মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী ২০২৫, ০৭:৫৬ অপরাহ্ন

পিয়াসার ফাঁদে পড়েছিল যারা

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বুধবার, ৪ আগস্ট, ২০২১

পিয়াসা ও মৌ’র কাছ থেকে উদ্ধারকৃত মোবাইল ফোন থেকে অনেকের তথ্য উদ্ধার হয়েছে। তারা কাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করতেন, তাদের নাম বেরিয়ে আসছে। গোয়েন্দারা ওই ব্যক্তিদেরকে খোঁজখবর নিচ্ছেন।
চট্টগ্রামের মেয়ে ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা। অভিযোগ আছে, দিনে ঘুমান আর রাতে রাণী হন নানা বিত্তবানের। রাত হলে বিলাসবহুল বিএমডব্লিউটি মার্সিডিজ ব্রান্ডের গাড়ি হাঁকিয়ে ছুটে চলতেন রাজধানীর বার ও নাইট ক্লাবের উদ্দেশে। অনেকটা খোলামেলা পোষাকে ঢুকে পড়তেন সেখানে। প্রভাবশালী আর ধনীর দুলালদের সঙ্গে চলতো ডিসকো ড্যান্স। গ্রুপ বেধে সেবন করতো মাদক। পরে চলে যেতো রাজকীয় ফ্ল্যাটে।গত ১ আগস্ট রাতে রাজধানীর বারিধারার ৯ নম্বর রোডের ৩ নম্বর বাসায় অভিযান চালিয়ে মাদকদ্রব্যসহ ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাকে আটক করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পিয়াসার ঘর থেকে বিপুল পরিমাণ মদ-বিয়ার, ইয়াবা, সিসাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়। পরে রাত পৌনে ১২টার দিকে তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়। পরে পিয়াসার দেয়া তথ্যে আরেক মডেল মরিয়ম আক্তার মৌ’র রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বাসায় অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ। তার বাসা থেকেও বিপুল পরিমাণ মদ উদ্ধার করা হয়। এই বাসায় রীতিমতো মদের বার পাওয়া যায়। গোয়েন্দারা জানায়, এরা একে অপরের সঙ্গী এবং সহযোগী। এদের রয়েছে একটি নেটওয়ার্ক। যার ফাঁদে পড়ে অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি অনেক অর্থ দ-ি দিয়েছেন। ঢাকার রাতের জগতের দীর্ঘ দিনের এক পরিচিত নাম পিয়াসা। অপরাধজগতের শীর্ষ সারির অনেকের সাথেই যার জানাশোনা। ঢাকার অনেকগুলো আলোচিত ঘটনার সাথেই যার নাম জড়িয়েছে। গভীর রজনীতে এই পিয়াসা এবং তার সহযোগী মৌ’র বাসায় কারা যাতায়াত করতেন, কাদের সাথে এই দুই নারীর সম্পর্ক ছিল তার খোঁজখবর নিচ্ছে গোয়েন্দারা। ইতোমধ্যে অনেকের নাম বেরিয়ে আসছে, যারা নিয়মিত যাতায়াত করতেন পিয়াসা ও মৌ’র আস্তানায়।
ফেরারি, ল্যাম্বারগিনি, পোরশে, মাজদা। অভিজাত এবং বিলাসবহুল এসব গাড়ির দাম আকাশছোঁয়া। চাইলেও যে কেউ এসব গাড়ির মালিক হতেও পারে না। কারণ এসব গাড়ি বাংলাদেশে আমদানি নিষিদ্ধ। কিন্তু ডিবির হাতে গ্রেফতার বিতর্কিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা চোরাইপথে এসব গাড়ি আনতেন ঢাকায়। ক্রেতার অভাব হয়নি। কারণ উচ্চবিত্ত পরিবারের বখে যাওয়া সন্তানদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তাকে গাড়ি বিক্রিতে বেগ পেতে হয়নি। তবে পিয়াসার চোরাচালান চক্রের প্রধান সহযোগী মিশু হাসান নামের এক যুবক। চোরাচালানের সুবাদে তিনিও এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। রাজধানীর উপকণ্ঠে সান ডেইরি নামের একটি গরুর ফার্মের আড়ালে তিনি দীর্ঘদিন ধরে মাদক ও অস্ত্রের কারবারে জড়িত। মিশু এক সময় রাজধানীতে পেশাদার ছিনতাইকারী হিসাবে পুলিশের তালিকাভুক্ত ছিলেন। সূত্র জানায়, পিয়াসা ডিবির হাতে গ্রেফতারের