খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টায় ফর্মুলা কারের আদলে তৈরি করা হয়েছে ‘কিলোফ্লাইট আলফা’ নামের রেসিং কার। শিক্ষার্থীরা ‘কিলোফ্লাইট’ নামের একটি টিম গঠন করে এ গাড়িটি প্রস্তুত করেন। ফর্মুলা স্টুডেন্ট ইউকে প্রতিযোগিতার অনলাইন ইভেন্টে অংশ নিয়েছে কিলোফ্লাইট আলফা গাড়িটি।
এই প্রতিযোগিতার লাইভ ও অনলাইন দুটি ইভেন্টে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৬৪টি দেশ অংশ নেয়। যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলেছে। তিন বছরের চেষ্টায় গাড়িটি তৈরি করে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে দেশকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন কুয়েট শিক্ষার্থীরা। গাড়িটির বডিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ পরিবেশবান্ধব পাট দিয়ে তৈরি হওয়ায় পাটশিল্পকে নতুন উচ্চতায় নেওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
এ ছাড়া টিম কিলোফ্লাইটের সদস্যরা এবার চালকবিহীন গাড়ি তৈরি করতে যাচ্ছেন। তবে সরকারি বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের ব্যবস্থা হলে কুয়েটের শিক্ষার্থীদের তৈরি গাড়ি বিশ্বদরবারে আলোড়ন সৃষ্টি করবে।
কুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও কিলোফ্লাইটের ড্রাইভ ট্রেইন এক্সপার্ট অম্লান বিশ্বাস বলেন, গাড়িটি মূলত ফর্মুলা স্টুডেন্ট ইউকে টার্গেট করে বানানো। এ গাড়িটির বিশেষত্ব হলো, সম্পূর্ণ বডি জুট ফাইবার দিয়ে তৈরি করা। যেটা দেশের ঐতিহ্যকে ধরে রাখবে। এতে উন্নত মানের ইঞ্জিন, গিয়ার, ব্রেক, মিটার দেওয়া রয়েছে। চালকের জন্য রয়েছে সুরক্ষাব্যবস্থা। গাড়িটি ঘণ্টায় ১৬২ কিলোমিটার বেগে চলতে পারবে।
তিনি বলেন, গাড়িটি তৈরির পর ফর্মুলা স্টুডেন্ট ইউকে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। ফর্মুলা স্টুডেন্ট ইউকে হচ্ছে স্টুডেন্টদের জন্য একটি ইঞ্জিনিয়ারিং রেসিং কম্পিটিশন। করোনার কারণে তারা প্রতিযোগিতাকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। একটা হচ্ছে লাইভ ইভেন্ট এবং অন্যটি হচ্ছে অনলাইন ইভেন্ট। করোনার রেডজোনের কারণে ইউরোপের দেশগুলো লাইভ ইভেন্ট এবং বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ অন্য দেশগুলো অনলাইন ইভেন্টে অংশ নিয়েছে। বিশ্বের ৬৪টি দেশের মধ্যে আমরা ৩৩তম হয়েছি। এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে একমাত্র আমরাই অংশ নিয়েছি। এটা আমাদের জন্য একটা বড় অর্জন।
আগামী বছর চ্যাম্পিয়নশিপের টার্গেট করেই কাজ করছি। আশা করছি দেশবাসীকে গর্বিত করতে পারব। বাংলাদেশে গাড়ির উন্নয়নে কাজ করব। এই লক্ষ্য নিয়ে আমাদের গাড়ি তৈরি করা। প্রতিবছর নতুন নতুন গাড়ি উদ্ভাবনের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
কুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও কিলোফ্লাইটের টিম ম্যানেজার সাফায়েত সাইমুম বলেন, টিম কিলোফ্লাইট ২০১৮ সালে সৃষ্টি হয়েছে। শুরুর পর চলতি বছরের জুলাই মাসে গাড়িটি তৈরি সম্পন্ন হয়। এটি তৈরির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া। এতে প্রতিযোগিতার বিচারকরা বলতে পারবেন আমরা গাড়িটা কত ভালো মানের বানিয়েছি। মূলত এ জন্যই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া।
