ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মশুদ্ধি অর্জনকারী ব্যক্তি পরিপূর্ণ মানুষ তথা আশরাফুল মাখলুকাত। কুরআনই দিয়েছে সেই কথার সাক্ষী, ‘নিঃসন্দেহে মানুষের মধ্যে সেই সফলকাম যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে। আর যে নিজেকে কলুষিত করেছে সে ব্যর্থ হয়েছে’ (সূরা শামস : ৯-১০)। ‘যে ব্যক্তি তার মনের লোভ লালসা থেকে বিরত রয়েছে সে ধরনের ব্যক্তিই সফলকাম হবে’ (সূরা তাগাবুন-১৬)।
নফস এমন একটি সূক্ষ্ম বস্তু, যা কেবল পার্থিব ভোগ বিলাস মায়া মোহের প্রতি মানুষকে উৎসাহিত করে। উদ্বুদ্ধ করে গুনাহ, পাপাচার, আল্লাহবিমুখতার প্রতি। কুরআনুল কারিমে মানুষের বিভিন্ন ধরনের নফসের বর্ণনা এসেছে। নফসে আম্মারাহ, নফসে লাউয়ামাহ, নফসে মোলহেমা, নফসে মোতমায়িন্নাহ, নফসে রাজিয়া, নফসে মর্জিয়া প্রভৃৃতি। মানুষের মন সবসময় মন্দ কাজের দিকে ধাবিত হয়। জাগতিক সুখ-শান্তির ধোঁকায় পড়ে, মানুষ পরকালীন জীবনের অসীম ও অনন্ত সুখকে ইহকালেই ধুলোয় মিশিয়ে দেয়, খালি হাতে প্রভুর দিকে ধাবিত হয়। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘প্রবৃত্তি মন্দের দিকে ঝুঁঁকি থাকে, কিন্তু তার কথা আলাদা, যার প্রতি আমার প্রভু দয়া করেন’ (সূরা ইউসূফ-৫৩)।
আত্মশুদ্ধির ব্যাপারে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: বলেন, ‘জেনে রাখো! দেহের মধ্যে একখ- গোশতের টুকরা আছে। যখন তা সুস্থ থাকে তখন সারা দেহ সুস্থ থাকে। যখন তা নষ্ট হয় তখন সারা দেহই নষ্ট হয়ে যায়। জেনে রাখো! সেটিই হচ্ছে কলব (মগজ)’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-৩৯৮৪ ; সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫২)।
এখানে তাজকিয়াতুন নফস নিয়ে কাজ করা আর আকাবিরে আসলাফদের নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কিছু আমল বর্ণনা করা হলো- ১. ফজরের পরে না ঘুমানোর অভ্যাস করুন। প্রয়োজনে কাইলুলা (দুপুরের হালকা ঘুম) করা যাবে। ২. দিনে সর্বোচ্চ তিনবার খাবার অভ্যাস করুন। সকাল, দুপুর ও রাতের খাবারের মাঝখানে হাবিজাবি খাবার যেমন- ফাস্টফুড, স্ট্রিটফুড না খাওয়া ভালো। ক্ষুধা লাগলে খেজুর, আপেল এগুলো খাওয়া যায়। ৩. প্রতিবেলা খাবার সময় যেটুকু খাবার যথেষ্ট বলে মনে হবে তার থেকে একটু কম খাবেন। ৪. অপ্রয়োজনীয় কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। কোনো মন্তব্য করার আগে একবার চিন্তা করুন এই কথাটা আপনি না বললে কি কোনো ক্ষতি আছে? বলা কি আবশ্যক? উত্তর না হলে; ওই কথা বলার দরকার নেই। ৫. সকাল-সন্ধ্যায় জিকির-আসকার পাঠ করুন। ৬. ইশরাকের সালাত আদায়ের অভ্যাস করুন। ৭. প্রতিদিন নিয়মিত কুরআন পড়ার অভ্যাস করুন। হতে পারে এক রুকু থেকে এক পারা- যেকোনো পরিমাণ। ৮. ঘুমের পরিমাণ কমাতে হবে। যেমন- আবুজার গিফারি রা: থেকে উল্লিখিত, ‘দুনিয়াটা তো শুধু ৩ ঘণ্টার। তার ১ ঘণ্টা অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, দ্বিতীয় ঘণ্টাটি বর্তমানে চলছে আর তৃতীয় ঘণ্টাটি পাবো কি-না তা আমার জানা নেই। অর্থাৎ, আমার হাতে জীবনের মাত্র একটি ঘণ্টা আছে।’ এই চিন্তা করে প্রতিটি ঘণ্টাকে জীবনের শেষ ঘণ্টা ভেবে নফসকে ইবাদতের জন্য ব্যাকুল করে তুলতে হবে।
৯. ফজরের পরে কিছুক্ষণ ব্যায়ামের অভ্যাস করুন। আর কিছু না পারলে ১৫-২০ মিনিট জগিং করে এসে গোসল করে ইশরাকের সালাত পড়ার অভ্যাস করা ভালো। ১০. দৃষ্টি অবনত রাখুন। না পারলে ওইসব জায়গা এড়িয়ে চলার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। ১১. ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার (সোশ্যাল মিডিয়া) কম ব্যবহার করা। ১২. প্রতিদিন কুরআনের কিছু অংশ মুখস্ত করার টার্গেট নেয়া। এটা প্রতিদিন এক আয়াতও হতে পারে। কিন্তু টার্গেট পুরা করতে হবে। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ১৩. বিশেষ করে রাতে ভরপেট খাওয়া পরিহার করতে হবে।
১৪. রাতে ঘুমানোর আগে অজু করে দুই রাকাত নফল সালাত আদায় করে নিন এবং ঘুম না আসা পর্যন্ত আসতাগফিরুল্লাহ পড়তে থাকুন। ১৫. নিয়মিত তাহাজ্জুদের সালাত আদায়ের অভ্যাস করুন। ইনশাআল্লাহ, রব্বে কারিম আপনার অন্তরকে প্রশান্ত করে দেবেন। ১৬. সর্বশেষ নফসের চিকিৎসা করতে চাইলে ও ইবাদতে মনোযোগী হতে চাইলে চারটি বিষয় থেকে দূরে থাকতে হবে। এগুলো হলো- ক. অধিক আকাক্সক্ষা; খ. তাড়াহুড়ো; গ. অহঙ্কার এবং ঘ. হিংসা। নফস আমাদের সামনে বিভিন্ন দিক থেকে আকাক্সক্ষা ও আশাকে আকর্ষণীয় করে তোলে। নফস তার কুমন্ত্রণা দিয়ে আমাদের পরকাল ও ইবাদত থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। স্বপ্ন দেখায় যে, আমি তো অনেক দিন বাঁচব! নফসকে গুনাহ থেকে দূরে রাখতে পারলে এবং একে নিজের আয়ত্তে আনতে পারলে সহজেই সব গুনাহ থেকে দূরে থাকা সম্ভব। মহান আল্লাহ তায়ালা সবাইকে আমল করার তাওফিক দান করুক। আমীন। শিক্ষক, মাদরাসাতুল ইহসান আল আরাবিয়া, উত্তরা, ঢাকা