পর মিশু হাসানকেও আটক করা হয়েছে। পিয়াসা-মিশু চক্রের হাতে কত টাকা আছে তার অনুমান করাও দুষ্কর। কারণ ডেইরি সান নামের ফার্মে বিদেশি গরু লালন পালনের আড়ালে তাদের চোরাচালান কৌশলের কাছে হার মানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি। বিদেশ থেকে আমদানির সময় গরুর পেটে করে আনা হয় হীরা ও স্বর্ণের চালান। গত ৫ বছরে এভাবে হাজার কোটি টাকার চালান দেশে আনা হয়। সূত্র বলছে, শুধু হীরার এবং স্বর্ণের চালান নয়, গরুর পেটে করে ইয়াবার চালানও আনা হয়। এজন্য মাঝে মাঝে টেকনাফ থেকেও গরুর চালান আনা হতো। এভাবে চোরাচালানের টাকায় রাতারাতি বিত্তশালী বনে যান মিশু। তার অভিজাত এবং শৌখিন জীবনযাপন অনেক মধ্যপ্রাচ্যের যুবরাজদের মতো। তিনি হাতে পিজিয়েট ব্রান্ডের ঘড়ি পরেন। হিরাখচিত পিজিয়েট ঘড়ির সর্বনি¤œ বাজারমূল্য কোটি টাকা। মিশুর ব্যবহৃত জুতার ডিজাইন করা হয় দুবাই এবং সিঙ্গাপুরে। তিনি আগে মোহাম্মদপুর এলাকায় ছিনতাই করতেন। ছিনতাইয়ের অভিযোগে একাধিকবার পুলিশের হাতে গ্রেফতারও হন। জেলে ছিলেন ৩ মাস। পরে পরিবারের এক সদস্যের গয়না বেচে মিশুকে জেল থেকে ছাড়ানো হয়। সূত্র বলছে, মিশু এক সময় নিজেকে একজন প্রয়াত সংসদ সদস্যের ছেলের বন্ধু বলে পরিচয় দিতেন। ফলে মোহাম্মদপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালের লোকজন তার ওপর গুলি চালায়। হেলালের অনুগত কিলার হিসাবে পরিচিত লাল্লুর গুলিতে আহত হন মিশু। এখনো তার শরীরে গুলির দাগ রয়েছে।
সূত্র বলছে, মিশুর মাধ্যমে ইয়াবা, হিরা এবং সোনার চালান আনা হলেও বিক্রির মূল কাজটা করেন পিয়াসা নিজেই। এ জন্য তিনি ডার্ক ওয়েব এবং ফেসবুক চ্যাটিং গ্রুপ ব্যবহার করতেন। মিশুর মাধ্যমে আগ্নেয়াস্ত্রের চালানও আনা হয়। পিয়াসার ইয়াবার মূল ক্রেতা ছিলেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুল পড়ুয়া ধনী পরিবারের সন্তানরা।
রাজধানীর গুলশান থেকে ফেরারি ব্রান্ডের একটি অভিজাত প্রাইভেট উদ্ধার করা হয়েছে। এফ-৪৩০ সিরিয়ালের ৬ হাজার সিসির গাড়িটি গুলশানের ১১১ নম্বর রোডে অবস্থিত অটো মিউজিয়ামে বিক্রির জন্য রাখা হয়েছিল। এ ধরনের উচ্চ সিসির গাড়ি বাংলাদেশে আমদানি নিষিদ্ধ। এ কারণে বৈধভাবে রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ নেই। তবে এ ধরনের গাড়ি রাজধানীর রাস্তায় চলছে ভূরি ভূরি। সবগুলোর নম্বর প্লেট ভুয়া। মঙ্গলবার অটো মিউজিয়াম থেকে উদ্ধারকৃত গাড়িটিতেও একটি নম্বর প্লেট লাগানো ছিল। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে নম্বরটি জাল।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি উদ্ধার অভিযানের সময় ঘটনাস্থলে এই প্রতিবেদক উপস্থিত ছিলেন। লাল রঙের চকচকে ফেরারি গাড়িটির আমদানি সংক্রান্ত কাগজপত্র চাওয়া হলে তা দেখাতে ব্যর্থ হন শোরুম কর্তৃপক্ষ। এক পর্যায়ে গাড়িটি জব্দ করে নিয়ে যাওয়া হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অটো মিউজিয়ামের ম্যানেজার বাবু বলেন, গাড়িটি বিক্রির জন্য এখানে একজন রেখে যান। এর বেশি কিছু আমরা জানি না। অটো মিউজিয়ামের মালিকের নাম হাবিবুল্লাহ ডন। তিনি গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডার দু’বার সভাপতি ছিলেন। শোরুম থেকে চোরাই গাড়ি উদ্ধারের ঘটনায় হাবিবুল্লাহ ডনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।
