বরকতের মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। তিনি ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, বিশেষ কোনো স্থান, কাল, পাত্র কাউকে বরকত দিতে পারে না। এ ধরনের চিন্তা-চেতনা বা বিশ্বাস পোষণ করা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। বরকতের জন্য কোনো পীর, বুজুুর্গ, ওলি, আউলিয়া এমনকি রাসূলুল্লাহ সা:-এর কবরেও যাবেন না। হ্যাঁ যাবেন, রাসূলুল্লাহ সা:-এর সুন্নাহ অনুযায়ী কবরবাসীকে সালাম দেবেন এবং কাবার দিকে ফিরে নিজের জন্য ও কবরবাসীর জন্য দোয়া করবেন, যা কিছু প্রয়োজন, আল্লাহকেই বলুন। তিনিই একমাত্র দাতা। তিনিই আপনার প্রয়োজন মেটাতে পারেন। আর আল্লাহর কাছে চাওয়ার জন্য কোনো মাধ্যম লাগে না। তিনি বান্দার ডাক সরাসরি শুনেন ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও গ্রহণ করেন।
আমরা দরূদে ইবরাহিমিতে বলে থাকি ‘আল্লাহুমা বারিক আলা মুহাম্মাদিন’ হে আল্লাহ! মুহাম¥দ সা:কে তুমি বরকত দান করো।’ আর মুহাম্মদ সা: ও তাঁর আহালকে আল্লাহ এমন সমৃদ্ধি ও স্থায়ী বরকত দান করলেন যে, পৃথিবীর প্রতিটি মুসলিম তাঁর প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে তাদের সালাম ও দরূদে দোয়া করে যাচ্ছে, যার ধারাবাহিকতা চলছে এবং চলবে। ‘এই যে চলছে চলবে’ এর নামই তাবারক। এই বরকত কে দিয়েছেন? এই বরকত দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা।
আমরা আমাদের প্রাত্যহিক সালাতে তাকবির বলার পর প্রথমেই ছানা পড়ি। এই ছানার এক জায়গায় বলে থাকি ‘ওয়া তাবারাকা ইসমুকা’ বড়ই বরকতময় তোমার নাম। এখানে আল্লাহই একমাত্র বরকতের মালিক এই স্বীকৃতি দেয়ার পর সালাত শেষ করেই বরকত তালাশ করার জন্য আমরা ছুটে যাই বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও স্থানের কাছে, যা সুস্পষ্টভাবে শিরক। অথচ আল্লাহর প্রতিটি নামই বরকতময়। বরকতের মালিক আল্লাহ তায়ালা। তাই বরকত তাঁর কাছেই চাইতে হবে। ‘বড়ই বরকতময় আল্লাহ তায়ালা’ আল কুরআনের অনেক জায়গায় তা উদ্ধৃত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা:-এর অসংখ্য দোয়ায় বরকতের কথা রয়েছে। তিনি বরকতের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন এই মর্মে বহু হাদিস বর্ণিত রয়েছে।
বরকতের অর্থ বিভিন্ন আয়াতে ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ‘বড়ই বরকত সম্পন্ন তিনি যিনি চাইলে তাঁর নির্ধারিত জিনিস থেকে অনেক বেশি ও উৎকৃষ্টতর জিনিস তোমাকে দিতে পারেন, অনেকগুলো বাগান, যেগুলোর পাদদেশে নদী প্রবাহিত এবং বড় বড় প্রাসাদ’ (সূরা ফুরকান-১০)।
এখানে তাবারাকা এর মানে হচ্ছে ‘বিপুল সম্পদ ও উপকরণাদির অধিকারী’ সীমাহীন শক্তিধর এবং কারো কোনো কল্যাণ করতে চাইলে করতে পারেন না, তিনি এই দুর্বলতার অনেক ঊর্ধ্বে। অর্থাৎ তিনিই একমাত্র বরকতের মালিক।
মূর্খতাবশত মানুষ বরকত তালাশের জন্য বিভিন্ন পীর ও মাজারে দৌড়ায়। বরকতের জন্য সিলেট হজরত শাহজালাল রহ: ও আজমীরের হজরত মইনুদ্দীন রহ:-এর কবরে যায়। এভাবে নিয়ত করে বা ঘটা করে এ সব মাজারে যাবেন না। কোনো কাজে সিলেটে বা ভারতে গেছেন। যান এই দুই মনীষীর কবরে, রাসূলুল্লাহ সা:-এর সুন্নাহ অনুযায়ী তাদেরকে হাদিসের পরিভাষায় সালাম করুন এবং কাবার দিকে ফিরে তাদের জন্য এবং নিজেদের জন্য দোয়া করুন। কিন্তু ঘুণাক্ষরে তাদের কাছে কোনো কিছু চাইবেন না বা তাদেরকে উসিলাও বানাবেন না। হজ ও ওমরাহ অ্যাজেন্সির মালিকরা তাদের প্যাকেজে বিভিন্ন জায়গায় জিয়ারার প্যাকেজ রাখেন। যেমনÑ মক্কায় : জাবালে রহমত, আরাফা ময়দান, জাবালে সওর, জাবালে নূর, রাসূলুল্লাহ সা:-এর বাড়ি বা জন্মস্থান ও মাকবারাতুল মুয়াল্লা, তায়েফে ও মা হালিমার বাড়ি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মদিনায় : রাসূলুল্লাহ সা:-এর কবর, তার দুই প্রিয় সাথীর কবর, ওহুদ প্রান্তর ও সাইয়েদুশ শুহাদা আমির হামজা রা:-এর কবর, মসজিদে কুবা, মসজিদে কেবলাতাইন, মসজিদে