মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:২৫ অপরাহ্ন

আশ্রয়ণের ক্ষতিগ্রস্ত ঘর পুনর্র্নিমাণ হবে সরকারি খরচে

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৮ জুলাই, ২০২১

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া যেসব ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা সরকারি খরচে মেরামত বা পুনর্র্নিমাণ করে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গতকাল বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) ওবায়দুল কাদের তার সরকারি বাসভবনে নিয়মিত ব্রিফিংকালে এ কথা বলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় গৃহহীনদের জন্য বিনামূল্যে গৃহনির্মাণ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা তথা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অগ্রসরমান সংগ্রামের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী অর্থনৈতিকভাবে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সময়োপযোগী কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন বলে জানান ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, যা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের উন্নয়ন নীতি থেকে উৎসারিত হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে প্রধানমন্ত্রীর এসব উদ্যোগ ইতিহাসের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে উল্লেখ করে সড়ক পরিবহন মন্ত্রী বলেন, নাগরিকের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবার জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে সরকার প্রায় এক কোটি ২০ হাজার গৃহহীন মানুষকে বাড়ি উপহার দিয়েছেন। প্রায় এক লাখ ২০ হাজার বাড়ির মধ্যে ২৪টি স্থানের নির্মাণকাজের ত্রুটি গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, যা বাস্তবায়িত প্রকল্পের ০.২৫ ভাগ জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ত্রুটিপূর্ণ যে ০.২৫ ভাগ স্থাপনা চিহ্নিত হয়েছে তা সরকারি খরচে মেরামত এবং প্রয়োজনে পুনর্র্নিমাণ করা হবে। ওবায়দুল কাদের বলেন, এসব গৃহ সরকারি খাসজমিতে নির্মিত হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে খাসজমিসহ তুলনামূলক নিচু স্থানে হওয়ায় স্থাপনাসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার পরও বিশাল কর্মযজ্ঞের হিসাবের খাতায় ক্ষুদ্র অংশে ত্রুটি দেখা দিলেও যারা এ ত্রুটির জন্য দায়ী এবং দায়িত্বে অবহেলা ও অনিয়মে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, কোনো ছাড় দেয়া হবে না।
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এ প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি মহৎ উদ্যোগ এবং গভীর আবেগ ও ভালোবাসার কর্মসূচি বলেও জানান ওবায়দুল কাদের। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী সব গৃহহীন মানুষের জন্য গৃহনির্মাণ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, কিন্তু সরকারের এ মহৎ কার্যক্রম যখন দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশের বিরাট একটি জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখন একটি মতলবি মহল বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার নামে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপতৎপরতায় মেতে উঠেছে। ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগ হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কোনো ভূঁইফোড় রাজনৈতিক সংগঠন নয়, দেশের প্রতিটি অর্জন আওয়ামী লীগের হাত ধরেই হয়েছে। এদেশের মাটির অনেক গভীরে আওয়ামী লীগের শেকড়, শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতাই নয়, অর্থনৈতিক মুক্তিও এসেছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। মাটি ও মানুষের হৃদয়ের গভীরে আওয়ামী লীগের স্থান উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগকে নিয়ে অতীতে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি উল্টো এই রাজনৈতিক দলটি ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক, এ সম্পর্ক চিরকালের, ইচ্ছে করলেই কেউ তা মুছে ফেলতে পারবে না।