এদিকে সূত্র জানায়, ফেরারি উদ্ধারের পর ল্যাম্বারগিনি ব্রান্ডের আরেকটি গাড়ি উদ্ধারে অভিযান চলছে। ৬ সিলিন্ডারের ল্যাম্বারগিনি বিশ্বের মূল্যবান ব্যক্তিগত গাড়ির মধ্যে অন্যতম। অভিজাত এসব গাড়ির দরজা ঈগলের ডানার মতো। দুপাশ দিয়ে খোলার বদলে খোলে আড়াআড়িভাবে। দরজা খোলা অবস্থায় পার্কিং করা হলে ল্যাম্বারগিনি অনেকটা উড়ন্ত ঈগলের মতো দেখায়।
অভিনব কৌশলে পিয়াসা-মিশু চক্র চোরাই ল্যাম্বারগিনি বিক্রি করে আসছেন। এজন্য গোপন চ্যাটিং গ্রুপ খুলে প্রথমে গাড়ির লোগো পোস্ট করা হয়। এরপর দেওয়া হয় একটি দরজার ছবি। এরপর রংসহ গাড়ির অন্য অংশগুলো। এভাবে গাড়ি সম্পর্কে ক্রেতার আকর্ষণ চরমে পৌঁছলে গাড়ির সম্পূর্ণ ছবি পাঠানো হয়।
এ দিকে গুলশান, বনানী ও বারিধারার মতো অভিজাত এলাকার ২০-২৫টি বাসায় প্রতি রাতে আয়োজিত ‘নাইট পার্টি’তে অংশ নেওয়া বিভিন্ন মডেলই একসময় বড় এক চক্রের সদস্য হয়ে পড়েন। পার্টিতে অংশ নেওয়া ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যদের অসতর্ক অবস্থার ছবি কৌশলে তুলে রাখতেন তারা। পরে এসব ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া এবং স্বজনদের কাছে পাঠানোর ভয় দেখিয়ে তাদের ব্ল্যাকমেইল করতেন মডেলরা।
পুলিশ বলছে, এই চক্রের সদস্য হয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছিলেন মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা, মরিয়ম আক্তার মৌ এবং অভিনেত্রী শিলা হাসান। মাদক মামলায় পিয়াসা ও মৌকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে জব্দ ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও অন্যান্য আলামত পরীক্ষা করে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। তবে শিলা হাসান এখনও অধরা রয়েছেন। উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা জানান, নাইট পার্টির সক্রিয় সদস্য হিসেবে এমন ১০-১১ জনের নাম পাওয়া গেছে, যারা ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকার আলোচিত অনেক ঘটনার সাথেই এই পিয়াসার সম্পৃক্ততা রয়েছে। ওই সব ঘটনায় তার নাম উঠে এসেছে। ২০১৭ সালের ৬ মে রাজধানীর বনানী থানায় এক শিক্ষার্থী ধর্ষণের অভিযোগ এনে মামালা দায়ের করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয় ওই বছরের ২৮ মার্চ তিনি এবং তার বান্ধবী বনানীর হোটেল রেইনট্রিতে ধর্ষণের শিকার হন। ধর্ষণের মামলায় প্রধান আসামি করা হয় আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার হোসেন সেলিমের ছেলে সাফাতকে। তার দুই বন্ধু সাদমান ও নাঈম আশরাফকেও আসামি করা হয় এই মামলায়। গত এক আগস্ট বারিধারা থেকে গ্রেফতার হওয়া পিয়াসা ছিলেন এই সাফাতের স্ত্রী। সাফাতকে বাগে এনে তাকে বিয়ে করার অভিযোগ আছে পিয়াসার বিরুদ্ধে। পরিবারের কেউ বিয়ে মেনে না নেয়ায় একপর্যায়ে সাফাত পিয়াসাকে তালাক দেন।
এ দিকে তালাকের কয়েক দিন পরেই সাফাতের বিরুদ্ধে ওই দুই তরুণী বনানী থানায় তাদেরকে ধর্ষণের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেন। এই মামলা দায়েরের ক্ষেত্রেও পিয়াসার হাত ছিল বলে জানা যায়। অন্য দিকে মামলা দায়েরের পর পিয়াসা তার সাবেক শ্বশুর দিলদারের কাছে অর্থ দাবি করেন বলে সাফাতের পরিবার থেকে পিয়াসার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করা হয়। এর কিছু দিন পর আবার ওই ধর্ষণ মামলার বাদিনী অভিযোগ আনেন মামলা তুলে নিতে পিয়াসাই তাদেরকে চাপ দিচ্ছে। সূত্র জানান, সম্প্রতি ঢাকার আরেক আলোচিত ঘটনার সাথে নাম জড়িয়ে যায় পিয়াসার। এক তরুণীর আত্মহত্যার পর আবারো আলোচনায় আসেন পিয়াসা।
গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, এসব ঘটনা খতিয়ে দেখতে গিয়ে তারা জানতে পারেন পিয়াসার অপরাধ নেটওয়ার্কের কথা। পিয়াসার এই নেটওয়ার্ক এভাবে চলতে থাকলেও আরো বড় বড় অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পিয়াসা ও তার সহযোগী মরিয়ম মৌ’র বাড়িতে প্রতিদিনই বসত আসর। সেই আসরে ঢাকার অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা ভিড় জমাতেন। তাদেরকে নিয়ে রাতভর চলত হৈহুল্লোড়, আর নানা অসামাজিক কার্যকলাপ। এর বিনিময়ে পিয়াসা কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে আসছিলেন। তার কোনো বৈধ উপার্জন না থাকলেও তিনি যেসব গাড়ি ব্যবহার করতেন তা অনেক শিল্পপতিও ব্যবহার করতে পারেন না বলে জানা যায়। সূত্র জানায়, পিয়াসার আসরে যারা যেতেন তাদের মধ্যে অনেকের আপত্তিকর ছবি তুলে তা নিয়ে দিনের পর দিন ব্ল্যাকমেইল করতেন এই পিয়াসা ও তার সহযোগীরা। এসব করতে তিনি বিভিন্ন সেক্টরের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিকেও ব্যবহার করে আসছিলেন।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামেই জন্ম ও মডেলিংয়ে হাতেখড়ি হয়েছিল পিয়াসার। ২০০৯ সাল থেকে ঢাকার অভিজাত মহলে পরিচিতি পান মডেল পিয়াসা হিসেবে। নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠলেও অল্প সময়ের মধ্যেই ৩২ বছর বয়সী পিয়াসার হাত হয়ে উঠে অনেক লম্বা। তাকে সমীহ করে চলেন অনেক বাঘা বাঘা শিল্পপতিও।
এ প্রসঙ্গে ডিএমপির এক কর্মকর্তা বলেন, বারিধারা আবাসিক এলাকার ৯ নম্বর রোডের একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে ভাড়া থাকতেন পিয়াসা। সার্ভিস চার্জ ও সিকিউরিটি বিল বাদে শুধু ফ্ল্যাট ভাড়াই দেড় লাখ টাকার মতো। অথচ দৃশ্যমান কোনো আয় নেই পিয়াসার। বিশাল ফ্ল্যাটে তিনি একাই থাকেন। তার রান্নাবান্নাসহ ব্যক্তিগত কাজের জন্য কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া আছে। শাহজাহান নামের এক বাবুর্চি তার ফ্ল্যাটে রান্নার কাজ করেন। তাকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি।
তিনি আরো বলেন, পিয়াসার ফ্ল্যাটে প্রভাবশালীদের যাতায়াত ছিল নিয়মিত। করোনায় পাঁচতারকা হোটেলগুলো বন্ধ হয়ে গেলে নিয়মিত পার্টি হতো তার ফ্ল্যাটেই। পিয়াসার বাবার নাম মাহবুব আলম। তিনি কাস্টমস কর্মচারী ছিলেন। পিয়াসার শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি পাস হলেও নিজেকে কখনো এমবিএ, আবার কখনো ব্যারিস্টার বলে পরিচয় দিয়ে আসছিলেন। তিন বোনের মধ্যে পিয়াসা থাকেন ঢাকায়। অন্যরা থাকেন চট্রগ্রামে।
ডিবি পুলিশের এক কর্মকর্তা গতকাল বলেন, পিয়াসা ও মৌকে পৃথক পৃথক মামলায় ৩ দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গত রোববার রাতে রাজধানীর বারিধারা থেকে পিয়াসা ও মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বাসা থেকে মৌকে আটক করার পর তাদের বিরুদ্বে পৃথক পৃথক মামলা দায়ের করা হয়। এই দুজনের বিরুদ্বে ব্ল্যাকমেইল করার অভিযোগ হাতে নিয়ে বেশকিছু দিন গোয়েন্দা নজরদারি চালায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ সব অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েই অভিযান চালানো হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, পিয়াসার