রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৫ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
বিজয় ছিনিয়ে নিতে ষড়যন্ত্র চলছে: নজরুল ইসলাম খান পতিত আ’লীগ সরকারের কবল থেকে ভিক্ষুকরাও রেহাই পায় নাই : ডা. শফিকুর রহমান জাতির মুক্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকার বিকল্প নেই : তারেক রহমান ব্যবসায়ী ওয়াদুদ হত্যা: সাবেক ডিসি মশিউর সাত দিনের রিমান্ডে ভারতে ‘অবৈধ’ শেখ হাসিনা, এখন কী পদক্ষেপ নেবে ভারত দেশবাসী তারেক রহমানের নেতৃত্বে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছে ফোন নম্বর মুখস্থ থাকাই কাল হলো তোফাজ্জলের? আরও কিছু সংস্কার কমিশন করার পরিকল্পনা আছে : নাহিদ মুসল্লিদের প্রতিরোধের মুখে স্বৈরাচারী হাসিনার নিযুক্ত খতিব রুহুল আমিনের পলায়ন আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া দেশের জন্য অশনিসংকেত: অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার

সংক্রমণ আছে ও নেই বক্তব্যের সমন্বয়

প্রফেসর মো: রফিকুল ইসলাম:
  • আপডেট সময় সোমবার, ১৬ আগস্ট, ২০২১

সংক্রামক ব্যাধির ব্যাপারে রাসূল সা:-এর ‘লা-আদওয়া,’ ‘সংক্রামক বলে কিছু নেই’ নঞর্থক বক্তব্যটিও বেশ কয়েকটি হাদিসে পরিলক্ষিত হয়- তন্মধ্যে আবু হুরায়রা রা: বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদিসটি প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বক্তব্যকে অপেক্ষাকৃত শানিত ও প্রামাণিক করেছে। তিনি বলেন- রাসূল সা: বলেছেন, ‘সংক্রামক ব্যাধি বলে কিছু নেই’। এমন সময় একজন বেদুইন বলল, হে আল্লাহর রাসূল, চারণক্ষেত্রে যে সুস্থ সবল উটটি বন্য হরিণের মতো দুরন্ত, সেটির সাথে যখন কোনো চর্মরোগাক্রান্ত উটের ঘনিষ্ঠতা হয়, তখন সেটিও চর্মরোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাহলে কেন এমন হয়? প্রত্যুত্তরে রাসূল সা: প্রাশ্নিক-ভঙ্গিতে বলেন, ‘তাহলে কোনো প্রকার সংক্রমণ ছাড়াই প্রথমটি কিভাবে আক্রান্ত হয়েছিল?’ (সহিহ বুখারি, ইফাবা, হাদিস নং-৫২৪৭) রাসূল সা:-এর এ বক্তব্যের সমর্থনে অপর হাদিসে একটি বাস্তব কর্মেরও প্রমাণ পাওয়া যায়- রাসূল সা: জনৈক কুষ্ঠরোগীর হাত ধরে নিয়ে এসে নিজের খাঞ্চায় একসাথে খেলেন। বললেন, ‘খাও আল্লাহর নামে, তাঁর উপরে দৃঢ় বিশ্বাস ও নির্ভরতার সাথে।’ (সুনানু আবু দাউদ, হাদিস নং-৩৯২৫) রাসূল সা:-এর সংক্রমণ সংশ্লিষ্ট পূর্বোল্লিখিত সদর্থক বক্তব্য এবং এই নঞর্থক বক্তব্যের মধ্যে অগ্রগণ্যতা নির্ণয় অথবা এতদুভয়ের মধ্যে যৌক্তিক ও বৌদ্ধিক সমন্বয় সাধন সময়ের দাবি। সহিহ বুখারির বিখ্যাত ভাষ্যকার আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি বলেন, জাহেলি যুগের সমাজ-সংস্কারে একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস সর্বাত্মক রূপ পরিগ্রহ করেছিল, তারা মনে করত কিছু রোগ-ব্যাধি স্বভাবগতভাবেই সংক্রামক। এই ব্রাত্য সমাজকে একটি বিশ্বাসগত নির্ভরতায় প্রসিক্ত করতেই রাসূল সা: বললেন, ‘লা-আদওয়া’, অর্থাৎ কোনো রোগেরই স্বভাবগত সংক্রমণ-সক্ষমতা নেই। এটির নিয়ন্তা হলেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। আর কুষ্ঠ বা সংক্রামক রোগী থেকে দূরে থাকার বিষয়টি কার্যকারণের সাথে সম্পৃক্ত। আল্লাহ তায়ালা পারস্পরিক মিশ্রণ ও মেলামেশাকে সংক্রমণের কারণ বানিয়েছেন। কারণ সংঘটনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফলাফল সংঘটিত হওয়াটাই আল্লাহর