বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৪৫ পূর্বাহ্ন

জিয়াউর রহমানের প্রেস সেক্রেটারি কাফি খানের ইন্তেকাল

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২ জুলাই, ২০২১

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রেস সেক্রেটারি, খ্যাতিমান সাংবাদিক, অভিনেতা ও বেতার ব্যক্তিত্ব কাফি খান আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। কাফি খানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছে তার সর্বশেষ কর্মস্থল ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগ। গত বৃহস্পতিবার তিনি যুক্তরাষ্ট্রে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ক্যানসারে ভুগছিলেন কাফি খান। কাফি খানের জন্ম ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাতের কাজীপাড়া গ্রামে। সার্টিফিকেট অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ১ মে ১৯২৯। রেওয়াজ অনুযায়ী এক বছরের হিসাব নেই। অর্থাৎ আসল জন্মসাল ১৯২৮। গ্রামের স্কুলে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি পড়াশোনা করেছেন। বারাসত গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে পাস করেন ম্যাট্রিক। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন ড. এনামুল হক। তারপর কলকাতার রিপন কলেজ থেকে আইএ পাস করে বিকম-এ ভর্তি হন। সেটি ছিল ১৯৪৬ সাল; অস্থির সময়। সরকারের লেবার কমিশনার অফিসে টি-গার্ডেন সার্ভে অফিসের ইনভেস্টিগেটর হিসেবে চাকরি নিলেন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা এবং এর ফলে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল। ফলে তখনই তিনি ঢাকায় চলে আসেন বড় ভাইয়ের সঙ্গে। পরিবারের বাকি সবাই থেকে যান ভারতে।
তখন ঢাকা শুধু একটি ছোটখাটো জেলা সদর। পেট চালানোর জন্য সরকারের রাজস্ব বিভাগে কেরানির চাকরি নিলেন। ঢাকায় সে সময় বিনোদনমূলক সাংস্কৃতিক কোনো কর্মকা- ছিল না। দেশভাগের পর হিন্দুরা চলে যাওয়ায় সাংস্কৃতিক জগতে একটি শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল। কাফি খানের আবৃত্তির দিকে ঝোঁক ছিল। স্কুলে বাংলার এক বদলি শিক্ষক গতানুগতিক কবিতা পাঠের বদলে রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ আবৃত্তি করে শুনিয়ে আবৃত্তির প্রতি তাঁর আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছিলেন। স্কুলের সেই রপ্ত করা জ্ঞান নিয়ে ১৯৫১ সালে পাকিস্তান রেডিওর ঢাকা শাখায় ‘ড্রামা ভয়েস’ হিসেবে বেতার-নাটকে কণ্ঠদান শুরু করলেন। কলকাতায় পড়াশোনার সময় সেখানকার স্থায়ী মঞ্চ বা থিয়েটারের খবরাখবর তাঁর জানা ছিল। বললেন, সে যুগে যে চার-পাঁচটা থিয়েটার হলের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত তার মধ্যে রংমহল, স্টার থিয়েটার, শ্রীরংগম, মিনার্ভা ও নাট্য নিকেতন উল্লেখযোগ্য। এগুলোর মধ্যমণি ছিলেন ডাকসাইটে অভিনয়শিল্পীÍরংমহলে অহীন্দ্র চৌধুরী, স্টারে মহেন্দ্র গুপ্ত, শ্রীরংগমে শিশির ভাদুড়ী, মিনার্ভায় ছবি বিশ্বাস ও নাট্য নিকেতনে দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁদের মধ্যে অহীন্দ্র চৌধুরী, ছবি বিশ্বাস, দুর্গাদাস প্রমুখ অভিনেতা চলচ্চিত্রেও অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।
ঢাকায় বেতারনাটকে অংশগ্রহণের পাশাপাশি কাফি খান তরুণ শরফুল আলম, কাজী নূর-উস-সোবহান, শেখ মুহিতুল হকসহ আরো কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে একটি শৌখিন নাট্যগোষ্ঠী গড়ে তুললেন। লক্ষ্য, মঞ্চাভিনয়কে জনপ্রিয় করে তোলা এবং কলকাতার মতো স্থায়ী একটি মঞ্চ গড়ে তোলা। নাটকের রিহার্সেল ও মঞ্চায়নের খরচ মেটানো হতো চাঁদা তুলে। এ কাজে সহযোগিতা করতেন হাবিবুল হক (তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের একান্ত সচিব), বি এ খান, পুলিশ কর্মকর্তা আশরাফুল হক, খলিল আহমেদ (অভিনেতা বুলবুল আহমেদের বাবা ও সরকারের ডেপুটি সেক্রেটারি) প্রমুখ।
