শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৫৪ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
ধনবাড়ীতে আধুনিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে শুরু প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী রৌমারীতে বড়াইবাড়ী সীমান্ত যুদ্ধ দিবস পালিত মাধবদীতে জ্যান্ত কই মাছ গলায় ঢুকে কৃষকের মৃত্যু বদলগাছীতে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী কালীগঞ্জে কৃষক মাঠ দিবস ও কারিগরি আলোচনা লতিফ মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবিতে মানববন্ধন নড়াইলের কালিয়া উপজেলার শ্রীনগর গ্রামে ভ্যানচালককে পুলিশি হয়রানির প্রতিবাদে মানববন্ধন বরিশালে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী মেলার উদ্বোধন হাতিয়ায় দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থার ক্যাম্পাসে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদুর রহমান বেলায়েত স্মৃতি কর্ণার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র উদ্বোধন গজারিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আমিরুল ইসলামের পক্ষে ছাত্রলীগের গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ

ব্ল্যাক রাইস চাষে অভাবনীয় সাফল্য পেলেন কুমিল্লার কৃষক মনজুর

বাসস :
  • আপডেট সময় শনিবার, ১৭ জুলাই, ২০২১

জেলায় অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেছে ব্ল্যাক রাইস (কালো রঙের চালের ধান) চাষে। মনজুর নামের এক কৃষক ২০১৮ সালে প্রথম বারের মত কুমিল্লায় মাত্র ৫ শতক জমিতে ব্ল্যাক রাইস চাষ করেন। এতে তিনি সাফল্য পান। পরের বছর ১০ শতক জমিতে ব্ল্যাক রাইস চাষ করে দ্বিগুণ সফলতা অর্জন দেখে এবার এগিয়ে এসেছেন আরো ১৫ জন কৃষক। এবার বেশী চাষ হয়েছে ১৪শ’ ৯৫ শতক জমি। অর্থাৎ গেলোবার যেখানে চাষ হয়েছে ১০ শতক এবার সেখানে হয়েছে ১৫শ’ শতক জমি।
বছর বছর এই চাষে সফলতা পাওয়ায় মনজুর ব্ল্যাক রাইস চাষ করে পেয়েছেন কৃষি পদকও। চলতি বছরের ২৭ জুন ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনজুরকে এই পদক দেন।
মনজুর বাসসকে বলেন, প্রতি বছরের জুলাই মাস থেকে ব্ল্যাক রাইসের চারা রোপনের কাজ শুরু হয়। এখন জমি প্রস্তুতির কাজ চলছে। জুলাই ৩০ তারিখ থেকে জমিতে চারা রোপনের কাজ শুরু করে নভেম্বরে প্রথম সপ্তাহে ফসল গড়ে তোলা হবে। মনজুর চলতি মৌসুমে ৫০ শতক জমিতে এই ব্ল্যাক রাইস চাষ করবেন বলে জানিয়েছেন।
কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার মনাগ্রাম মাঠে এই ধানের চাষ করা হচ্ছে। কৃষক মনজুর হোসেন বাসসকে বলেন, কৃষি গবেষক ড. আখতার হামিদ খান ধান উৎপাদনে কুমিল্লার চেহারা পাল্টে দিয়েছেন। ড. খানের কাজ দেখে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন। কালো চাল ডায়াবেটিস, ¯œায়ুরোগ ও বার্ধক্য প্রতিরোধক। এতে ভিটামিন, ফাইবার ও মিনারেল রয়েছে। তাই কালো চাল উৎপাদনে মনোযোগী হয়েছেন। অনেকে বিদেশ থেকে উচ্চ দামে চাল কিনে খায়। ঢাকায়ও বিদেশি কোম্পানিগুলো এই চাল হাজার টাকায় কেজি বিক্রি করলেও স্থানীয় কৃষকরা তা তিনশত টাকায় বিক্রি করতে পারবেন বলে জানান। এ চালের উৎপাদন সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া গেলে তা দেশের কৃষি অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভুমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করছেন।