জুমায়, সাবায়া মসজিদ, মসজিদে আবুবকর রা: ও মসজিদে আলী রা:, মাকবারাতুল বাকি ও ওয়াদিয়ে জিন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এগুলোতে যাওয়া দোষের নয়, ইতিহাসকে মন্থর ও রাসূলুল্লাহ সা:-এর সংগ্রামী জীবনকে স্মরণ করে নিজেকে উজ্জীবিত করার জন্য যাবেন। কবরসমূহেও যাবেন। রাসূলুল্লাহ সা: কবরগুলোতে গিয়ে কবরবাসীকে সালাম দিতেন। কিন্তু এগুলোতে গিয়ে বিশেষ কোনো কিছু তালাশ করা জায়েজ নয়। বিশেষ করে এগুলোকে বরকতময় মনে করাও ঠিক নয়। জাবালে রহমতে আরাফার দিন যাবেন। আরাফাতে আরাফার দিন দোয়া কবুল হয়। মদিনায় মসজিদে কুবায় দুই রাকাত নামাজের কথা হাদিসে আছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, মক্কা ও মদিনার উল্লিøখিত স্থানসমূহের প্রত্যেকটিতে কয়েকটি ভাষায় সতর্কবাণী সংবলিত সাইনবোর্ড সেঁটে দেয়া আছে। যেমনÑ রাসূলুল্লাহ সা:-এর বাড়ি বা জন্মস্থান নামে খ্যাত দোতলা বাড়িটির দেয়ালে সেঁটে দেয়া বিলবোর্ডে উর্দুু, বাংলা, তুর্কি ও ফারসি ভাষায় লেখা আছে, ‘হে মুসলিম ভাই! নবী সা:-এর সঠিক জন্মস্থানের ওপর কোনো বিশুদ্ধ দলিল নেই। অতএব, এ স্থান থেকে বরকত গ্রহণ করা কিংবা এটাকে সালাত ও দোয়ার জন্য নির্দিষ্ট করা শরয়িভাবে জায়েজ নয়।’ তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সা:-এর বাড়ি বা জন্মস্থান সুনির্দিষ্ট হলেও তো এখান থেকে বরকত লাভ করা যাবে না।
এমনিভাবে জাবালে রহমতের পাদদেশে বিলবোর্ডটিতে এই কয়টি ভাষায় লেখা আছে, ‘হে মুসলিম ভাই! আপনার প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা: আরাফাতের দিন ছাড়া এখানে আসেননি। তিনি পাহাড়ে উঠেননি। তিনি পাহাড়ের কোনো অংশ বা কোনো গাছ স্পর্শ করা বা তাতে গিরা লাগানোর আদেশ দেননি এবং তিনি আরো আদেশ দেননি পাহাড়ের ওপরে সালাত আদায় করা, না আদেশ করেন পাথরের ওপর কোনো কিছু লেখা। অতএব, হে হাজী সাহেবান! আপনি আপনার প্রিয় নবী সা:-এর সুন্নাহ অনুসরণ করুন এবং তিনি বলেছেন তোমরা আমার থেকে হজ গ্রহণ করো।’
এভাবে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানে এই চতুরদেশীয় হাজীরা যে ধরনের বিদায়াতি আচরণ করেন, সেই বিদায়াত সম্পর্কে সতর্কবাণী সংবলিত বিলবোর্ড সেঁটে দেয়া আছে। জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে ঢোকার পথে সাইনবোর্ডে বিভিন্ন সহিহ হাদিস উল্লেখ করে বিদায়াত থেকে সাবধান করা হয়েছে। কবরস্থানে ঢুকে আপনি কী করবেন আর কী করবেন না তা লেখা আছে। রাসূলুল্লাহ সা: দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে যা দিয়েছ তাতে বরকত দাও।’ তিনি আরো দোয়া করেছেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে ও আমাদের দৃষ্টিশক্তিতে, আমাদের অন্তরে, আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে বরকত দান করো।’
এমনকি রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছেও বরকত চাওয়া যাবে না। তাঁর কবরের পাশে গিয়ে অনেকে বিদায়াত করতে চায়, কিন্তু সৌদি পুলিশ তাতে বাধা দেয়। আমরাই তো প্রতি সালাতে তাশাহুদের পরে দরূদে ইবরাহিমিতে তাঁর জন্য বরকতের দোয়া করছি। আমরা বলে থাকি, ‘আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদি…অর্থাৎ হে আল্লাহ, মুহাম্মদকে বরকত দান করো…। তাহলে তিনি আপনাকে বরকত দেবেন কিভাবে? তিনিই তো আল্লাহর কাছে বরকতের প্রত্যাশী ছিলেন এবং আমাদেরকে আল্লাহর কাছে বরকত চাওয়ার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়ে গেছেন। সুতরাং কোনো বুজুুর্গ, পীর, আউলিয়া এমনকি কোনো নবী রাসূলও আপনাকে এক চুল পরিমাণ বরকত দেয়ার ক্ষমতা রাখেন না। ঈমানকে সাফ করুন মুসলমান! নিজের কর্মের পরিশুদ্ধতার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করুন। বরকতময় আল্লাহ অবশ্যই আপনাকে ও আপনার কর্মকে পরিশুদ্ধ করে দেবেন। আল্লাহ আমাদের সবার বিশ^াস ও কর্মকে পরিশুদ্ধ করে দিন। আমীন। ম্যানেজার, আইবিবিএল, জিন্দাবাজার শাখা, সিলেট।