এই নাট্যগোষ্ঠীর প্রথম মঞ্চনাটক ছিল বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘নার্সিং হোম’। এর পর একে একে আসে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কালিন্দী’, ‘দুই পুরুষ’, ‘শাজাহান’, অধ্যাপক নূরুল মোমেনের ‘যদি এমন হতো’ ও ১৯৫৬ সালে শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’। সে সময় ঢাকায় রক্ষণশীল মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভেতর থেকে নারী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য কাউকে পাওয়া খুব সহজ ছিল না। সৌভাগ্যবশত এগিয়ে এসেছিল কয়েকটি পরিবার। ‘নার্সিং হোম’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন রেডিও পাকিস্তান ঢাকার তদানীন্তন মহাপরিচালক জয়নাল আবেদিন সাহেবের স্ত্রী নূরুন্নাহার, শ্যালিকা ক্কমর আখতার, বি এ খানের মেয়ে মমতাজ লিলি খান এবং মনিমুন্নেছা নামে এক কলেজছাত্রী। নাটকগুলোর নির্দেশনায় ছিলেন শরফুল আলম।
১৯৫৬ সালে কাজী নূর-উস-সোবহানের নির্দেশনায় ‘রক্তের ডাক’ নামে একটি নাটকও মঞ্চস্থ হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের একটি সিনেমা হলে। দেবদাস নাটকটির নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন কাফি খান। পার্বতীর ভূমিকায় শরফুল আলমের স্ত্রী মাসুদা আলম। তাঁরা দুজনেই এখন প্রয়াত। ছেলেদের হলের নাটকে মেয়েদের অভিনয় করার রেওয়াজ ছিল না। ফলে জগন্নাথ কলেজ হলের পক্ষ থেকে ১৯৫২ সালে কার্জন হলে মঞ্চায়িত ও কাফি খান অভিনীত ‘বিশ বছর আগে’ নাটকে মেক আপ দিয়ে ছেলেদের মেয়ে চরিত্রে অভিনয় করানো হয়েছিল। অন্যান্য যেসব স্থানে তাঁরা নাটক মঞ্চায়ন করতেন তার মধ্যে মাহবুব আলি ইনস্টিটিউট ছিল উল্লেখযোগ্য।
ঢাকায় বহু পরিশ্রম করে ‘মুখ ও মুখোশ’ নামে প্রথম বাংলা সিনেমাটি তৈরি করেছিলেন আব্দুল জব্বার খান। এরপরই ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের (এফডিসি) প্রথম তলার নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। সেই সময়ে নাজিমুদ্দিন রোডে রেডিও অফিসের পাশেই ছিল ‘আবন মিয়ার রেস্টুরেন্ট’। সেখানে রেডিওর শিল্পী-কলাকুশলীরা বসে আড্ডা দিতেন। তাঁদের মধ্যে থাকতেন বিনোদনমূলক সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’ পত্রিকা সম্পাদক এস এম পারভেজ। তরুণ কবি সৈয়দ শামসুল হকও সেই আড্ডার নিয়মিত সদস্য ছিলেন। সবাই মিলে ঠিক করলেন একটি সিনেমা তাঁরা বানাবেন। সেই মতে ১৯৫৬ সালে এফডিসিতে প্রথম একটি বাংলা ছবি নির্মিত হলো। সৈয়দ শামসুল হকের কাহিনি নিয়ে ‘মাটির পাহাড়’। পরিচালক এস এম পারভেজ, নায়ক কাফি খান, দুই নায়িকা সুলতানা জামান ও রওশন আরা।
রাজস্ব বোর্ডের চাকরিতে যুবক কাফি খানের সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে সহকর্মী ও ঊর্ধ্বতনরা সহযোগিতা করতেন। তারপরও বাংলা সিনেমার জন্মলগ্নে নায়ক চরিত্রের জন্য যে সময় দেওয়ার প্রয়োজন হতো, তা তাঁর পক্ষে দেওয়া দুরূহ ছিল। ‘মাটির পাহাড়’-এর পর সিনেমায় ছোটখাটো পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করতে থাকলেন। ‘পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকা সম্পাদক ওবায়দুল হকের ‘দুই দিগন্ত’, মহীউদ্দিনের ‘তোমার-আমার’, খান আতাউর রহমানের প্রথম ছবি ‘অনেক দিনের চেনা’ ও পরের ‘রাজা সন্ন্যাসী’, কাফি খান অভিনীত তেমনি কয়েকটি সিনেমা।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com