কুমিল্লা জেলার ক্ষুদ্র কিন্তু জনপ্রিয় ই-কমার্স উদ্যোক্তা মো. আরিফ। দেশের সর্ববৃহৎ ই-কমার্স সংযোগকারী এটুআই উদ্ভাবিত একশপের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের পণ্য ক্রেতার দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয় তার প্রতিষ্ঠান। কিন্তু, এক্ষেত্রে বড় বাঁধা ক্রেতার অবস্থান চিহ্নিত করা। তাই, পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে ক্রেতাদের অবস্থান নিশ্চিত করতে এটুআই দেশব্যাপী করোনা সংকটকালীন পরিস্থিতিতে দেশের তরুণদের মাধ্যমে এটুআই, প্রেনিউর ল্যাব এবং গ্রামীণফোনের সহায়তায় ডিজিটাল ম্যাপিং কার্যক্রম গ্রহণ করে।
বাসসে’র সাথে আলাপকালে আরিফ বলেন, ‘অনেক ক্রেতা আমার একশপ কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন পণ্যের জন্য অনলাইনে অর্ডার করেন। সে ক্ষেত্রে আমার দোকানের পণ্য সরবরাহকারীরা গুগল ম্যাপের মাধ্যমে ক্রেতার অবস্থান নিশ্চিত করে তাদের দোরগোড়ায় পণ্য পৌঁছে দেন।
তিনি জানান, স্থানীয় অনেক ক্রেতাই তাদের লোকেশন (অবস্থান) হিসেবে নিজেদের আসল ঠিকানার পরিবর্তে আশে পাশের বড় কোনো দোকান, স্কুল, হাসপাতাল বা ক্লিনিকের নাম ব্যবহার করে থাকেন। পণ্য সরবরাহকারীরা স্যাটেলাইট ভিত্তিক রেডিও নেভিগেশন সিস্টেম-গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) ব্যবহার করে পণ্য সরবরাহ করেন। কিন্তু সেখানে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক জায়গার তথ্য উল্লেখ নেই। তাই, প্রথমদিকে তাদের প্রায়ই ক্রেতাদের অবস্থান নিশ্চিত করতে হিমশিম খেতে হতো এবং পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রেও অনেক সময় নষ্ট হতো। এর ফলে অনলাইনে অনেক ক্রয়াদেশ (অর্ডার) কমে যেতে লাগলো।
আরিফ ইতোমধ্যে তার অনলাইন ব্যবসায় অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছেন। তাই, পণ্য সরবরাহের সমস্যা তাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। এদিকে, বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের কারণে সারাদেশে অনলাইন ব্যবসাও তুঙ্গে।
আরিফ বলেন, ‘আমি যখন আমার অনলাইন ব্যবসা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। আমার পণ্য সরবরাহকারীরা যখন গুগল ম্যাপ ব্যবহার করে পণ্য সরবরাহ করতে অনেকাংশেই ব্যর্থ হচ্ছিল; ঠিক তখনই ই-মেইলের মাধ্যমে ‘ডিজিটাল ম্যাপ’ ব্যবহার করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পণ্য সরবরাহের উপর একটি শর্ট কোর্স করার প্রস্তাব পাই।’
এই কোর্সের মাধ্যমেই আরিফ জানতে পারেন সরকারের এটুআই প্রোগ্রাম ’বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জ’ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে সারাদেশের হাসপাতাল, ফার্মেসি, বড় দোকান এবং সুপার শপের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ গুগল ম্যাপে যুক্ত করেছে।
এই কোর্সের শিক্ষা আরিফ তার পণ্য সরবরাহকারী জনবলের সাথে শেয়ার করেন। ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে গুগল ম্যাপে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান যুক্ত হওয়ায় পণ্য সরবরাহকারীরা খুব সহজেই ক্রেতাদের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেন। বর্তমানে তারা অল্প সময়ের মধ্যেই পণ্য সরবরাহ করতে সক্ষম হচ্ছেন। এখন আরিফের অনলাইন ব্যবসাও জমে উঠেছে।
আরিফের এই অনলাইন ব্যবসার উন্নতি তাকে ‘ডিজিটাল এক্সপ্রেস’ নামে আরেকটি অনলাইন ভিত্তিক কুরিয়ার সার্ভিস চালু করতে উৎসাহ জোগায়। আরিফ বলেন, ‘আমি যখন দেখলাম নতুন গুগল ম্যাপ ব্যবহার করে খুব সহজেই পণ্য ডেলিভারি করতে পারছি। তখন আমি এই কুরিয়ার সার্ভিস চালুর সিদ্ধান্ত নেই। এই নতুন ম্যাপের মাধ্যমে বর্তমানে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও পার্সেল পৌঁছে দিতে সক্ষম হচ্ছি।’ আরিফের সফলতায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে কুমিল্লা জেলার অনেকেই ই-কমার্স উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছেন বলে জানান তিনি।
