জাহান্নাম হলো আজাব তথা শাস্তির আবাসস্থল। জাহান্নাম হলো কষ্টের অতল দরিয়া। জাহান্নামের আজাবও কষ্ট কখনো শেষ হবার নয়। আল্লাহ তায়ালা কাফের ও পাপিষ্ঠদের কৃতকর্মের প্রতিদান হিসেবে জাহান্নাম তৈরি করে রেখেছেন। পবিত্র কুরআনের অসংখ্য স্থানে আল্লাহ তায়ালা জাহান্নামের পরিচয়ের সাথে সাথে জাহান্নামের শাস্তির ভয়াবহতার চিত্রও তুলে ধরেছেন। যদিও মানুষ জাহান্নাম দেখেনি তবুও জাহান্নামের শাস্তির বর্ণনা শুনে ভয় পাচ্ছে। তবে জাহান্নাম আরো ভয়াবহ যা মানুষের কল্পনারও ঊর্ধ্বে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন : হে মুমিনগণ তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। (আল-কুরআন, সূরা আত-তাহরিম : ৬)
আল-কুরআনে জাহান্নামকে একেক জায়গায় একেক নামে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে যে নামেই বলা হোক তার মাধ্যমে জাহান্নামের শাস্তি ও চিত্র বর্ণনা করাই উদ্দেশ্য। আর কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হলে এবং তাঁর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করলে তাকে আগুনে নিক্ষেপ করবেন; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং তার জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি রয়েছে (সূরা নিসা : ১৪)। এ আয়াতে জাহান্নামকে নার হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখার ব্যাপারে যে বিধান দেয়া হয়েছে যে তা লঙ্ঘন করবে তার জন্য কঠোর শাস্তি রয়েছে। কেননা সে আল্লাহর হুকুমকে পরিবর্তন ও আল্লাহর বিধানের বিরোধিতা করেছে। তখনই কেউ এরূপ করতে পারে যখন সে আল্লাহর নির্দেশের ওপর অসন্তুষ্ট থাকে। এ জন্য আল্লাহ তাকে চিরস্থায়ী লাঞ্ছনা দ্বারা শাস্তি দিবেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ কপট ও অবিশ্বাসী সবাইকেই জাহান্নামে একত্র করবেন (সূরা নিসা : ১৪০)। এ আয়াতে জাহান্নামকে ‘জাহান্নাম’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কখনো জাহান্নামকে ‘জাহিম’ তথা প্রচ- উত্তপ্ত আগুন বলা হয়েছে। মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘যারা অবিশ্বাস করে এবং আমার নিদর্শনাবলিকে মিথ্যা বলে, তারা জাহিমবাসী’ (সূরা মায়িদা : ১০)।
আবার কখনো ‘সাঈর’ তথা প্রজ্বলিত (অগ্নি) শিখা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফেরদের প্রতি অভিসম্পাত করেন এবং তাদের জন্য সাঈর তথা প্রজ্বলিত (অগ্নি) শিখা তৈরি করে রেখেছেন’ (সূরা আহযাব : আয়াত ৬৪)। কখনোবা জাহান্নামকে ‘সাকার’ তথা ঝলসানো আগুন বলে আখ্যায়িত করে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘যে দিন তাদের উপুড় করে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের দিকে; (সে দিন বলা হবে,) ‘সাকার (জাহান্নামে) যন্ত্রণা আস্বাদন করো’ (সূরা কামার : ৪৮)। আর সাকার জাহান্নামের একটি নাম। সাকার জাহান্নামের উত্তাপ এবং কঠিন শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করো।
জাহান্নামের অপর একটি নাম ‘হুত্বামাহ’ তথা পিষ্টকারী। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘কখনো না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে পিষ্টকারীর মধ্যে। আপনি কি জানেন, পিষ্টকারী কী? এটা আল্লাহর প্রজ্বলিত অগ্নি’ (সূরা হুমাযাহ : আয়াত ৪-৬)। জাহান্নামের অন্যতম একটি নাম। হুতামাহ অর্থ ভেঙে চূরমার করা। মুহাম্মাদ বিন কাব রহ: বলেন : আগুন সারা শরীর খেয়ে ফেলবে এমনকি যখন তা অন্তরসহ কণ্ঠনালী পর্যন্ত পৌঁছে যাবে তখন পুনরায় আবার শরীরের দিকে ফিরে আসবে। তারা এ আগুনে বন্দী হয়ে থাকবে, সেখান থেকে বের হওয়ার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে যাবে।