আওয়ামী লীগকে যারা নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র করেছিল বরং তারাই নিশ্চিহ্ন হয়েছে, জনগণ তাদেরই ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, আন্দোলন, সংগ্রাম, ত্যাগ আর মানুষের ভালোবাসায় আওয়ামী লীগ আজ মহীরূহে রূপান্তরিত একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অদম্য গতিতে এগিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগকে যারা জনবিচ্ছিন্ন মনে করে, তারা নিজেরাই এখন জনবিচ্ছিন্ন ও জননিন্দিত। তাদের রাজনীতি আজ অস্তিত্ব সংকটে।
করোনাকালে এখন রাজনীতি হচ্ছে অসহায়, খেটে খাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়ানো, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, বিএনপি এ দুঃসময়েও মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে যাচ্ছে। বিএনপির রাজনীতি জনমানুষের জন্য নয় উল্লেখ করে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, তাদের রাজনীতিতে ত্যাগের কোনো মহিমা নেই, আছে শুধু ভোগের উদগ্র বাসনা।
ওবায়দুল কাদের বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতির জনক বিএনপি, আওয়ামী লীগ নয়। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, কারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলণ্ঠিত করতে চায়, কারা স্বাধীনতাবিরোধীদের গাড়িতে পতাকা তুলে দিয়েছিল, এখনও কারা স্বাধীনতাবিরোধীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে তা দেশবাসী জানে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবারও বিএনপি নেতাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, স্বাধীনতার ঘোষক আর ঘোষণার পাঠক এক নয়, এ সত্যটা বিএনপিকে অনুধাবন করতে হবে। আওয়ামী লীগ নাকি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, বিএনপি নেতাদের এমন বক্তব্যের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, এটা বিএনপি নেতাদের এক ধরনের ভ্রান্তিবিলাস, এ ভাবনা দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যর্থ বিরোধী দলের নেতাদের আত্মতুষ্টি লাভের সস্তা খোরাক মাত্র। পরিকল্পিতভাবে অপপ্রচার চালিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানোর বিরুদ্ধে সকলকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
দায়ীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে সরকার: ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নির্মাণে অনিয়ম, অবহেলা ও অর্থ আত্মসাৎকারীদের ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে এগোচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে মোট ২২ জেলার ৩৬ উপজেলায় ঘর নির্মাণে নানা অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
ঘর নির্মাণে গাফিলতিসহ নানা অভিযোগে ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট পাঁচ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। আরও বেশ কিছু কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধি, ঠিকাদারসহ অন্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। যেসব ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো পুনর্র্নিমাণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ অগ্রাধিকার প্রকল্পকে বিতর্কিত করার দায় কার-এমন প্রশ্ন সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের।
জানা গেছে, গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য ঘর শুধু ঘর নয়, এটি প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প। বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে এই বিশেষ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে সবার আবেগ জড়িয়ে আছে। তাই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কোনো ধরনের ত্রুটিবিচ্যুতি, অনিয়ম, দুর্নীতি ও শৈথিল্যের ঘটনায় জড়িতদের ছাড় দেবেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন, অনিয়ম ও অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তি পেতেই হবে। কাউকে বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়া হবে না।
এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পে পরিষ্কারভাবে দুর্নীতি হয়েছে। এটা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগ বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর সঙ্গে এই আশ্রয়ণ প্রকল্পকে যুক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের উদ্যোগ বা হাইপ্রোফাইলের প্রকল্পে দুর্নীতি প্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু আমাদের দেশে প্রকল্প মানেই কিছু মানুষের সম্পদ গ্রাসের মাধ্যম। দুঃখজনকভাবে এই প্রকল্পেও এমনটাই ঘটেছে। বিষয়টি জরুরিভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। এর সঙ্গে কোনো কোনো কর্মকর্তা, ঠিকাদার বা স্থানীয় অন্য কোনো প্রভাবশালী কেউ যুক্ত থাকলে তা খুঁজে বের করতে হবে। শুধু নি¤œমানের মালামাল ব্যবহার করা হয়েছে সেই ব্যাখ্যা দিলেই চলবে না। আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের আন্তরিক উদ্যোগ খুবই প্রশংসার দাবি। কিন্তু ইদানীংকালে অসৎ আমলা, অসৎ রাজনীতিক, অসৎ ব্যবসায়ী ও অসৎ রাজনৈতিক কর্মী-এই চার পক্ষ মিলে তার উন্নয়নের সুফল ঘরকাটা ইঁদুরের মতো খেয়ে ফেলছে। বিস্ময়কর উন্নয়নের অনেক সুফলই তারা কুরে কুরে খাচ্ছে। দুর্নীতির এই ভাইরাস থেকে বাঁচতে হলে শুধু দু-একজন কর্মকর্তাকে ওএসডি বা সাসপেন্ড সমাধান নয়। একমাত্র সমাধান হলো চাকরি থেকে বরখাস্ত করে কারাগারে নিয়ে কঠিন সাজা দেওয়া। প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসনীয় কাজকে ধ্বংস করার চক্রান্তকারীরা দেশ ও মানুষের শত্রু।’
মুজিববর্ষে কেউ গৃহহীন থাকবে না-প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণা বাস্তবায়নে রূপ দিতে ইতিমধ্যে ১ লাখ ১৮ হাজার পরিবারকে ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। একসঙ্গে এত ঘর যা বিশ্বে অনন্য নজির। প্রধানমন্ত্রী উপহারের ঘর পেয়ে ভূমিহীন-আশ্রয়হীন মানুষগুলো খুশি। প্রকল্পটি বেশ সুনাম কুড়ালেও কোনো কোনো কর্মকর্তার অনিয়মের কারণে সমালোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ঘর কয়েক দিন যেতে না যেতেই ভেঙে পড়ছে। এতে ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী ও উপকারভোগীরাও। রাজনীতিবিদরাও বিষয়টিকে ভালো ভাবে দেখছেন না। এর জন্য মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা ও অসাধু ঠিকাদারই দায়ী করছেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র জানায়, মোট ২২ জেলার ৩৬টি উপজেলায় ঘর নির্মাণে নানা অভিযোগ পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। আশ্রয়ণ প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগে প্রশাসনের পাঁচ কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। ওএসডি হওয়া কর্মকর্তারা হলেন- সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে সাবেক ইউএনও (বর্তমানে উপসচিব) শফিকুল ইসলাম, বগুড়ার শেরপুরের সাবেক ইউএনও মো. লিয়াকত আলী সেখ (বর্তমানে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক), মুন্সীগঞ্জ সদরের সাবেক ইউএনও রুবায়েত হায়াত, বরগুনার আমতলীর ইউএনও মো. আসাদুজ্জামান ও মুন্সীগঞ্জ সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) শেখ মেজবাহ-উল-সাবেরিন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এ পাঁচ কর্মকর্তাকে গত কয়েক দিনে পৃথক আদেশে ওএসডি করা হয়। ইতিমধ্যে সিরাজগঞ্জের সাবেক ইউএনওর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। বাকি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় মামলা প্রক্রিয়াধীন বলে মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। যেসব