কার্যনীতির অনুগম্য। (উমদাতুল ক্বারি, ২২শ খ-, পৃষ্ঠা-৬১৮) সহিহ বুখারির অপর প্রখ্যাত ভাষ্যকার হাফেজ আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানিও উপর্যুক্ত বক্তব্যের সাথে সহমত পোষণ করেন। উপরন্তু তিনি বলেন, ‘সংক্রমণের অস্তি-নাস্তিবিষয়ক বক্তব্যটি প্রেক্ষাপটের বৈভিন্নে বিচার করলে একটি অবিসংবাদী সমাধানে পৌঁছা সহজতর হয়, সেটি হলো- ‘লা-আদওয়া,’ ‘সংক্রমণ বলে কিছু নেই’ বক্তব্যটির উদ্দিষ্ট ছিল সুদৃঢ় ঈমান ও নিবিড়-নিবিষ্ট তাওয়াক্কুলের অধিকারী শ্রোতৃবৃন্দ, যারা স্বয়ংক্রিয়-সংক্রমণ-শক্তির ধারণাকে দুর্নিবার মানসিক দৃঢ়তায় হৃদয় থেকে সমূলে উপড়ে ফেলতে সক্ষম। যারা যুগপৎ অন্যান্য কুসংস্কার অন্তঃকরণ থেকে বিতাড়নের মাধ্যমে বস্তুতান্ত্রিকতার অসহায়ত্ব থেকে মুক্তিলাভের আনন্দে বিজয় বৈজয়ন্তি উড়াতে সক্ষম হয়েছিল। আর সংক্রমণ থেকে দূরত্ব বজায় রাখা-বিষয়ক বক্তব্যটির উদ্দিষ্ট ছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও অসম্পন্ন তাওয়াক্কুলের অধিকারী শ্রোতৃম-লী, যাতে দুর্বল ঈমানদার সংক্রমণ সংলগ্নতায় সম্ভাব্য সংক্রমণাক্রান্ত হওয়ার ফলে সংশয়াকীর্ণতা ও দোদুল্যমানতায় আবিষ্ট হওয়ার সুযোগ না পায়। যেহেতু দুর্বল ঈমানের অধিকারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে মূল ও কারণের মধ্যে প্রভেদ নির্ণায়ক শক্তিটি অপুষ্ট, তাই যেকোনো সংক্রমণ সংলগ্নতা তার মহামূল্যবান ঈমানের জন্য ভয়ঙ্কররূপে অনিষ্টকর হতে পারে। যেটি কোনোভাবেই শরিয়াহ বিধায়কের বাঞ্ছা নয়। তার এই দ্বৈত বক্তব্য ও কর্ম উপর্যুক্ত উভয় ধারার ঈমানদারের জন্য সান্ত¡না ও প্রবোধস্বরূপ। পরিশেষে হাফেজ আল্লামা আসকালানি বলেন, যেসব বিষয়ে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান, হেকমতে-রব্বানি যা থেকে সাবধানতা অবলম্বন করতে অনুমোদন দিয়েছেন, দুর্বল ঈমানদারদের তার নিকটস্থ হওয়াই বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু পরম সত্য ও দৃঢ় ঈমানের ধ্বজাধারী সাধকের জন্য বিষয়টি নৈর্বাচনিক। হাদিসের সংক্রমণ-সমর্থক বক্তব্যটি সংখ্যাগুরু মানুষের জন্য, ঈমানের মান বিবেচনায় যারা সাধারণত দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে থাকে। তাদের ন্যূনমাত্রার ঈমানটুকুর ঈপ্সিত সুরক্ষার জন্যই সংক্রামকরোগীর উপান্তবর্তী না হতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। (ফাতহুল বারি, দশম খ-, পৃষ্ঠা-১৫৮)
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সংখ্যাগুরু দুর্বল মুমিনদেরকেও ন্যূনপক্ষে করোনাক্রান্ত মা-বাবা, সন্তান-সন্ততি, ভাই-বোনসহ অন্যান্য নিকটাত্মীয়-পরমাত্মীয় এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীর সামিপ্যে অয়োময় ঈমানের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করার সানুনয় অনুরোধ জানাই। ভীত-সন্ত্রস্ত, অস্থিরমতি ও পলায়নপর না হয়ে আল্লাহর প্রতি অগাধ, অকৃত্রিম আস্থায় তাদের প্রতি মানবিক ও হৃদ্যিক আচরণ করার পরামর্শ দেই। কারণ নবীজী সা: বলেছেন, ‘মহামারী থেকে পলায়মান ব্যক্তি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নপর ব্যক্তির মতোই।