কৃষকদের কাছে সুলভ মূল্যে কৃষিযন্ত্র পৌঁছাতে দেশের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এজন্য ২০২৫ সালের মধ্যে ৫২ হাজারের বেশি ভর্তুকির কৃষিযন্ত্র বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তবে এ ভর্তুকির কৃষিযন্ত্র বিতরণ কার্যক্রমে গতি নেই। ২০২০-২১ অর্থবছরে সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি কৃষিযন্ত্র বিতরণের লক্ষ্য নেয়া হয়। তবে এ সময়ে বিতরণ করা হয়েছে অর্ধেকেরও কম। যথাসময়ে অর্থছাড় না হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কৃষি মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের কৃষিকাজের প্রতিটি ধাপে লাগসই কৃষিযন্ত্রের প্রয়োগ জরুরি হয়ে পড়েছে। ধানের চারা রোপণের সময় শ্রমিক সংকটসহ বাড়তি মজুরি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এছাড়া এতে শস্যের উৎপাদনও ব্যাহত করে। সনাতন পদ্ধতিতে বহু শ্রমঘণ্টার বিনিময়ে ধান কাটা, মাড়াইয়ের কারণে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। ফলে কৃষিকে লাভজনক করার জন্য ভৌগোলিক ও কৃষি পরিবেশ বিবেচনায় নিয়ে অঞ্চলভিত্তিক একেক এলাকায় একেক ধরনের কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার করতে হবে। এজন্য ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ নামে একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন সময়কাল ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত। এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৫২ হাজার ৩০০ কৃষি যন্ত্রপাতি দেয়া হবে। এজন্য গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ হাজার ৭৭৬ কৃষিযন্ত্র বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। তবে বিতরণ হয়েছে আড়াই হাজারের কম। হাওর-উপকূলীয় এলাকায় ৭০ শতাংশ এবং অন্যান্য অঞ্চলে ৫০ শতাংশ ভর্তুকিতে কৃষকদের মাঝে এসব যন্ত্র বিতরণ করা হবে।
এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (স¤প্রসারণ) মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয় ভারী ও প্রয়োজনীয় সব ধরনের যন্ত্র কৃষকের কাছে সহজ মূল্যে পৌঁছাতে কাজ করছে। এজন্য দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। আমরা ২২২ কোটি টাকা বরাদ্দ পাই। যার শতভাগ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছি। প্রকল্পের প্রথম বছরে অর্থছাড়ে দেরি হয়েছিল। ফলে আমরা প্রস্তুত থাকলেও বিতরণে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছি। তবে সংকট মোকাবেলায় হাওরাঞ্চলকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। এজন্য হাওরে কোনো ধরনের ক্ষতি ছাড়াই আমরা ধান কাটতে সক্ষম হই। এখন অর্থ ছাড় হওয়ার পর থেকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে কোনো ধরনের ঘাটতি থাকবে না।
জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দপ্রাপ্ত টাকার মাধ্যমে সারা দেশের ১ হাজার ৭৬২টি কম্বাইন হারভেস্টার, ৪৬০টি রিপার, ৩৪টি রাইস ট্রান্সপ্লান্টারসহ প্রায় আড়াই হাজার কৃষিযন্ত্র কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। ১৩টি অঞ্চলে এসব কম্বাইন হারভেস্টার বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে দিনাজপুর অঞ্চলে ১৪৪টি, রংপুরে ৭৪, বগুড়ায় ১৪০, যশোরে ১১৭, রাজশাহীতে ৮৪, খুলনায় ২১, বরিশালে ৯১, ফরিদপুরে ৫২, ঢাকায় ৩১৬, ময়মনসিংহে ২১৬, কুমিল্লায় ১০৯, চট্টগ্রামে ৮৮ এবং সিলেট অঞ্চলে ৩০৮টি। আর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এ প্রকল্পের মাধ্যমে সাড়ে চার হাজারের বেশি কৃষিযন্ত্র বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. বেনজীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, অর্থছাড়ের জটিলতার কারণে আমরা গত অর্থবছরে শতভাগ অর্জন করতে পারিনি। তবে চলতি অর্থবছরে সাড়ে চার হাজারের বেশি কৃষিযন্ত্র বিতরণ করা হবে। এজন্য মাঠ পর্যায়ে সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। স¤প্রসারণ কর্মী ও প্রকৌশলীদের নিয়ে সব ধরনের তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মো. হামিদুর রহমান বলেন, দেশের কৃষিযন্ত্রের সঠিক ব্যবহার ও কার্যক্ষমতা ধরে রাখতে হলে মাঠ পর্যায়ে কৃষি প্রকৌশলীর প্রয়োজন বাড়বে। সেজন্য কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরে কৃষি প্রকৌশল উইং স্থাপনে উদ্যোগ নিতে হবে। যদিও বিষয়টি নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় কাজ করছে। এটি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ প্রক্রিয়া আরো বেগবান হবে। এর আগে ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৯ থেকে ২০১২ সালে খামার যান্ত্রিকীকরণের প্রথম পর্যায়ের প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৮ হাজার ৩৩৮টি বিভিন্ন যন্ত্র বিতরণ করা হয়। এছাড়া ৩৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে জুলাই ২০১৩ থেকে জুন ২০১৯ সালের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের মাধমে ২৪ হাজার ৫১৮টি বিভিন্ন কৃষিযন্ত্র কৃষকদের সরবরাহ করা হয়েছে। ফলে নির্দিষ্টভাবে যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৬৩ হাজার কৃষিযন্ত্র কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। যদিও এসব কৃষিযন্ত্রের সিংহভাগই ছিল ক্ষুদ্র ও মাঝারি। এছাড়া গত অর্থবছর ছাড়াও অন্যান্য সময় মিলিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬৯ হাজার ৮৬৮টি কম্বাইন হারভেস্টার, রিপার, সিডার, পাওয়ার টিলারসহ কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে। তাছাড়া কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সুবিধার্থে ৬১ জেলায় ৫০ একর করে হাইব্রিড বোরো ধানের প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হয়েছে।