উপজেলায় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল সেসব ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিদর্শন দলের সদস্যরা। তাদের প্রতিবেদনে ঘর নির্মাণে অনিয়ম ও অবহেলার চিত্র উঠে এসেছে। এ অনিয়মে জড়িত অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেছেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের স্লোগান হলো- ‘আশ্রয়ণের অধিকার, শেখ হাসিনার উপহার’। প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প। এর সঙ্গে আমাদের সবার আবেগ জড়িয়ে আছে। তাই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কোনো ধরনের ক্রটিবিচ্যুতি, অনিয়ম, দুর্নীতি ও শৈথিল্যের ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। অনিয়ম ও অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তি পেতেই হবে। কাউকেই বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়া হবে না।
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর শুরু হওয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৮০ জন ভূমিহীনকে দুই কক্ষবিশিষ্ট একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘর নির্মাণকে কেন্দ্র করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনিয়মের খবর বিভিন্ন সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কারও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে। বাকি তদন্ত রিপোর্ট পাওয়া গেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যেসব ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা পুনর্র্নিমাণের নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র জানায়, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর, কুড়িগ্রাম, বরগুনার আমতলী, বগুড়ার শেরপুর, শাজাহানপুর, হবিগঞ্জের মাধবপুর, সুনামগঞ্জের শাল্লা ও মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলায় ঘর নির্মাণে অনিয়ম, অবহেলা ও দুর্নীতির ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়াও গোপালগঞ্জের সদর উপজেলার মধুপুর আশ্রয় প্রকল্পের ঘর, নেত্রকোনার পূর্বধলা, কিশোরগঞ্জ, বগুড়াসহ মোট ২২টি জেলার ৩৬টি উপজেলা রয়েছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলেছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘর নির্মাণের বেলায় নীতিমালা মানা হয়নি। অনেক ঘরে নির্মাণে ত্রুটি রয়েছে, গুণগত মান ঠিক হয়নি। নি¤œমানের মালামাল ব্যবহার করা হয়েছে। যার কারণে ঘরের দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। অনেক পিলার ভেঙে গেছে। দেয়াল ধসে পড়েছে। নিচু এলাকায় ঘর নির্মাণ করায় সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। আবার ভূমির মালিকরাও ঘর বরাদ্দ পেয়েছে।
জানা গেছে, বসবাস শুরুর আগেই বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় সাতটি ঘর ভেঙে পড়েছে। বর্ষা মৌসুমের টানা দুই দিনের বৃষ্টিতে এসব ঘরের একপাশের মাটি খালে ধসে গেছে। সেখানে ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে ২২টি আধাপাকা ঘর নির্মাণ করা হয়। কিন্তু নতুন বাড়িতে ওঠার আগেই ঘটছে নানা বিপত্তি। হায়দার আলী, আবদুল কাদের, বাদশা মিয়া, শেফালী বেগম, নদীয়ার চাঁদ, মোকছেদ আলী, সোনা উদ্দিন ও গোলাপী বেগমের ঘরগুলো ভেঙে পড়েছে। আবুল কালাম আজাদ, বাদশা মিয়াসহ একাধিক ভুক্তভোগী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যে কোনো সময় আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাকি ঘরগুলোও ভেঙে পড়তে পারে। ভাঙন আতঙ্কে তারা দিনাতিপাত করছেন। শুধু বর্ষার বৃষ্টিতে ঘর ভেঙে পড়াই নয়, এখনো দেওয়া হয়নি বিদ্যুৎ সংযোগ। বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটও রয়েছে।
