চলতি বছরের শুরু থেকে চলছে করোনা প্রতিরোধী টিকাদান কার্যক্রম। মহামারী থেকে বেরিয়ে আসতে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এ টিকা। এরই মধ্যে পর্যাপ্ত টিকা প্রয়োগের কাছাকাছি ধনী দেশগুলো। কিছু দেশ শুরু করেছে বুস্টার ডোজও। যদিও উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে তলানিতেই পড়ে আছে টিকাদানের হার। চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে মিলছে না টিকার চালান। টিকাদানে এমন বৈষম্যের কারণে বৈশ্বিক জিডিপি কয়েক লাখ কোটি ডলার হারাতে চলেছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) এক প্রতিবেদনে এমনটা জানিয়েছে। মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে টিকাদান কার্যক্রমের অসমতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলো। ইআইইউ পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে জনসংখ্যার ৬০ শতাংশকে টিকা দিতে ব্যর্থ হওয়া দেশগুলো ২০২২ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার হারাবে।
ইআইইউর বৈশ্বিক পূর্বাভাসবিষয়ক পরিচালক অ্যাগাথ ডিমারিস বলেন, এ ক্ষতির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই বহন করবে উদীয়মান অর্থনীতিগুলো। এ পরিস্থিতি উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে উদীয়মান অর্থনীতির ব্যবধানকে আরো বিস্তৃত করবে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত মহাদেশ হবে এশিয়া। এ অঞ্চলে ক্ষতির পরিমাণ ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলার কিংবা পূর্বাভাস দেয়া জিডিপির ১ দশমিক ৩ শতাংশের সমান হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলো তাদের পূর্বাভাসকৃত জিডিপির প্রায় ৩ শতাংশ হারাবে, যা শতাংশের দিক থেকে সর্বোচ্চ।
যদিও এ পূর্বাভাস কেবল আংশিক বলে জানিয়েছে ইআইইউ। এ হিসাবে কেবল আংশিকভাবে হারানো অর্থনৈতিক সুযোগগুলো ধরা হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থার ওপর মহামারীটির প্রভাব বিবেচনায় নেয়া হয়নি। লকডাউনের সময় ধনী দেশগুলো দূরবর্তী শিক্ষার দিকে মনোনিবেশ করেছিল। তবে উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেকের কাছেই সেই বিকল্প ছিল না। টিকাদান কার্যক্রম এগিয়ে নেয়ার মাধ্যমে এরই মধ্যে ধনী দেশগুলো পুনরায় অর্থনীতি চালু করেছে এবং বুস্টার ডোজ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। যেখানে দরিদ্র দেশগুলো টিকাদানের দৌড়ে মারাত্মকভাবে পিছিয়ে রয়েছে। বিজ্ঞানবিষয়ক জার্নাল আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটার সংকলিত তথ্য অনুসারে, ২৩ আগস্ট পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫০০ কোটি ডোজ কভিড-১৯ টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে দরিদ্র দেশগুলোতে দেয়া হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৫০ লাখ ডোজ টিকা।
ইআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে টিকার উৎপাদন ক্ষমতা, কাঁচামালের অভাব, পরিবহন ও সংরক্ষণে জটিলতা এবং টিকা নিতে অবিশ্বাসের কারণে এমন বৈষম্য আরো বেড়েছে। অনেক উন্নয়নশীল দেশ টিকার ব্যয় বহন করতে সক্ষম নয়। এক্ষেত্রে দেশগুলো ধনী দেশের অনুদানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। যদিও বৈশ্বিক উদ্যোগ দেশগুলোর চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে টিকা সরবরাহ করতে পারছে না। ইআইইউর ডিমারিস এক বিবৃতিতে বলেন, টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে এমন বৈষম্য দূর হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতার উদীয়মান অর্থনীতিগুলোকে টিকা পাঠানোর উদ্যোগ কোভ্যাক্স প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। উদার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ধনী দেশগুলোর অনুদান প্রয়োজনীয়তার মাত্র ক্ষুদ্র একটি ভগ্নাংশ পূরণ করতে পেরেছে।