একই ডিপার্টমেন্টের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী এরফান ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অটোমোবাইলে আমাদের দেশকে এগিয়ে নিতে এবং দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার তৈরির জন্য এই উদ্যোগ। কুয়েটের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও নিজেদের অর্থায়নে এই রেসিং কারটি প্রস্তুত করা হয়েছে। সরকারি এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থায়ন গেলে ভালো হয়। এই গাড়িটি পরিবেশবান্ধব পাট দিয়ে বানানো। এটির বডি ও অ্যারো জুট ফাইবার কম্পোজিট দিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। বিষয়টি আমাদের পাটশিল্পকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখবে। এখন বিশ্বের সবক্ষেত্রে কার্বন ফাইবার ব্যবহার করা হয়। সেখানে যদি দেশীয় তৈরি জুট ফাইবার দিয়ে রিপ্লেস করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরনের সুযোগ হবে।
তিনি বলেন, গাড়ি তৈরি করে বিশ্বদরবারে দেশ ও নিজ বিশ্ববিদ্যালয়কে রিপ্রেজেন্ট করতে পেরেছি। এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। এই প্রতিযোগিতায় ৬৪টি দেশ অংশগ্রহণ করে। সেখানে আমাদের টিম ৩৩তম হয়েছে। এখন আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে কম্বোনেশন ভেইকলের পাশাপাশি ড্রাইভার লেস ভেইকল বানাব।
কুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী ও টিম কিলোফ্লাইটের নতুন সদস্য মহিদুল ইসলাম বলেন, কাজটি আমাদের জন্য ইনক্রেজিং। কারণ ফর্মুলা স্টুডেন্টে আমাদের দেশ থেকে আমরা প্রথম অংশগ্রহণ করি। পরবর্তী সময়ে আমরা আরও ভালো করার চেষ্টা করব। যাতে দেশবাসী আমাদের নিয়ে গর্ববোধ করতে পারে।
কুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার ড. মুহাম্মদ মাছুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আড়াই বছর আগে প্রথম কাজটি শুরু করে। প্রজেক্টের শুরু থেকেই তাদের একাডেমিক অ্যাডভাইজার হিসেবে ছিলাম আমি। শিক্ষার্থীদের ২৮ জনের টিমকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর তারা নিজেরাই ডিজাইন করে সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে এবং আমাদের শিক্ষকদের সহযোগিতায় সফলভাবে শেষ করতে পেরেছে। এ জন্য আমি গর্বিত।
শিক্ষার্থীরা নিজস্ব টেকনোলজিতে গাড়ি তৈরি করেছে, কুয়েটে এটিই প্রথম। এটা বিশ্ববিদ্যালয় ও ডিপার্টমেন্টের গর্বের। একই সঙ্গে দেশের জন্য এটি একটি মাইলফলক। যদি আমরা অটো মোবাইল ইন্ডাস্ট্রির ডেভেলপমেন্ট চাই, তাহলে এই কাজের জন্য ছাত্রদের উৎসাহিত করতে পারি– ড. মুহাম্মদ মাছুদ
তিনি বলেন, এই প্রজেক্টে সাবেক শিক্ষার্থী এবং নিজস্ব অর্থায়ন ও মেধা খাটিয়ে গাড়িটি তৈরি করেছে। ফান্ড কালেকশনে যে পরিমাণ মেধা ও সময় ব্যয় করেছে, সেটা যদি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা সরকারি অর্থায়নে হতো, তাহলে তাদের সময় ও মেধা গাড়ি তৈরির কাজে লাগাতে পারত। এতে কাজটি দ্রুত এবং ভালো হতো।
কুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. সাহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিবেশবান্ধব উপাদান দিয়ে তারা গাড়িটি তৈরি করেছে। পরিবেশবান্ধব বলা হচ্ছে কারণ জুট কম্পোজিট করে এটা তৈরি করা হয়েছে। করোনার কারণে আমরা কুয়েটের ল্যাব ব্যবহার করতে দিতে পারিনি। ৫ থেকে ৭ জনের গ্রুপ করে তারা প্রজেক্ট সম্পন্ন করেছে। উন্নত বিশ্বে এই ধরনের প্রজেক্ট নিয়ে অনেক রিসার্চ চলছে। আমাদের গর্ব কুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীরা গাড়িটা তৈরি করেছে। কিন্তু কোভিডের কারণে তারা স্বশরীরে প্রতিযোগিতায় যোগদান করতে পারেনি। আশা করি আগামী বছর তারা ইংল্যান্ডে স্বশরীরে অংশ নিতে পারবে। একই সঙ্গে প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় হবে। কুয়েটের শিক্ষার্থীরা এই রেসিং কার দিয়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, কিলোফ্লাইট প্রজেক্ট দিয়ে সারা বিশ্বে আলোড়ন তৈরি করতে পারবে, সেই আশা করছি। তবে এই প্রজেক্ট নিজস্ব এবং সাবেক শিক্ষার্থীদের অর্থায়নে করা হয়েছে। সরকারি অর্থায়ন পেলে তারা আরও ভালো করতে পারত। সরকার সব বিষয়ে সহযোগিতা করছে, এ ব্যাপারেও ফান্ড দেবে বলে আশা করছি।- ঢাকাপোস্ট.কম