শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৭:২২ পূর্বাহ্ন

১৪ বছরেও থামেনি পাহাড় ধসে মৃত্যু

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১১ জুন, ২০২১

ভয়াবহ স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দিতে আবার এসেছে ১১ জুন। ২০০৭ সালের এই দিনে চট্টগ্রামের সাতটি এলাকায় পাহাড় ধসে মারা যান ১২৭ জন। এরপর দীর্ঘ ১৪ বছর পার হয়েছে, তবে থামেনি পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল। বিচ্ছিন্ন দুই-এক বছর বাদ দিয়ে প্রতিবছরই কোনও না কোনোভাবে পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঘটেছে। গত ১৪ বছরে চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে প্রায় চার শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবু এই মৃত্যুমিছিল থামাতে প্রশাসনের চোখে পড়ার মতো কোনও উদ্যোগ নেই। অভিযোগ রয়েছে, প্রতি বছর বৃষ্টির আগে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ অভিযান চালায় প্রশাসন। এরপর বাকি দশ মাস আড়ালে চলে যায় তাদের কার্যক্রম। নির্মম নিয়তিনির্ভর ঘটনা মনে করে প্রশাসনের নিরবতা নির্লিপ্ততায় রূপ নিয়েছে।

পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি, অভিযান অভিযান খেলায় প্রশাসন: বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদ ড. ইদ্রিস আলী। তিনি বলেন, ‘পাহাড় কাটা ও দখলে জড়িতরা চিহ্নিত হলেও কখনও প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। ঘুরে ঘুরে বছর এসেছে। আমলা আসে, আমলা যায়। কেউ কেউ একাধিকবারও এসেছে-গেছে। পাহাড় বিলীন হওয়ার প্রক্রিয়াটি থেমে থাকেনি। দখলকারীরা তাদের অবস্থানেই বহাল আছে। উল্টো প্রতিবছর নতুন পাহাড় কেটে আরও বসতি স্থাপনের কাজ চলছে।’ জানা যায়, ২০০৭ সালে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যুর পর একটি পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটি পাহাড় ধসের ২৮টি কারণ উল্লেখ করে এটি প্রতিরোধে পাহাড়দুস্যদের চিহ্নিত করা, পাহাড়ে বসতি উচ্ছেদ করে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া, পাহাড় কাটা বন্ধ করাসহ ৩৬ দফার একটি খসড়া সুপারিশ প্রতিবেদন তৈরি করে।
পাহাড় ধস বন্ধে পরিবেশ অধিদফতরের ১২ দফা সুপারিশ: ওই ৩৬ দফা সুপারিশমালা খসড়াই থেকে গেছে জানিয়ে ড. ইদ্রিস আলী বলেন, ‘২০০৭ সালে মর্মান্তিক পাহাড় ধসের পর একটি পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। গত ১৪ বছরে এই কমিটি উল্লেখযোগ্য কোনও কাজই করেনি। ১৪ বছরে ২১টির মতো সভা করেছে। ওইসব সভায় নেওয়া কোনও সিদ্ধান্তই বাস্তবায়নে তাদের সামান্যতমও উদ্যোগ দেখা যায়নি।’ ১৪ বছর আগে ১১ জুন চট্টগ্রামে ২৪ ঘণ্টায় ৪২৫ মিলিমিটারের মতো বৃষ্টিপাত হয়। ওই বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের সেনানিবাস এলাকা, লেডিস ক্লাব, কাছিয়াঘোনা, ওয়ার্কশপঘোনা, শহরের কুসুমবাগ, মতিঝর্ণা, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ প্রায় সাতটি এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। ওইদিন ভোরবেলা সামান্য সময়ের ব্যবধানে এসব পাহাড় ধসে নারী, শিশুসহ ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। এরপর গত ১৪ বছরে এভাবে পাহাড় ধসে মারা গেছেন আরও অন্তত আড়াইশ’ জন। এর মধ্যে ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামের লালখানবাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে চার পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়। ২০১১ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের টাইগার পাস এলাকার বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে ১৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালের ২৬-২৭ জুন পাহাড় ধসে চট্টগ্রামে ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৩ সালে মতিঝর্ণায় দেয়াল ধসে দুই জন মারা যান। ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে পাহাড় ধসে মারা যান তিন জন, একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় পাহাড় ধসে মা-মেয়ের মৃত্যু হয়।