এ বিষয়ে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও কুমিল্লা ময়নামতি মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. তৃপ্তিশ চন্দ্র ঘোষ বাসসকে বলেন, কালো চালে অ্যাস্থসায়ানিন ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের পরিমাণ বেশি থাকে। হৃদযন্ত্রের সুস্থতা বজায় রাখা, মস্তিস্কের কার্যকারিতা বাড়ানো ও শারীরিক ব্যথা নিরাময়ে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বিশেষ কার্যকর বলে জানান।
মনজুর বিভিন্ন দেশের সাত প্রকার কালো চালের ধান সংগ্রহ করে চাষ করছেন। কালো চাল উৎপাদন বাড়লে কৃষিতে নতুন গতি আসবে বলে তিনি মনে করেন। মাঠে ভারতের আসাম, ইন্দোনেশিয়া, চায়না, জাপান, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের সাত প্রকার কালো চালের ধান লাগানো হবে। চাল কালো হলেও সব গুলো ধানের পাতার রঙ বেগুনি নয়। অনেক গুলো সবুজ রঙের। কৃষক মনজুর হোসেন জেলার আদর্শ সদর উপজেলার মনাগ্রাম এলাকার মৃত মোহাম্মদ আলীর ছেলে।
সরেজমিনে মনাগ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কৃষক মনজুর তার বাড়িসংলগ্ন নিজের জমিতে এবার আমন মৌসুমে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভারত, জাপান, চীন ও ভিয়েতনাম- এ সাতটি দেশ থেকে সংগ্রহ করা কালো চালের বেগুনী ও সবুজ পাতার ধানের চাষ করার জন্য জমি প্রস্তুত করছেন। চলতি মাসের ৩০ তারিখ থেকে চারা রেপন কাজ শুরু করবেন। কৃষক মনজুর বলেন, সাত জাতের ধান ছাড়াও লাল চালের (রেড রাইস) ধান, ভারতের বেগুনী স্বর্ণা ধান, ফিলিপাইনের ব্ল্যাক বাঁশমতি ধানসহ দুর্লভ নানা জাতের ধানের চাষ করেছেন।
কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা ও গবেষকরা বলছেন, কালো চাল দেখতে যেমন কালো, এ চালের ভাতও কালো এবং পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। সুগন্ধিযুক্ত দামি ও স্বাস্থ্যকর এ কালো চাল সারা পৃথিবীতে খুবই সমাদৃত।
মনাগ্রমের কৃষক রফিক উল্লাহ ভূঁইয়া, গৌতম দাস, বিল্লাল হোসেন বাসসকে বলেন, কৃষির উন্নয়নে কৃষকদের পথ দেখাচ্ছেন কৃষক মনজুর। জমিতে চারা রোপণের পর থেকে সবসময় তারা কৃষক মনজুরের ব্ল্যাক রাইসের জমি দেখে আসছেন। তারা বলেন, বাজারে দেশিয় জাতের প্রতিমণ ধানের মূল্য সাড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। এক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে মোটামোটি লাভ হয়। তাই আগামীতে আমরা কালো চালের ধানের চাষ করবেন বলে জানান।
স্থানীয় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা (এসএএও) মো. ছালেকুর রহমান বাসসকে জানান, কৃষক মনজুর হোসেন সাতটি দেশে উৎপাদিত ব্ল্যাক রাইস-এর বীজ সংগ্রহ করে জমিতে চাষ করেছেন। এছাড়া বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) থেকে সর্বশেষ অবমুক্ত করা নতুন জাতের ধানও তার জমিতে চাষ হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে আমন মৌসুমে স্বল্প পরিসরে পাঁচটি দেশের ব্ল্যাক রাইস চাষ করে ভালো ফলন পেয়েছেন।
বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ড. মো. মেহেদী মাসুদ জানান, কৃষক মনজুর যা করেছেন তা ব্যতিক্রম, তিনি বিজ্ঞানীদের কাজ করছেন। কালো চাল কম গ�াইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) সম্পন্ন, যা গম ও অন্যান্য ফলের জিআই হতে অনেক কম। ব্ল্যাক রাইসে অ্যান্থোসায়ানিন নামক একটি উপাদান আছে, এ কারণে এই ব্ল্যাক রাইস পুরোটাই কালো। আর অ্যান্থোসায়ানিন এমন একটি এন্টিঅক্সিডেন্ট যা ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। আমরা প্রতিনিয়ত যে খাবার খাই তা থেকে রক্তের মধ্যে যে ধরনের ফ্রি রেডিকেল তৈরি হয় তা এই এন্টিঅক্সিডেন্ট ধ্বংস করে দেয়। পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ কালো চালের উৎপাদন ভালো হলে এবং তা দেশব্যাপী কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া গেলে মানুষের রোগ প্রতিরোধের পাশাপাশি তা দেশের কৃষি অর্থনীতিতেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) আঞ্চলিক কার্যালয় কুমিল্লার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আব্দুল মোতালেব বাসসকে বলেন, ব্ল্যাক রাইসের এ জাতগুলো ব্রি-গাজীপুরে প্রেরণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এ জাতগুলোর বিভিন্ন গুণাবলি ও রোগ-পোকার প্রতিক্রিয়া নির্ণয়ের পর কাঙ্খিত গুণাবলিসম্পন্ন প্রতীয়মান হলে অবমুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে এবং ব্ল্যাক রাইসের উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান বাসসকে বলেন, ব্ল্যাক রাইসের বীজ কুমিল্লাসহ সারাদেশে আমরা ছড়িয়ে দিতে চাই। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর একই সাথে কাজ করে যাচ্ছে।
কৃষক মনজুর হোসেন আরও বলেন, ব্ল্যাক রাইস এর ধানের পাতার রঙ সবুজ, কোনটির বেগুনী। জাপান ও অন্যান্য দেশ থেকে আমাদের দেশে আমদানি করা এক কেজি কালো চালের (ব্ল্যাক রাইস) মূল্য এক হাজার টাকা। তাই বিভিন্নভাবে মোট সাতটি দেশ থেকে ব্ল্যাক রাইসের বীজ সংগ্রহ করে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ নিয়ে চারা উৎপাদন করা হয়েছে চলতি মাসের শেষের দিকে চারা রোপন কাজ শুরু হবে।
তিনি সকল জাতের ব্ল্যাক রাইসের ভালো ফলনের আশা প্রকাশ করে বাসসকে বলেন, পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ দুর্লভ ও দামী ব্ল্যাক রাইসের বীজ দেশের কৃষকদের মাঝে স্বল্প মূল্যে ছড়িয়ে দিতে চাই। উদ্ভাবনী এ কৃষক ব্যক্তিগত উদ্যোগে ধান, চাল, গমের বীজ এবং সরিষা ও পামওয়েলের গুণগতমান পরীক্ষার জন্য একটি গবেষণাগার (ল্যাব) স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে সরকারের নিকট সহায়তা চেয়েছেন।
এবিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বছরব্যাপী ফল প্রকল্পের পরিচালক ও ধান গবেষণায় বিশেষজ্ঞ ড. মেহেদী মাসুদ বলেন, কালো চালের ভাত সাধারণ ভাতের অর্ধেক খেলে পেট ভরে যাবে। ফাইবার বেশি থাকায় তা সময় নিয়ে হজম হবে। যা ডায়াবেটিস রোগীর জন্য উপকারী। এদিকে যাদের পেটে চর্বি রয়েছে তাদেরও উপকার হবে। কৃষক মনজুর হোসেনের কালো জাতের ধানের চাষ সারা দেশের মধ্যে ব্যতিক্রম। আমি ইন্দোনেশিয়া থেকে কালো ধান এনে তাকে ২৭টি দিয়েছিলাম। সে সেখান থেকে বীজ তৈরি করে ধানের পরিমাণ বাড়িয়েছে। কালো চালে গ�াইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) অনেক কম। জিআই যত কম হয় সেই খাবার শরীরে জন্য তত উপকারী। গ�কোজের জিআই ১০০ ভাগ, চিনির ৮০ভাগ, সাদা চালের ভাতের ৭২ ভাগ, গমের আটার রুটিতে ৬৫ ভাগ আর কালো চালের জিআই মাত্র ৪২ ভাগ। কালো চালের বিষয়টি দেশে গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে। তিনি বলেন, কৃষিমন্ত্রী মহোদয়ও এই চাল উৎপাদনে তাগিদ দিয়েছেন। কালো চাল ভালো উৎপাদন হলে রোগ প্রতিরোধের সাথে তা কৃষি অর্থনীতিতেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে জানান।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com