জামালপুরের মাদারগঞ্জে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকা অন্তত ২৬ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য নতুন ভবন নির্মাণ হচ্ছে না। জরাজীর্ণ বিদ্যালয়ভবনগুলো এখন স্থান পেয়েছে লাকড়ি, খড়সহ বিভিন্ন পরিত্যক্ত জিনিসপত্র। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রতিবছর বিদ্যালয়গুলোর ক্ষুদ্র মেরামতের জন্য অর্থ চেয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে আবেদন পাঠানো হলেও অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে সেসব বিদ্যালয়ের পরিবর্তে অন্য বিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ আসে। এ অবস্থা শুধু মাদারগঞ্জেও নয়Ñ পুরো জেলাতেই জীরাজীর্ণ এলোমেলো অবস্থায় চলছে।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষা অফিসের গাফিলতি ও অব্যবস্থাপনার করণে চাঁদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ভবনটি নির্মিত হয়েছে একটি বাড়ির আঙ্গিনায়। অথচ দুই কিলোমিটার দূরে ফসলি জমিতে ওই বিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড টানিয়ে রাখা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, ১৯৮৮ সালে বিদ্যালয়টি পৌর এলাকার চাঁদপুরের প্রয়াত শিক্ষক জুন্নুর আহম্মদ সাদীর বাড়িতে স্থাপিত হয়। ২০১৩ সালে বিদ্যালয়টি সরকারি হলেও সেখানে নতুন ভবন নির্মিত হচ্ছে না। জরাজীর্ণ ভবনটির সামনে ১শ ৫জন শিক্ষার্থীকে পাঠদানের জন্য ১৪-১৫ ফুট দীর্ঘ এবং ৮ ফুট প্রস্থের একটি টিনের ঘরে ৩টি কক্ষ করে ১০-১২টি বেঞ্চ রাখা হয়েছে।নতুন ভবন নির্মাণ না হওয়ার কারণ সম্পর্কে শিক্ষা অফিসের এটিও হারুনুর রশিদ জানান, বাড়ির আঙ্গিনায় ৩ শতাংশ জায়গায় নতুন ভবন নির্মাণ সম্ভব নয়। বিদ্যালয়টির নামে ৩০ শতাংশ জায়গা আছে দুই কিলোমিটার দূরে। সেখানে ভবন নির্মিত হলে শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে না। এ কারণে ওই বিদ্যালয় ভবনের জন্য অর্থ বরাদ্দ এলেও তা ফেরত গেছে।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা অফিসের একজর এটিও জানান, ভবন নির্মাণ না হলেও জরাজীর্ণ বিদ্যালয়গুলোর ক্ষুদ্র মেরামতের বরাদ্দ চেয়ে শিক্ষা অফিস থেকে প্রতি বছর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে আবেদন পাঠানো হয়। কিন্তু অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে যে বিদ্যালয়গুলোর জন্য চাহিদাপত্র পাঠানো হয়Ñ সে বিদ্যালয়গুলোর পরিবর্তে যেসব বিদ্যালয় মেরামতের তেমন প্রয়োজন নেই সেসব বিদ্যালয়ের নামে টাকা বরাদ্দ আসে। নাম না প্রকাশের শর্তে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, এসবের জন্য শিক্ষকদের মধ্যে একটি দালাল চক্র কাজ করছে। তারা সম্ভবত ডিজি অফিসে কর্মরত একজন কর্মচারীর যোগসাজসে উপজেলা শিক্ষা অফিসার এবং জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের স্বাক্ষরযুক্ত চাহিদাপত্র পরিবর্তন করে ফেলে। একই ধরনের ঘটনা নতুন ভবন নির্মাণের বরাদ্দের ক্ষেত্রেও হয়তো ঘটছে। শিক্ষকরা জানান, ছাত্র উপস্থিতি কম বা কিন্ডারগার্টেনের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ভর্তি করে হাজিরা খাতায় ভুয়া উপস্থিতি দেখানো হয় এমন বিদ্যালয়ের জন্যও দ্বিতল ভবন নির্মাণের কাজ চলছে।তারা জানান, ৩ বছর আগে শিক্ষা অফিসারের স্বাক্ষর জাল করে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে আসায় একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সম্ভবত দুই তিনজন শিক্ষক এখন এসব জালিয়াতির সাথে যুক্ত।এছাড়াও মাদারগঞ্জ উপজেলার বাকুরচর, পূর্ব জটিয়ারপাড়া, বানিকুঞ্জ, চরচাঁদপুর ওসমান গণি, চরকয়ড়া, গুনেরবাড়ি ও সোলায়মান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অন্তত ২৬টি বিদ্যালয়ের অবস্থা একই রকম।বরাদ্দের চাহিদাপত্র পরিবর্তন হয়ে অন্য বিদ্যালয়ের নামে বরাদ্দ আসার বিষয়ে কিছু জানেন না জানিয়ে জামালপুর জেলা শিক্ষা অফিসার মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমার কাছে যে কাগজ আসে তাতে শুধু বরাদ্দের পরিমাণ উল্লেখ থাকে।’ বরাদ্দপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ের নামসহ তালিকা আসে উপজেলা শিক্ষা অফিসগুলোতে। শিক্ষা অফিসারের স্বাক্ষরকারা চাহিদাপত্র পরিবর্তিত হয়ে অন্য বিদ্যালয়ের নামে ক্ষুদ্র মেরামতের বরাদ্দ আসার ব্যাপারে তাকে কেউ কিছু জানায়নি বলেও তিনি জানান। মাদারগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ খোরশেদ আলম জানান, উপর থেকে কীভাবে তালিকা পরিবর্তন হয় তা তিনি জানেন না। ভুক্তভোগী ২৬ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য নতুন ভবন নির্মাণসহ অদৃশ্য হাতে বলদে যাওয়া বিদ্যালয়ের ক্ষুদ্র নির্মাণের চাহিদাপত্র পরিবর্তনকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। অপরদিকে সরিষাবাড়ি উপজেলার চরাঞ্চলের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের করুণ অবস্থা বিরাজ করলেও বরাদ্দপ্রাপ্ত অর্থ বিদ্যালয়ে পৌঁছার আগেই শেষ হয়। অনেক সময় বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটি কিংবা প্রধান শিক্ষকগণ জানেই না যে তার বিদ্যালয়ের জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়েছিলো। গোপনে সমুদয় অর্থ উত্তোলন করে নেয়া এক শ্রেণির দালাল শিক্ষকরা।উপজেলার দামোদরপুর স্কুলের শিক্ষক আফজাল হোসেন জানান, বেঞ্চ ভেঙে গেছে অনেক আগেই। চাহিদাপত্র পাঠালেও কোন অর্থ বরাদ্দ আসছে না। আওনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির অবস্থা করুণ। বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশের চাল পর্যন্ত মাটি ভরাট হয়ে যাবার ফলে অনেকটা অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্কুলের ভবনটি। বারাদ্দার ঢালাই ভেঙে গর্ত হয়েছে অনেক আগেই। বিদ্যালয়টি সংস্কার করা প্রয়োজন বলে এলাকার একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করেন।এছাড়াও একই অবস্থা বিরাজ করছে জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, সরিষাবাড়ীর চরাঞ্চলের স্কুলগুলোর। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার ফলে অবস্থা আরো জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। প্রশাসনের কর্মকর্তা ব্যক্তিদের নজরদারি না থাকায় দীর্ঘদিন এ অবস্থা আরো ঝূকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের এহেন অপকর্মের হাত থেকে রক্ষা পেতে চায় ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীবৃন্দ।