২০১৭ সালের ১২ ও ১৩ জুন রাঙামাটিসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাঁচ জেলায় পাহাড় ধসে প্রাণ হারান ১৫৮ জন। ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর নগরীর আকবরশাহ থানাধীন ফিরোজশাহ কলোনিতে পাহাড় ধসে মারা যান চার জন। ২০১৯ সালে কুসুমবাগ এলাকা পাহাড় ধসে এক শিশুর মৃত্যু হয়। বিচ্ছিন্ন দুই-এক বছর বাদ দিয়ে এভাবে প্রায় প্রতিবছরই বর্ষায় পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। নগরীর বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রশাসনের উদাসীনতা, রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের লেজুড়বৃত্তি, তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না করাসহ সমন্বিত উদ্যোগ না থাকায় পাহড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস রোধ করা যাচ্ছে না। তাদের নির্লিপ্ততার কারণে ছিন্নমূল, বানেভাসা, নদীভাঙা, জলবায়ু তাড়িত, ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষগুলো নগরীতে এসে কম টাকায় থাকতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকিতে পড়ছেন। যে কারণে প্রতিবছর বর্ষায় চট্টগ্রামের কোনও না কোনও এলাকায় পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
এর পেছনে নগরবাসী সরকারের তিনটি পৃথক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের অবহেলার অভিযোগ তুলেছেন। তাদের দাবি, পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করা পাহাড়গুলোর মালিক ভূমি মন্ত্রণালয়। ওইসব পাহাড়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের। আর এসব এলাকায় ঘর, বাড়ি ও বস্তি নির্মাণের বিষয়ে আপত্তি ও অনাপত্তি বিষয়টি দেখার দায়িত্ব গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু এই তিন মন্ত্রণালয় কখনও পাহাড়গুলোর খোঁজ খবর রাখেনি। তাদের উদাসীনতার সুযোগে এক শ্রেণির অসাধু মহল পাহাড় দখল করে সেখানে ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে খেটে খাওয়া মানুষের কাছে ভাড়া দিচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক নুরুল্লাহ নুরীর মোবাইলফোনে কল করা হলে তিনি তা রিসিভ করেননি। পদাধিকার বলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ নাজমুল আহসান পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য। আসন্ন বর্ষাকে কেন্দ্র করে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে জানতে একাধিকবার কল করা হলে তিনিও ফোন রিসিভ করেননি।
পরে এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পাহাড় ধস রোধে রাজনৈতিক দলের নেতা, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও স্থানীয় জনগণের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। কিন্তু এটি নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই। আমরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতি বছর উচ্ছেদ করি। আমরা আমাদের যেটি করার সেটি সব সময় করছি। অন্যরাও যদি নিজেদের জায়গা থেকে সঠিক ভূমিকা পালন করে, তবেই কেবল এটি রোধ করা যাবে। অন্যথায় আমরা সারা বছর অভিযান চালিয়েও পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রোধ করতে পারবো না।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুর্গম পাহাড়ে যদি পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকে তাহলে লোকজন অব্যশই পাহাড়ে থাকতে চাইবে। যাদের পক্ষে বাসা ভাড়া নেওয়া সম্ভব না, তারা ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও পাহাড়ে বসবাস করবে। যেসব প্রতিষ্ঠান সার্ভিস লাইনগুলো সরবরাহ করে, তাদের এগুলো বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি এখন যারা ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে তাদের সরিয়ে নিতে একটি স্থায়ী পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর তখনই পাহাড়ে আর কেউ থাকবে না।’ এ লক্ষ্যে সিডিএ স্থায়ী পুর্নবাসনের জন্য একটি উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। সেটি বাস্তবায়ন করা হলে তখন আর কেউ পাহাড়ে বসবাস করতে পারবে না। সবাইকে স্থায়ীভাবে সরিয়ে নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।-বাংলাট্রিবিউন




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com