গত বছর দেশে ভুট্টার উৎপাদন হয়েছে সাড়ে ৫৬ লাখ টন, যা গত পাঁচ বছরের দ্বিগুণেরও বেশি। তবু দেশে চাহিদার তুলনায় ভুট্টার ঘাটতি রয়ে গেছে। কারণ প্রাণিখাদ্য হিসেবে প্রতিবছর দেশে ভুট্টার প্রয়োজনীয়তা ছাড়িয়ে গেছে ৭০ লাখ টন। স্বাভাবিকভাবেই এই অল্প সময়ে বেশ বেড়েছে ভুট্টার দামও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন দেশে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার ভুট্টার কারবার হচ্ছে। বীজ আমদানি থেকে শুরু করে ভুট্টা রফতানি পর্যন্ত চলে এ কর্মযজ্ঞ।
তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ২১৭ কোটি টাকার ভুট্টার হাইব্রিড বীজ আমদানি হয়েছে। পাশাপাশি দেশি কিছু কোম্পানিও বীজ বিক্রি করছে। এছাড়া প্রতি কেজি ১৫ টাকা হিসাবে দেশে উৎপাদিত ভুট্টার মূল্য প্রায় আট থেকে নয় হাজার কোটি টাকা। বাকিটা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণসহ ভুট্টা আমদানি-রফতানি ও অন্যান্য কার্যক্রমে যুক্ত। সরকারও এখন ভুট্টা থেকে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য তৈরিতে গুরুত্ব দিচ্ছে। খাদ্যশিল্পে ভুট্টা ব্যবহারের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। দেশে প্রচুর কর্নফ্লাওয়ার, স্টার্চ প্রয়োজন হয়, সেটা আমদানি করা হচ্ছে
দেশের প্রাণিখাদ্যের বাজার এখন ভুট্টার ওপর নির্ভরশীল। মাছ, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির উৎপাদন বাড়ায় ভুট্টার খাবারের চাহিদাও বাড়ছে। দেশের শতাধিক কোম্পানি এসব খাদ্য প্রস্তুত করছে। পাশাপাশি ভুট্টা চাষ, মানুষের বিভিন্ন খাদ্য তৈরি, আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতসহ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণে যুক্ত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। সবমিলিয়ে দেশে এখন ভুট্টার বড় কারবার চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতোমধ্যে দেশের অন্যতম শিল্পপ্রতিষ্ঠান নাসির গ্রুপ ভুট্টা থেকে স্টার্চ তৈরির কারখানা করেছে। আরও একটি গ্রুপ ইতোমধ্যে কারখানা করার প্রস্তুতি নিয়েছে। এ দুটি গ্রুপের পাশাপাশি বিভিন্ন ছোট-বড় কোম্পানি ভুট্টা থেকে মানুষের খাদ্য তৈরিতে বিনিয়োগে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ড. মো. আমিরুজ্জামান বলেন, ‘সরকারও এখন ভুট্টা থেকে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য তৈরিতে গুরুত্ব দিচ্ছে। খাদ্যশিল্পে ভুট্টা ব্যবহারের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। দেশে প্রচুর কর্নফ্লাওয়ার, স্টার্চ প্রয়োজন হয়, সেটা আমদানি করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘বড় বড় বিনিয়োগকারীরাও আগ্রহ দেখাচ্ছে। ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আগামীতে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ বাড়ানো হলে দেশে প্রচুর ভুট্টা লাগবে। আমরা উৎপাদন সেই হারে বাড়াতে কাজ করছি।’ পাঁচ বছর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ভুট্টার উৎপাদন হয়েছিল ২৭ লাখ টন। যা গত ২০২০-২১ অর্থবছরে এসে দাঁড়ায় সাড়ে ৫৬ লাখ টনে। দেশে বর্তমানে সাড়ে পাঁচ লাখ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হচ্ছে। দেশে গত কয়েক বছরে ভুট্টার উৎপাদনশীলতা বেশ বেড়েছে। এখন হেক্টরপ্রতি প্রায় ৯ দশমিক ৭৪ টন ভুট্টার ফলন হচ্ছে, যা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। হেক্টরপ্রতি সবচেয়ে বেশি ফলনের রেকর্ড তুরস্কের। সেখানে হেক্টরে সাড়ে ১১ টন ভুট্টার ফলন হয়
পাঁচ বছরে ভুট্টার দ্বিগুণ উৎপাদন: ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, পাঁচ বছর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ভুট্টার উৎপাদন হয়েছিল ২৭ লাখ টন। যা গত ২০২০-২১ অর্থবছরে এসে দাঁড়ায় সাড়ে ৫৬ লাখ টনে। দেশে বর্তমানে সাড়ে পাঁচ লাখ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হচ্ছে। দেশে গত কয়েক বছরে ভুট্টার উৎপাদনশীলতা বেশ বেড়েছে। এখন হেক্টরপ্রতি প্রায় ৯ দশমিক ৭৪ টন ভুট্টার ফলন হচ্ছে, যা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। হেক্টরপ্রতি সবচেয়ে বেশি ফলনের রেকর্ড তুরস্কের। সেখানে হেক্টরে সাড়ে ১১ টন ভুট্টার ফলন হয়।
বাড়ছে চাহিদা: দেশে গ্রীষ্ম ও শীত দুই মৌসুমে ভুট্টা চাষ হয়। তবে মোট উৎপাদনের ৮৭ শতাংশই হয় শীত মৌসুমে। কিন্তু দেশে ভুট্টার চাহিদা থাকে সারাবছর। পাল্লা দিয়ে দিন দিন চাহিদা বাড়ছে। সারাবছরে শস্যটির চাহিদা থাকে ৭০ লাখ টনের বেশি।
ভুট্টা চাষের পর সেই জমিতে আবার পাটের আবাদ করা হচ্ছে। অন্যান্য ফসলের তুলনায় ভুট্টা চাষে খরচ ও পরিশ্রম কম। আমার এলাকায় আগের থেকে ভুট্টার উৎপাদন যে বেড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই বাড়তি চাহিদা পূরণ হচ্ছে আমদানির মাধ্যমে। গত অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রায় ১৮ লাখ টন ভুট্টা আমদানি হয়েছিল। এই পরিমাণ আগে আরও বেশি ছিল। উৎপাদন দ্রুত বাড়ায় দেশে ভুট্টার আমদানি দিন দিন কমছে। প্রাণিখাদ্য তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, দেশে প্রাণিখাদ্যের বাজার বছরে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। প্রাণিখাদ্য তৈরির বড় অংশই ভুট্টা থেকে আসে। এর মধ্যে মুরগির খাদ্য তৈরিতে ৫৫ শতাংশ ভুট্টার দরকার হয়। এ হার গবাদিপশুর খাদ্যে ৩০ শতাংশ এবং মাছের ক্ষেত্রে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। শুধু এ তিন খাতে বছরে ৪৫ লাখ টন ভুট্টার চাহিদা রয়েছে।
নতুন সম্ভাবনা ভুট্টার তেল ও অন্যান্য পণ্য: সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে ভুট্টার তেল। বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, বছরে দেশে উৎপাদিত ৫৪ লাখ টন ভুট্টা থেকে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার টন ভুট্টার তেল আহরণ করা সম্ভব। যার বাজার মূল্য প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।