সঙ্গে আন্ডারওয়ার্ল্ড মাফিয়ারও ঘনিষ্ঠতার তথ্য পাওয়া গেছে। ওই মাফিয়া চক্রের মাধ্যমে অস্ত্রের কারবার সিন্ডিকেটের ঘনিষ্ঠ হয় সে। ধনাঢ্য পরিবারের উঠতি বয়সি তরুণদের কাছে অবৈধ অস্ত্রের তথ্য আদান-প্রদানে কাজ করে সে। অত্যাধুনিক উজিগান হাতে পোজ দেওয়া পিয়াসার একটি ছবি এরই মধ্যে ভাইরাল হয়েছে। ওই অস্ত্রটি কার সে সম্পর্কে রিমান্ডে পিয়াসাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিয়াসার ঘনিষ্ঠভাজনদের নামের তালিকা বেশ লম্বা। প্রভাবশালীদের অনেকেই রয়েছেন তার বন্ধু কিংবা বয়ফ্রেন্ডের তালিকায়। পিয়াসার ঘনিষ্ঠভাজনদের মধ্যে সবার উপরে আছে একটি শিল্প গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার। একে একে পিয়াসার বন্ধু তালিকায় যোগ দেন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা। সুন্দরী তরুণীদের মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতো পিয়াসা। এ জন্য রয়েছে তার ১০০ জনের সুন্দরী নারীর সিন্ডিকেট।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্তের সাথে সম্পৃক্ত ডিবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, পিয়াসা বারিধারা, উত্তরা এবং গুলশানের কয়েকটি বাসায় মাঝে মধ্যেই পার্টির আয়োজন করতেন। ওই পার্টিতে আমন্ত্রণ জানানো হতো বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের। প্রতিটি পার্টিতেই গোপন ক্যামেরা বসাতেন পিয়াসা। রাখা হতো মদ, ইয়াবাসহ বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য। একপর্যায়ে টার্গেটকৃত ব্যক্তি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে কৌশলে তাকে গোপন একটি কক্ষে পাঠিয়ে দেয়া হতো। পরবর্তীতে ওইসব দৃশ্য সামনে রেখেই তার কাছ থেকে নিয়মিতভাবে হাতিয়ে নেয়া হতো মোটা অঙ্কের অর্থ।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পিয়াসা ও মৌ প্রশাসন বা প্রভাবশালীদের মাধমে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ বা অন্য কোনো প্রভাবশালী চক্রের সাথে জড়িত রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমরা এদের আড্ডায় আগতদের তালিকা তৈরি করছি। এর মাধ্যমে সব বেরিয়ে আসবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সূত্র জানায়, গত বছর ২২ ফেব্রুয়ারি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে জাল টাকা বহন ও অবৈধ টাকা পাচারের অভিযোগে শামিমা নূর পাপিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি নরসিংদীর যুব মহিলা লীগের নেত্রী ছিলেন। তার স্বামী মফিজুর রহমানও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। তারা দু’জনই সুন্দরী নারীদের নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে অনৈতিক ব্যবসা করে আসছিলেন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে ব্ল্যাকমেইল, অবৈধ অস্ত্র-মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজি করতেন তিনি। এর মাধ্যমে তিনি অল্প সময়ে নরসিংদী ও ঢাকায় একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লটসহ বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থের মালিক হয়েছেন। তিনি গুলশানের একটি অভিজাত হোটেলের প্রেসিডেন্ট স্যুট নিজের নামে বুক করে নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়েছেন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com