শ্যামলীর একটি গ্যারেজে চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে কাজে আসে রাসেল মিয়া (১২)। সে গ্রামের একটি স্কুলে পড়ত। দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকার কারণে তার বাবা রুহুল আমিন ছেলেকে দিয়ে গেছেন কাজ শেখার জন্য। রাসেলের কাজের পারিশ্রমিক নির্ধারিত হয়েছে তিন বেলা খাওয়া ও থাকা। বিনিময়ে সে গ্যারেজে বড় মেকারদের সঙ্গে সহকারী হিসেবে পাশে থাকবে। এভাবে করোনা পরিস্থিতির মধ্যে দেশে বহু শিশু শ্রম বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছে। পরিবারের অসচ্ছলতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা এবং কারখানাগুলো লোকসানের কারণে কম বেতনে শিশু শ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছে। এখন আগের চেয়ে বেশি শিশু শ্রমিক কম মজুরিতে পাওয়া যাচ্ছে। সরকার শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে সরে আসতে ২০১৬ সালের প্রথম টার্গেট অর্জনে ব্যর্থ হয়ে ২০২১ সাল পর্যন্ত নতুন টার্গেট নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাশেম ফুডস লিমিটেডের ছয়তলা ভবনের অগ্নিকাণ্ডে শিশুশ্রমের ভয়াবহ রূপ আবার সামনে উঠে আসে। কারখানাটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৫২ শ্রমিকের মৃত্যু হয়, যার অধিকাংশই ছিল শিশু-কিশোর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুকে কাজে নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। দেশে করোনায় পরিস্থিতিতে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। মহামারির আগেও দেশে বিভিন্ন সেক্টরে উল্লেখযোগ্য শিশু শ্রমিক থাকলেও তারা সরকারি বা এনজিও পরিচালিত স্কুলেও যেত। কিন্তু মহামারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় এবং পরিবারে আর্থিক অনটনের কারণে দরিদ্র এই শিশুরা পুরো সময় কাজে নিয়োজিত হয়েছে, ফলে স্কুলে ফিরে যাওয়া তাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত দেশে সাড়ে ৩৪ লাখ শিশু কর্মরত ছিল। এর মধ্যে প্রায় ১৭ লাখ শিশুর কাজ শিশু শ্রমের আওতায় পড়ে। আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ছিল ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু। ২০২০ সালের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে এবং আইএলওর অর্থায়নে দেশে শিশু শ্রম নিয়ে আরেকটি জরিপ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মহামারির কারণে এ কাজটি শুরু হয়নি।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের উদ্যোগে ‘কোভিড-১৯-এর প্রভাবে ঢাকায় কর্মরত শ্রমজীবী শিশুদের অবস্থা যাচাই’ শীর্ষক জরিপ থেকে জানা যায়, করোনায় অনেক শিশু পেশা পরিবর্তন করেছে। যেসব শিশু আগে কাজ করত এমন ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশের এখন কাজ নেই। আর এমন ৩১ শতাংশের ওপর শিশুগুলোর পরিবার নির্ভরশীল। এদের মধ্যে ৩২ শতাংশ মহামারিতে কোনো সরকারি-বেসরকারি সাহায্যও পায়নি।
সরকার মালিক, শ্রমিক ও সুশীল সমাজের সঙ্গে কথা বলে ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি কাজ ঘোষণা করলেও এসব কাজে এখনো শিশুদের কাজ করতে দেখা যায়। এসবের মধ্যে—অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে যে শিশুরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গ্রিজ, কেরোসিন, মবিল ব্যবহার করে যন্ত্রপাতির কাজ করছে তারা প্রায়ই কোনো না কোনো শারীরিক আঘাত পাচ্ছে। এতে তাদের চামড়ায় প্রদাহ হচ্ছে। হাতে গ্যাংগ্রিন হচ্ছে, শ্বাসনালির সংক্রমণ এবং হাঁপানি হচ্ছে। বিড়ি ও সিগারেট তৈরির কারখানায় যারা কাজ করছে তারা ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হয়। ইট ও পাথর ভাঙার কাজ করে যে শিশু তারাও প্রায় দিন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।
তাদের শ্রবণশক্তি এবং দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ বা লেদ মেশিনে যারা কাজ করছে তাদের শিরায় রক্ত জমাট, চোখের প্রদাহ ও দৃষ্টিশক্তির সমস্যায় ভুগছে। ম্যাচ তৈরির কারখানায় কর্মরত শিশুরা আঙুলে ঘা, বাতজনিত সমস্যা ও শ্বাসতন্ত্রেও রোগ হয়। আর প্লাস্টিক তৈরির কারখানার শিশুদের শুষ্ক কাশি, নিউমোনিয়া, হাঁপানি, ফুসফুসের প্রদাহ হয়। সাবান তৈরির কারখানার কাজে শিশুর চুলকানি, হাত-পায়ের আঙুলে ক্ষত, কাশি, নিউমোনিয়া ও হাঁপানি হয়। ট্রাক বা টেম্পো ও বাসের হেল্পার শিশুরা সড়ক দুর্ঘটনা, ওজন কমা, কোষ্ঠকাঠিন্য, শ্রবণশক্তি হ্রাস, শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। বিস্কুট ফ্যাক্টরি বা বেকারিতে কর্মরত শিশুদের মাথাব্যথা, বমি হওয়া, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, ক্ষুধামন্দা, পাকস্থলীতে ঘা, যকৃতে প্রদাহ হয়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুছ সহিদ মাহমুদ বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চাইলেও সরকার তা পারবে না। শিশুশ্রম বন্ধে সরকার ২৮৪ কোটি টাকার প্রকল্পও গ্রহণ করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল, ১ লাখ শ্রমিককে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে সরিয়ে আনা, এটি বাস্তবায়ন করার কথা ছিল বিভিন্ন বাছাইকৃত এনজিওর। ২০২১ সালে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো এনজিওর বাছাইয়ের কাজই শেষ হয়নি।