লোকজন ও দ্বীপে দায়িত্ব থাকা বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সর্তক অবস্থানে রয়েছে। অবস্থা খারাপ হলে প্রয়োজনে দ্বীপের সবাইকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হবে।
ভারতীয় উপকূলে আছড়ে পড়েছে ইয়াস: অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এখন উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারতের উপকূলে আছড়ে পড়েছে। ধারণা করা সময়ের কিছু আগেই বুধবার (২৬ মে) সকাল ১০টা থেকে ১১টা নাগাদ ঝড়টি ভারতের উড়িষ্যায় আছড়ে পড়ে। এছাড়া ১২টা নাাগদ ধামারা বন্দর ও পশ্চিমবঙ্গের দিঘা অতিক্রম করতে শুরু করবে ঝড়টি। ঝড়ের কেন্দ্রের কাছে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ১২০ থেকে বেড়ে এখন ১৫০ কিলোমিটার। এর প্রভাবে সাগর এখন খুবই উত্তাল।
ঝড়ের প্রভাবে গত মঙ্গলবার (২৫ মে) সন্ধ্যা থেকেই বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ভারী বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বইছে। জোয়ারের পানির উচ্চতা বেশি হওয়ার কারণে ইতোমধ্যে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। কোথাও কোথাও ভারী বৃষ্টির কারণে পানি বেড়েই চলেছে। উপকূলের বেশিরভাগ মানুষ এখন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন।
আবহাওয়া অধিদফতরের সর্বশেষ বিশেষ সতর্কবার্তায় বলা হয়, অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এখন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৫২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছে। একইভাবে কক্সবাজার থেকে ৫২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে, মোংলা বন্দর থেকে ৩২০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা বন্দর থেকে ৩৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছে। ভারতের আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, সুপার সাইক্লোন ইয়াস উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে ভারতে ধামারা বন্দরে এবং দুপুর নাগাদ উত্তর উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গ উপকূল অতিক্রম করছে।
আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, ইয়াস যখন ভারতের উপকূল অতিক্রম করবে, সে সময় খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর ও চট্টগ্রামে এবং তার আশপাশের দ্বীপ ও চরগুলোতে দমকা হাওয়াসহ ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টি হতে পারে।
বেড়িবাঁধ নিয়ে শঙ্কায় উপকূলবাসী: একইসঙ্গে এসব এলাকার ওপর দিয়ে ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার বেগে দমকা বা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। একই সময় উপকূল এলাকায় জলোচ্ছ্বাসের কারণে ৩ থেকে ৬ ফুটে বেশি উচ্চতায় পানি উঠে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া প্রায় সারাদেশেই মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হতে পারে।
এদিকে ইয়াসের প্রভাবে গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে ঈশ্বরদীতে ৭০ মিলিমিটার। এছাড়া তাড়াশে ৬৭, রাঙামাটিতে ৬২, চুয়াডাঙ্গা ও কুমিল্লায় ৫৭, যশোরে ৪৮, নেত্রকোনায় ৪৬, কুমারখালিতে ৪৩, চাঁদপুর ও ঢাকায় ৩৭ মিলিমিটার, মাইজদীকোটে ৩৫, মাদারিপুরে ৩৪,সীতাকু-ে ৩২, বদলগাছিতে ২৮, ময়মনসিংহে ২৭, ফরিদপুরে ২৩, দিনাজপুর ও গোপালগঞ্জে ২২, খুলনায় ২১, বরিশালে ১৮, চট্টগ্রামে ১৭, মোংলা, ভোলা, সৈয়দপুর ও রাজশাহীতে ১৬,সন্দ্বীপে ১৩, ফেনীতে ১২, শ্রীমঙ্গলে ১১, তেঁতুলিয়ায় ১০, খেপুপাড়া ও সাতক্ষীরায় ৮, পটুয়াখালী ও হাতিয়ায় ৯, রাজারহাটে ৫, টাঙ্গাইলে ৬, রংপুর ও বগুড়ায় ৪, ডিমলায় ২, সিলেট ও কক্সবাজারে ১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ভারতের গণমাধ্যমগুলো জানায়, আঘাত হানার আগে শুধু উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ১০ লাখ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ট্রেন-বিমান চলাচলও বন্ধ এখন। ভারতের আবহাওয়া অধিদফতরের বুলেটিন অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়টি কলকাতার দিঘার থেকে ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং উড়িষ্যার ধামরা থেকে ৪০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থান করছে।
ভেসে গেল কলকাতা টিভি’র গাড়ি: অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ আঘাত হানায় ভারতের ওডিশা ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উপকূলে ব্যাপক জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে ঘরবাড়ি-রাস্তাঘাট। জলোচ্ছ্বাস থেকে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান কলকাতা টিভির সাংবাদিক সূচন্দ্রিমা ও তার গাড়িচালক। তবে ভেসে যায় তাদের গাড়িটি। পশ্চিবঙ্গের দিঘায় এ ঘটনা ঘটে। গতকাল বুধবার সকাল সোয়া ৯টার দিকে ওডিশার বালাশোরের দক্ষিণে আছড়ে পড়ে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’। আনন্দবাজার জানায়, এর আগে থেকেই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় এলাকায়। বিশেষ করে পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় প্রবল জলোচ্ছ্বাস শুরু হয়েছে। পানি ঢুকতে শুরু করে উপকূলবর্তী এলাকায়।
ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর জানাচ্ছে, এভাবে জলোচ্ছ্বাসের একটা বড় কারণ ভরা কটালের সময় ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত। বুধবার পূর্ণিমা। সেই সঙ্গে রয়েছে চন্দ্রগ্রহণ। পূর্ণিমার প্রভাবে বুধবার সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে শুরু হয় জোয়ার। সকাল ১১টা ৩৭ মিনিটে সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায় জোয়ার। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সর্বশেষ খবরে জানা যায়,জোয়ার চলাকালীন পানির উচ্চতা সর্বাধিক সাড়ে ৫ মিটার উঠতে পারে। ২০২১ সালে এটিই প্রথম ও শেষ ‘ব্লাড মুন’ হতে চলেছে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com