সাধারণত শহরের অধিবাসীরা গুগল ম্যাপ ও ওপেন স্ট্রিট ম্যাপ ব্যবহার করে অনেক বেশি সুবিধা পান। কিন্তু, প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধিকাংশ জায়গা এই ক্যাম্পেইনের আগে গুগল ম্যাপে সন্নিবেশিত হয়নি। এটুআই’র তথ্যমতে, ‘বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জ’ ক্যাম্পেইন এর মাধ্যমে ইতোমধ্যে সারাদেশের ১ লাখ ৩০ হাজার স্থান গুগল ম্যাপ ও ওপেন স্ট্রিট ম্যাপে সন্নিবেশীত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫ হাজার হাসপাতাল, ১৬ হাজার ফার্মেসি, ২০ হাজার মুদি দোকান ও ৮৭০টি রাস্তা। খুব দ্রুতই সারাদেশের সব জায়গা গুগল ম্যাপ ও ওপেন স্ট্রিট ম্যাপে সন্নিবেশিত করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল ও দূরদর্শী নেতৃত্বে প্রতিটি গ্রামকে শহরে পরিণত করার লক্ষ্যে গুগল ম্যাপে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত দেশের প্রতিটি কোণের তথ্য সন্নিবেশ করা এক সময়োপযোগী উদ্যোগ। ‘বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জ’ ক্যাম্পেইনকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, যে কেউ ঘরে বসে এই ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করে গুগল ম্যাপের তথ্যভান্ডার সমৃদ্ধ করতে পারে। এক্ষেত্রে ম্যাপ বিশেষজ্ঞরা স্বেচ্ছাসেবীদের সহযোগিতা করছেন।
এটুআই’র কমিউনিকেশনস ও মিডিয়া আউটরিচ কনসালট্যান্ট আদনান ফয়সল বাসসকে বলেন, ‘ডিজিটাল ম্যাপিং সারা দেশে কয়েক লক্ষ মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। ‘বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জ’ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে তরুণরা প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার স্থান গুগল ম্যাপে যুক্ত করেছে।’ তিনি জানান, আইসিটি বিভাগ, গ্রামীণফোন ও প্রেনিউর ল্যাবের সহায়তায় এই ডিজিটাল ম্যাপিং ‘বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জ’ পরিচালনা করছে এটুআই। এর মাধ্যমে তরুণরা ঘরে বসেই সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্থানগুলো গুগল ম্যাপ ও ওপেন স্ট্রিট ম্যাপে সন্নিবেশিত করার সুযোগ পেয়েছেন।
আইসিটি বিশেষজ্ঞদের মতে, ই-বাণিজ্য এবং বিতরণ পরিষেবার ক্ষেত্রে এই ম্যাপিং চ্যালেঞ্জ সারাদেশের সাধারণ মানুষকে উল্লেখযোগ্যভাবে সহায়তা করছে। ভৌগলিক ম্যাপ আপডেট করা একটি জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা বর্তমান সরকার করেছে।
গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) দেশের নাগরিকদের দ্রুত হাসপাতাল, বাজার, রিচার্জ পয়েন্ট, নগদ/বিকাশ পয়েন্ট এবং আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান সনাক্ত করতে সহায়তা করে আসছে। ডিজিটাল ম্যাপিং বিভিন্ন সংস্থা বা সংগঠনকে যথাযথভাবে সারাদেশে বিশেষ করে ঢাকার বাইরে জরুরী সেবা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রেও সহায়তা করবে।
আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন ‘এটুআই, গ্রামীণফোন, বাংলাদেশ স্কাউটস এবং প্রেনিউর ল্যাব ডিজিটাল ম্যাপিং ‘বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জ’-এর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মাধ্যমে তরুণরা তাদের ঘরে বসেই জাতিকে পথ দেখাচ্ছে। আমরা আনন্দিত যে এই চ্যালেঞ্জটি সবাইকে স্পর্শ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘গুগল ম্যাপ’ ম্যাপিংয়ের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ‘স্মার্ট ফোনসহ জিপিএস ব্যবহার বিশ্বকে আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। তবে, এটা সত্য যে, প্রযুক্তি আমাদের মধ্যে বৈষম্য করে না। বিশেষত সঙ্কটের সময়, যখন ঘরে ঘরে জরুরি পরিষেবা সরবরাহ করা জরুরি হয়ে পরে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকারের কৌশলগুলোর মধ্যে একটি ছিল সকল বেসরকারী সংস্থা, উদ্যোক্তা এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে সরকারি কার্যক্রমের সাথে জড়িত করা। এছাড়াও, গুগল ম্যাপে ইতোমধ্যে বাংলা ভাষা যুক্ত করা হয়েছে। দেশের তরুণরা ছোট-বড় শহরের সকল স্থাপনা গুগল ম্যাপে সংযুক্ত করার পর, বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন স্থাপনা ও রাস্তাগুলো গুগল ম্যাপে সন্নিবেশ করা হচ্ছে।