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস-১৪৪৭৮) যা কবিরা গুনাহ ও সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের প্রথম দিকে টাঙ্গাইলের সখিপুরে পাষ- স্বামী ও সন্তানের জান্তব আচরণের শিকার হয় এক অসহায় নারী। করোনা-সংক্রমণ-সন্দেহে তাকে তার আপনজনরাই বনবাসে বাধ্য করে। এ ঘটনা ঈমানদার বাংলাদেশের পরিচয় বহন করে না। আমরা এমনতর কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না। সতর্কতার নামে প্রপাগা-া ছেড়ে ধৈর্যসহিষ্ণুতা আর ঈমানের শিক্ষা দিতে হবে। মহামহিম আল্লাহর অতাৎক্ষণিক নির্দেশে কারণ সংঘটন সাপেক্ষে সংস্পৃষ্ট প্রায় সবাই যেমন আক্রান্ত হতে পারে, আবার তাৎক্ষণিক নির্দেশে রোগীর সংস্র্রব-সংস্পর্শ ছাড়াও আক্রান্ত হওয়া এবং আক্রান্ত সকাশে সন্নিহিত-সন্নিবিষ্ট হয়েও সংক্রমিত না হওয়ার সম্ভাবনা ও সমূহ প্রমাণ বিদ্যমান। আবার সংক্রমিত হলেই যে অনিবার্যভাবে সবাই রোগাক্রান্ত হবে বিষয়টি এমন নয় এবং রোগাক্রান্ত হলেই যে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী তাও নয়। তাই নির্ভয়ে নিঃশঙ্কচিত্তে ঈমানের দৃঢ়তায় সুন্নাহ অনুযায়ী সব জাগতিক ও বাস্তব উপায় অবলম্বন করেই আমাদের অধিকতর মানবিক হতে হবে। সুন্নাহানুগ আন্তরিকতা ও দায়িত্বানুভূতিতে রোগী-সেবায় হতে হবে আরো অগ্রসর। শুধু তাই নয়, শবযাত্রা-শবানুগমনসহ মৃতের গোসল, জানাজা, দাফন-কাফনেও বিশ্বাসপুষ্ট নির্বিশঙ্ক প্রাতিষ্ঠানিকতা প্রতিস্থাপন করে গাইতে হবে ঈমানের জয়গান।
পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ ধর্মপ্রাণ। তাদের হৃদচেতনারগহন কন্দরে ধর্মের আবাস। সুতরাং যুগধর্ম ইসলামের বিজ্ঞান-ঘনিষ্ঠতায় তাদেরকে সন্নিহিত করা গেলে ইতিবাচক ভাবোদ্দীপনায় ধর্মাবেগকে কাজে লাগিয়ে তারা স্বাস্থ্যবিধির অনুপুঙ্খ বাস্তবায়নে স্বতঃপ্রবৃত্ত হবে। ইতোমধ্যেই প্রভূত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে প্রিয় স্বদেশ। অতএব রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন- এই মুহূর্তে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ-উত্তাল-সমুদ্রের দক্ষ নাবিকের মতো দৃঢ় হাতে দেশের হালটা ধরতে না পারলে মহাধ্বংসযজ্ঞের কবলে নিপাতিত হবো আমরা। ইউরোপ, আমেরিকার তুলনায় আমরা শূন্যহস্ত। ঢাল-তলোয়ার ছাড়াই আমরা যুদ্ধে অবতীর্ণ। শিক্ষিত, অশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত নির্বিশেষে শহর গ্রাম অভেদে নিয়ম মানার যে ভঙ্গুর চিত্র, তাতে বাংলাদেশে বিজ্ঞানের সব সূত্র ব্যর্থ। সূত্র কার্যকর হলে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বিবেচনায় আমাদেরই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার কথা। তা না হওয়াই প্রমাণ করে- আমাদের উপর আল্লাহর অবারিত রহমত এখনো বিদ্যমান। সুতরাং আল্লাহ ছাড়া আমাদের যে আর কোনো ত্রাণকর্তা নেইÑ সেই ভাব-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সব দম্ভ-অহম পরিত্যাগ করে এই প্রলয়ঙ্কর দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা পেতে সর্বদা তাঁরই কাছে আশ্রয় চাইতে হবে। সব প্রচার মাধ্যমে দেশের নাগরিকদের আল্লাহমুখী হতে প্রণোদিত করতে হবে। ন্যায়নিষ্ঠ শাসকের প্রার্থনা আল্লাহ ফিরিয়ে দেন না। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস-১৮৫২) অতএব ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র সর্বপক্ষেই সব ধরনের অন্যায়-অপকর্ম, নিপীড়ন-নিগ্রহ পরিত্যাগ করে ইষ্টাচার আর সাধুতার পথে হাঁটাই এ জগৎ-সংসারের জন্য কল্যাণকর।
অধ্যাপক, আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যলয়, কুষ্টিয়া




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com