শেফালী বেগম বলেন, নতুন বাড়িতে উঠতে পারছি না। বসবাস শুরুর আগেই বাড়ির একটি ঘর ছাড়া সবই ভেঙে পড়েছে। বাকি ঘরটির দেয়ালে ফাটল ধরেছে। এটিও যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। তাই এখন কী করব ভেবে পাচ্ছি না। এ ছাড়াও কুড়িগ্রামের চিলমারী, রৌমারী উপজেলার দাঁতভাঙা, কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে, গোপালগঞ্জের সদর উপজেলার মধুপুর, বরগুনায় তালতলী উপজেলার করইবাড়িয়া ইউনিয়নের বেহেলায়, বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নের মানিকদিপা পলিপাড়া, বরিশালের আগৈলঝাড়ায় উপজেলার বাগধা ইউনিয়নের জোবারপাড় (রামদেবেরপাড়) গ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নির্মিত আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের কয়েকটি ঘরও ধসে পড়েছে। আবার কিছু কিছু প্রকল্পের এলাকা বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। নির্মাণের তিন মাস পার না হতেই গত শুক্রবার মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় বালুয়াকান্দি ইউনিয়নের বড় রায়পাড়া গ্রামের উপহারের ওই ঘরটির কিছু অংশ ভেঙে পড়ে। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে আরও কয়েকটি ঘর। এ অবস্থায় কাজের মান এবং ঘর নির্মাণের স্থান নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
জানা যায়, গত শুক্রবার সকালের দিকে ওই এলাকার উপহারের ২৭ নম্বর ঘরের বারান্দার কিছু অংশ এবং একটি কলাম (খুঁটি) ভেঙে পড়ে। ঘরের নিচ থেকে মাটি সরে যাওয়ায় এমনটা হয়েছে বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। পাশের ২৮ নম্বর ঘরটিও ঝুঁঁকিতে রয়েছে। গোপালগঞ্জে বৃষ্টিতে ভেঙে পড়েছে সদর উপজেলার মধুপুর আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর প্রথম পর্যায়ের দুটি ঘর। নির্মিত ঘরের নিচ থেকে বালু সরে গিয়ে এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা। গত মঙ্গলবার বিকালে বৃষ্টি চলাকালীন এ ঘটনা ঘটে। ভেঙে পড়া ঘরের বাসিন্দা স’মিলের মিস্ত্রি মো. ইব্রাহীম জানান, ঘটনার সময় তার স্ত্রী-সন্তানরা ঘরে ছিল না। তিনিও ছিলেন কাজে। কাজ থেকে ফিরে এসে দেখেন বারান্দাসহ ঘরের অনেকটা অংশ ভেঙে পড়েছে।
ভুক্তভোগী আরেক বাসিন্দা মাহফুজা বলেন, বৃষ্টি হলেই ঘরের পাশ দিয়ে পানি চলাচল করে এবং বালু সরে যায়। ওইদিন বিকালের বৃষ্টির মধ্যে একপর্যায়ে বালু সরে গিয়ে তার ঘরেরও অনেকটা অংশ নিয়ে ভেঙে পড়ে। প্রকল্পের বাসিন্দাদের অনেকে অভিযোগ করে বলেছেন, অন্য ঘরগুলোও নানা হুমকির মুখে রয়েছে। প্রথম পর্যায়ের এ ঘরগুলো তারা পেলেও এখনো কবুলিয়তনামা বুঝে পাননি। কিন্তু এরই মধ্যে প্রায় সব ঘরেরই দেয়াল ও মেঝে থেকে পলেস্তারা খসে পড়ছে, সামান্য বৃষ্টিতেই টিনের চালার বিভিন্ন স্থান দিয়ে পানি পড়ে, বিছানাপত্র সব ভিজে যায়, ঘরের ভিতরে পানি জমে, জানালা-দরজা সব নড়বড়ে। তাই ঝড়-বাদলের এমনদিনে এমনই নানা শঙ্কা নিয়ে তারা সেখানে বসবাস করছেন।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রীর একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হলো গরিবদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প। এই প্রকল্প কাজ শেষ হওয়ার কিছুদিন পরেই হালকা বৃষ্টিতে ধসে পড়ার দায় সরকারকেই নিতে হবে। বিশেষ করে এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিচারের আওতায় নিতে হবে। আমি দাবি করব, বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। শুধু কিছু কর্মকর্তাকে ওএসডিই কোনো সমাধান নয়।’
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত তারা মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা ও নি¤œ মাঝারি পর্যায়ের ঠিকাদার। দেশের এই মহৎ উদ্যোগকে তারাই বিতর্কিত করছে। এই কাজে ওই কর্মকর্তাদের শতকরা ১০ ভাগ লাগবে। কোনো কোনো কর্মকর্তার শতকরা ২০ ভাগ লাগে। সেটা আগেই দিয়ে দিতে হয়। যেই ঠিকাদার এই কাজ করে তাকে এ টাকা দিয়ে কাজ নিতে হয়। এরপর ওই ঠিকাদারও লাগামছাড়া কাজ শুরু করে। তারা ব্যবসা করতে গিয়ে খারাপ কাজ করে। মূলত সরকারি পর্যায়ের মধ্যম ও নি¤œ পর্যায়ের কিছু সরকারি কর্মকর্তার কারণেই এ ধরনের দুর্নীতি হচ্ছে।’




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com