আজ থেকে জরুরি কারণ ছাড়া বাইরে বের হলে কঠোর ব্যবস্থা
আজ বৃহস্পতিবার ১ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ৭ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত বিধিনিষেধ আরোপ করে সর্বাত্মক লকডাউনের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। গতকাল বুধবার (৩০ জুন) জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপ-সচিব রেজাউল ইসলাম। আজ বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা থেকে শুরু হচ্ছে এই লকডাউন। ৭ দিনের এই লকডাউনে কেউ বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বাইরে বের হলেই কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, লকডাউন চলাকালীন সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। ‘আর্মি ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ বিধানের আওতায় মাঠ পর্যায়ের কার্যকর টহল নিশ্চিত করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেনা মোতায়েন করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় সেনা কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। এতে আরও বলা হয়, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেলা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে সমন্বয় সভা করে সেনা-বিজিবি-পুলিশ-র্যাব ও আনসার নিয়োগ এবং টহলের অধিক্ষেত্র, পদ্ধতি ও সময় নির্ধারণ করবেন। সেইসঙ্গে বিশেষ কোনও কার্যক্রমের প্রয়োজন হলে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগসমূহ এই বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে। সকল শপিং মল, মার্কেট, পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ থাকবে। জনসমাবেশ হয় এ ধরনের সামাজিক (বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান, জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি) রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে। খাবারের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খাবার বিক্রয় (শুধুমাত্র Online Take way) করতে পারবে।
আইনশৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিসেবা, যেমন-কৃষি পণ্য ও উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি), খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহণ, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্য সেবা, কোভিড-১৯ টিকা প্রদান, রাজস্ব আদায় সম্পর্কিত কার্যাবলী, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস/ জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারি-বেসরকারি), গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া), বেসরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ডাক সেবা, ব্যাংক, ফার্মেসি ও ফার্মাসিটিক্যালসসহ অন্যান্য জরুরি/অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসসমূহের কর্মচারী ও যানবাহন প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়পত্র প্রদর্শন সাপেক্ষে যাতায়াত করতে পারবে। পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত ট্রাক/লরি/কাভার্ড ভ্যান/কার্গো ভেসেল এ নিষেধাজ্ঞার আওতা বহির্ভূত থাকবে। বন্দরসমূহ (বিমান, সমুদ্র, নৌ ও স্থল) এবং তৎসংশ্লিষ্ট অফিসসমূহ এ নিষেধাজ্ঞার আওতা বহির্ভূত থাকবে।
কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংগঠন/বাজার কর্তৃপক্ষ/স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে। অতি জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত (ওষুধ ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চিকিৎসা সেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার ইত্যাদি) কোনওভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। নির্দেশনা অমান্যকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু থাকবে এবং বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণের টিকেট প্রদর্শন করে গাড়ি ব্যবহারপূর্বক যাতায়াত করতে পারবে। সড়ক, রেল ও নৌ-পথে গণপরিবহন (অভ্যন্তরীণ বিমানসহ) ও সকল প্রকার যন্ত্রচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে।
লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যু-সংক্রমণ: দেশে করোনার সংক্রমণ হু হু করে বাড়ছে। একদিনে শনাক্তের হার প্রায় ২৪ শতাংশ। মৃত্যুর লাগাম টানা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন আরও ১১২ জন। এটি একদিনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু। এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ মারা গেছেন ১১৯ জন। এর আগে গত ১৯ই এপ্রিল ১১২ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছিল অধিদপ্তর।
এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৪ হাজার ৩৮৮ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৬৬৬ জন। এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন ৯ লাখ ৪ হাজার ৪৩৬ জন। ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ৪ হাজার ২৭ জন, এখন পর্যন্ত সুস্থ ৮ লাখ ১১ হাজার ৭০০ জন। দেশে প্রথম করোনার রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ই মার্চ এবং ভাইরাসটিতে প্রথম মৃত্যু ঘটে ওই বছরের ১৮ই মার্চে। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে করোনার নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। এতে আরও জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ৩২ হাজার ৬৫৯টি। অ্যান্টিজেন টেস্টসহ নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৩১ হাজার ৯৮২টি। এখন পর্যন্ত ৬৫ লাখ ৭৩ হাজার ৮২২টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ২৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং এখন পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং মারা গেছেন ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ৬৭ জন পুরুষ এবং নারী ৪৫ জন। এখন পর্যন্ত পুরুষ ১০ হাজার ২৫৩ জন এবং নারী মৃত্যুবরণ করেছেন ৪ হাজার ১৩৫ জন। বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায় যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় মৃতদের মধ্যে ৬০ বছরের উপরে ৬১ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সী ২৪ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী ১০ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী ১৪ জন, ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী ২ জন এবং ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ১ জন মারা গেছেন। বিভাগ বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা বিভাগে মারা গেছেন ২২ জন, চট্টগ্রামে ১৬ জন, রাজশাহীতে ২১ জন, খুলনায় ৩৫ জন, বরিশালে ৩ জন, সিলেটে ১ জন, রংপুরে ১০ জন এবং ময়মনসিংহে ৪ জন মারা গেছেন। ২৪ ঘণ্টায় সরকারি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছেন ৭৭ জন, বেসরকারি হাসপাতালে মারা গেছেন ২১ জন এবং বাসায় মারা গেছেন ১৩ জন এবং হাসপাতালে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে ১ জনকে। এদিকে বিভাগভিত্তিক শনাক্তের হার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা বিভাগে শনাক্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৬৮ জন। এই বিভাগে শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ঢাকা জেলায় (মহানগরসহ) শনাক্তের হার ১৭ দশমিক ১৬ শতাংশ। ময়মনসিংহ বিভাগে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২৪২ জন। শনাক্তের হার ২০ দশমিক ৭৯ শতাংশ। চট্টগ্রামে বিভাগে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ১২ জন। শনাক্তের হার ২৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। রাজশাহীতে শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৫৯ জন। শনাক্তের হার ২১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। রংপুর বিভাগে শনাক্তের সংখ্যা ৪৬৭ জন। শনাক্তের হার ৪০ দশমিক ৪৩ শতাংশ। খুলনা বিভাগে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৩৬৭ জন। শনাক্তের হার ৪০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। বরিশাল বিভাগে শনাক্তের সংখ্যা ১৯৩ জন। শনাক্তের হার ৩৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। একই সময়ে সিলেট বিভাগে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২৫৮ জন। শনাক্তের হার ২৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
৮০ শতাংশই ডেল্টা ধরনে সংক্রমিত: আইইডিসিআর: দেশে গত দুই মাসে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের নমুনা পরীক্ষা করে ৮০ শতাংশে ডেলটা ধরন পাওয়া গেছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) গবেষণায় এ চিত্র এসেছে। গতকাল প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে গবেষণার এই ফল জানানো হয়। গত ৮ই মে জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটায় (জিআইএসএআইডি) বাংলাদেশে করোনার এই ধরন শনাক্তের খবর দেয়া হয়। এর নমুনা সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর। সেখানে বলা হয়, গত ২৮ ও ২৯শে এপ্রিল সংগৃহীত নমুনা থেকে ডেল্টা ধরন মেলে। জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে এ ধরন পাওয়া যায়। তখন আইইডিসিআর সূত্র জানায়, ভারতে ভ্রমণ করে আসা কারও শরীরে এই ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) পাওয়া গেছে। গত মঙ্গলবার আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর বলেন, গত মে ও জুন মাসে জিনোম সিকোয়েন্সিং করে ৮০ শতাংশের মধ্যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। ১০ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে সাউথ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট এবং বাকিদের মধ্যে অন্য ক্রিয়াশীল ধরন পাওয়া গেছে। দেশের প্রায় সব এলাকা থেকে এসব নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।