ইউনিসেফের ট্র্যাকারের হিসাবে, চলতি বছর কোভ্যাক্স প্রায় ২০০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহের লক্ষ্য নিয়েছিল। যদিও এখন পর্যন্ত মাত্র ২১ কোটি ৭০ লাখ ডোজ সরবরাহ করা হয়েছে। আবার এ টিকার সরবরাহও যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মতো উন্নত দেশে গেছে। এদিকে নিরাপত্তার কারণে পর্যটকরা টিকাদানে পিছিয়ে থাকা দেশগুলো এড়িয়ে চলতে পারেন। বাসিন্দারা অসন্তুষ্ট হতে পারে যে তাদের সরকার টিকা সরবরাহে অক্ষম। যেখানে উন্নত রাজ্যগুলো ডোজ সঞ্চয় করছে। প্রতিবেদনে ডিমারিস লিখেছেন, আগামী মাস ও বছরগুলোতে সামাজিক অস্থিরতার আশঙ্কা খুব বেশি।
বাংলাদেশের কি হবে : বিশ্ব অর্থনীতির শেষ মন্দা এসেছিল ২০০৮ সালে। বেশ একটা আত্মতৃপ্তির মধ্যে ছিল বাংলাদেশ। বিশ্বমন্দা বাংলাদেশকে কিছুই পারেনি—এই বক্তৃতা শুনতে হয়েছে বহুদিন। তবে অর্থনীতিবিদেরা ঠিকই জানতেন যে সে সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে তেমন সংযুক্ত ছিল না। অন্যদিকে সেই বিশ্বমন্দা বাংলাদেশের উপকারেই লেগেছিল। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে বাংলাদেশ বেশ বিপাকেই ছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে এসে বিশ্বমন্দার সুবিধা পায়। সে সময় জ্বালানি তেলের দাম হ্রাস পায়, কমে যায় খাদ্যপণ্যের দাম। ২০২০ সালের পরিস্থিতি ভিন্ন। চীন থেকে শুরু হয়ে করোনাভাইরাস ইউরোপে ছড়াচ্ছে। ইউরোপ বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বড় বাজার। মন্দার কারণে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে চাহিদা কমে গেলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বড় বিপাকে পড়ে যাবে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেকটি বড় খাত প্রবাসী আয়। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দায় বিপদে পড়বে এই খাতও। আর দেশের মধ্যে সব চেয়ে বড় বিপদের নাম রাজস্ব খাত। অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে গেলে, ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি শ্লথ হয়ে পড়লে প্রভাব পড়বে রাজস্ব আদায়ে। এমনিতেই চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই প্রবাসী আয় ছাড়া আর কোনো সূচকে ভালো খবর ছিল না। করোনাভাইরাসে বিশ্বমন্দা প্রকট হলে এবারও বাংলাদেশ বিপদমুক্ত থাকবে, এমনটি বলা যাবে না।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও (এডিবি) বলেছে, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব মহামারি অবস্থায় গেলে এক বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৯ লাখ কর্মসংস্থান কমে যেতে পারে। আর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ক্ষতি হতে পারে ৩০২ কোটি ডলার। আর এতে বাংলাদেশে এক বছরে জিডিপির ক্ষতি হতে পারে ১ শতাংশের বেশি। আর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সেবা খাতে। এর পরিমাণ হতে পারে ১১৪ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। এ ছাড়া কৃষি খাতে ৬৩ কোটি ডলার, হোটেল, রেস্তোরাঁ ও এ-সংক্রান্ত সেবা খাতে প্রায় ৫১ কোটি ডলার, উৎপাদন ও নির্মাণ খাতে প্রায় ৪০ কোটি ডলার এবং পরিবহন খাতে ক্ষতি হতে পারে সাড়ে ৩৩ কোটি ডলার।
তাহলে কী করতে হবে: যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংক কিংবা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো বহুপক্ষীয় সংস্থাকে একটি টাস্কফোর্স গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন। এই টাস্ক ফোর্সে অর্থনীতিবিদ, স্বাস্থ্য ও ভূরাজনৈতিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের ২০ জন বিশেষজ্ঞ থাকতে পারেন বলে তিনি লিখেছেন।
পরিস্থিতি যত খারাপ হচ্ছে, অর্থনীতি নিয়ে উৎকণ্ঠাও তত বাড়ছে। একই সঙ্গে করণীয় নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে প্রথম কাজটি হচ্ছে প্রাদুর্ভাব কমানো। আন্তর্জাতিক সংস্থা অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) সম্প্রতি বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। বলা যায়, একটি কাঠামো তৈরি করে দিয়েছে। সেখানে মানুষ, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও সামষ্টিক নীতি নিয়ে কিছু করণীয়র কথা রয়েছে। এ অবস্থায় করোনাভাইরাসের প্রভাবে এখন মৃত্যু ঠেকানো যেমন প্রয়োজন, তেমনি দরকার উঠে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করা। সেটাই সামনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
টিকায় অসমতা দূর করার আহ্বান হু’র: বিশ্বে টিকাদানে ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে যে অসমতা রয়েছে তা দূর করার আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। টিকা অসমতাকে ‘লজ্জানক ও অমর্যাদাকর’ অভিহিত করে বিশ্বনেতাদের বিশেষ করে ২০ উন্নত দেশের নেতাদের প্রতি এই আহ্বান জানান সংস্থাটির প্রতিনিধি ও মহাপরিচালকের সিনিয়র উপদেষ্টা ড. ব্রুস আইলওয়ার্ড। মঙ্গলবার ‘ভ্যাকসিন একুইটি’ শীর্ষক এক প্রশ্নোত্তর পর্বে ব্রুস বলেন, ‘বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের জোর পরামর্শ হচ্ছে-অপেক্ষাকৃত ছোট জনসংখ্যাকে টিকা দেওয়ার বড় জনসংখ্যাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। টিকার ঘাটতির মুখে বিষয়টাকে আমাদের বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখতে হবে।’ এএফপি।
প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত টিকা মজুত করছে বিশ্বের ধনী দেশগুলো। এতে করে দরিদ্র দেশগুলো পড়েছে বিপাকে। এমনকি টিকা পেতে দেশগুলো জটিলতায়ও পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। টিকা নিয়ে ধনী দেশগুলোর তীব্র সমালোচনা করে টিকা বৈষম্য দূর করতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থার করোনাভাইরাস মহামারি বিষয়ক লড়াইয়ে সামনে থেকে দায়িত্ব পালনকারী হলেন কর্মকর্তা ব্রুস আইলওয়ার্ড। তিনি দরিদ্র দেশগুলোতে টিকা দেওয়া কার্যক্রম বৃদ্ধিতে রাজনীতিক এবং ব্যবসায়ী ধনকুবেরদের প্রতি আহ্বান রাখার জন্য অনুরোধ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত এক প্রশ্নোত্তর পর্বে কারো নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, সম্ভবত বিশ্বে ২০ জন মানুষ আছেন, যারা টিকার অসমতা বিষয়ক সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের রয়েছে বড় বড় কোম্পানি। এসব বিষয়ে দায়িত্ব পালনে তারা ইনচার্জের অবস্থানে আছেন। তারা এমন সব দেশের নেতৃত্বে আছেন, যারা বিশ্বের বেশির ভাগ টিকা নিজেদের দখলে রেখেছেন। তারা এমন সব দেশের প্রধান, যারা নিজেরা টিকা উৎপাদন করছেন। ওই ২০ জন মানুষকে আমাদের বলা উচিত-সেপ্টেম্বর শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই এসব সমস্যা সমাধান করতে হবে। নিশ্চিত হতে হবে যে, প্রতিটি দেশের শতকরা ১০ ভাগ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৫০ কোটি ডোজ টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক উচ্চ আয়ের দেশ হিসাবে যাদের শ্রেণিবিন্যাস করেছে, সেসব দেশে প্রতি ১০০ জন মানুষকে ১০৪টি ডোজ প্রয়োগ করা হয়েছে। অন্যদিকে নি¤œআয়ের ২৯টি দেশে প্রতি ১০০ জন মানুষে টিকা দেওয়া হয়েছে মাত্র দুই ডোজ। এ নিয়ে আমাদেরই লজ্জিত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন ব্রুস আইলওয়ার্ড। তিনি বলেন, আমি সাহায্য করতে পারি না। কিন্তু ভাবতে পারি, যদি বিশ্বের কাছ থেকে আটকে রাখা টিকাগুলো পেতাম বা পাওয়ার চেষ্টা করতাম, তাহলে পরিস্থিতি কি আজকের মতো এত খারাপ অবস্থায় আসত।