ইনস্টিটিউটের তথ্যে আরও জানা গেছে ,বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৫২টি দেশে ভুট্টা থেকে উৎকৃষ্ট মানের ভোজ্যতেল উৎপাদিত ও ব্যবহৃত হয়। ভুট্টার তেল স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিসমৃদ্ধ। এতে কোনো আমিষ বা শর্করা নেই, শতকরা ১০০ ভাগই চর্বি বিদ্যমান, যার পুষ্টিমান অন্যান্য তেলের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি। জানা গেছে, ভুট্টার তেলে বিদ্যমান সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড ও অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড সয়াবিন ও সূর্যমুখী তেলের সমপরিমাণ। ভুট্টার তেলে ভিটামিন ‘ই’ (টোকোফেরল) এর পরিমাণ সূর্যমুখী তেলের চেয়ে বেশি। বিশেষত ভুট্টার তেলে ভিটামিন কে (১.৯ মাইক্রো গ্রাম) রয়েছে যেখানে সয়াবিন ও সূর্যমুখী তেলে তা অনুপস্থিত। এছাড়া সালাদ, বিস্কুট, চানাচুর, কেক, পাউরুটি, মাখন তৈরি করতে ভুট্টার তেল ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে ভুট্টা থেকে স্টার্চ, ইথানল, চিনি, সিরাপ এবং কা-, পাতা ও ডাঁটা থেকে কাগজ, কার্ড বা হার্ডবোর্ড, প্লাস্টিক পাইপসহ বহু শিল্পজাত দ্রব্য তৈরি করা যায়। ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট সেগুলো নিয়ে কাজ করছে।
উদ্ভাবন হচ্ছে নতুন নতুন জাত: কোয়ালিটি প্রোটিন ও প্রো-ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ ভুট্টার জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি পপকর্ন, বেবিকর্ন ও মিষ্টি ভুট্টার জাত উদ্ভাবনে কাজ করছে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট। এ পর্যন্ত ১৯টি হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
ইনিস্টিটিউটের কর্মকর্তারা বলছেন, হঠাৎ করেই কৃষকরা ভুট্টা চাষে আগ্রহী হয়েছেন। চরাঞ্চল ও পতিত জমিতে ভুট্টার আবাদ বাড়ছে। বর্তমানে যেসব ভুট্টার বীজ উদ্ভাবন করা হয়েছে তাতে করে সারা বছরই ভুট্টার আবাদ করা যাবে। ফলে দেশের যে চাহিদা তা অনায়াসেই উৎপাদিত হবে। মানুষের খাদ্য হিসেবে ভুট্টার ব্যবহার বাড়াতে এখন জোরেশোরে কাজ চলমান রয়েছে। এজন্য ভুট্টার তেল, পপকর্ন, বেবিকর্ন, মিষ্টি ভুট্টার জাত উদ্ভাবনে বিজ্ঞানীরা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। ভুট্টার আবাদ বাংলাদেশে এমন বাড়বে যে বিশ্বে একসময় বাংলাদেশই ভুট্টা উৎপাদনে নেতৃত্ব দেবে।
উৎপাদনে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকের: কৃষকরা জানান, অন্যান্য খাদ্যশস্যের চেয়ে কম পরিচর্যা ও কম সেচ খরচে ভুট্টার ভালো ফলন হচ্ছে। এছাড়া তারা গত কয়েক বছর ভুট্টার ভালো দামও পাচ্ছেন। এ কারণে ভুট্টায় আগ্রহ বাড়ছে তাদের।
অন্যান্য ফসলের তুলনায় ভুট্টা চাষে খরচ ও পরিশ্রম কম: ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ভানোর গ্রামের ভুট্টাচাষি আসলাম হোসেন জানান, এ বছর তিনি বিঘাপ্রতি ৩২ মন ভুট্টার ফলন পেয়েছেন। তিনি পাঁচ বিঘা জমিতে ভুট্টার আবাদ করেছেন। ভুট্টা বিক্রি করেছেন ৯০০ টাকা মণে। ভালো দাম থাকায় অন্য যে কোনো ফসলের চেয়ে বেশি লাভ পাচ্ছেন তিনি। আসলাম হোসেন বলেন, ‘ভুট্টা চাষের পর সেই জমিতে আবার পাটের আবাদ করা হচ্ছে। অন্যান্য ফসলের তুলনায় ভুট্টা চাষে খরচ ও পরিশ্রম কম। আমার এলাকায় আগের থেকে ভুট্টার উৎপাদন যে বেড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’-জাগোনিউজ২৪.কম