জাহান্নামের সব দরজা ও পথ বন্ধ করে দেয়া হবে এবং তাদের লোহার পেরেকের সাথে বেঁধে দেয়া হবে যা লম্বা লম্বা স্তম্ভের মতো। যার ফলে জাহান্নাম থেকে বের হওয়ার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে যাবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যারা পাপ কাজ করেছে তাদের বাসস্থান হবে জাহান্নাম। যখনই তারা সেখান থেকে বের হতে চাইবে, তখনই তাদের সেথায় ফিরিয়ে দেয়া হবে এবং তাদের বলা হবে, আগুনের স্বাদ গ্রহণ (শাস্তিভোগ) করো যা তোমরা মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে’ (সূরা সাজদাহ : ২০)। জাহান্নামে লম্বা লম্বা খুঁটি থাকবে যাতে বেঁধে জাহান্নামিদের শাস্তি দেয়া হবে। ইবন আব্বাস রা: বলেন : তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে। তারপর খুঁটির সাথে বাঁধা হবে এবং গলায় বেড়ি পরানো হবে। অতঃপর জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে (তাফসিরে ইবন কাসির)।
আরেকটি নাম ‘লাযা’ তথা লেলিহান অগ্নিশিখা। লাযা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কখনোই নয়। নিশ্চয় এটা লেলিহান অগ্নি, যা চামড়া তুলে দিবে। সে (লেলিহান অগ্নি) সেই ব্যক্তিকে ডাকবে যে সত্যের প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছিল ও বিমুখ হয়েছিল’ (সূরা মাআ’রিজ : আয়াত ১৫-১৭)। এটা হলো জাহান্নাম। এখানে তার প্রখর উষ্ণতার কথা বর্ণিত হয়েছে। মাংস এবং চামড়াকে জ্বালিয়ে ছাই করে দিবে এবং মানুষ কেবল অস্থির কঙ্কালসার হয়ে অবশিষ্ট থাকবে। জাহান্নামের আরেকটি নাম ‘দারুল বাওয়ার’ তথা ধ্বংসের ঘর। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা আল্লাহর নিয়ামতকে কুফরিতে পরিণত করেছে এবং স্বজাতিকে সম্মুখীন করেছে ধ্বংসের আলয়ে-দোজখের? তারা তাতে প্রবেশ করবে, সেটা কতই না মন্দ আবাস’ (সূরা ইবরাহিম : আয়াত২৮-২৯)। যারা আল্লাহ্ তায়ালার নেয়ামতের পরিবর্তে কুফর অবলম্বন করেছে এবং তাদের অনুসারী জাতিকে ধ্বংস ও বিপর্যয়ের অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে? তারা জাহান্নামে প্রজ্বলিত হবে। জাহান্নাম অত্যন্ত মন্দ আবাস। এখানে মূলত যাবতীয় কাফের ও মুশরিকরা নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পরিবর্তে অকৃতজ্ঞতা, অবাধ্যতা ও নাফরমানি করেছে তাদের বোঝানো হয়েছে। রাসূল সা: বলেছেন, তোমরা আল্লাহর কাছে জাহান্নামের আগুন থেকে আশ্রয় কামনা করো জাহান্নামের অধিবাসীরা ধ্বংস হোক (সুনানে আবুদাউদ : ৪৭৫১৪)। জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের বিশেষ চারটি মাধ্যম রয়েছে। প্রথম দুটি ব্যক্তির নিজ সাধনা আমল ও দোয়ার মাধ্যম। অপর দুটি মহান রাব্বে কারিমের করুণা ও সন্তুষ্টির ওপর নির্ভরশীল। অতএব আমাদের সবার উচিত জাহান্নামের ভয়াবহ আজাব থেকে রক্ষা পেতে সব ধরনের পাপ থেকে মুক্ত থাকা ও তাসবিহ-তাহলিল, জিকির আজকার ও ইসতিগফারে মশগুল থাকা। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে জাহান্নামের ভয়াবহতম শাস্তি থেকে হিফাজত করে জান্নাত লাভে তাঁর বিধিবিধান যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক