ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে আর কোনো ভোটে না যাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। সেটা স্থানীয় সরকারের যে কোনো নির্বাচন হোক, উপনির্বাচন হোক বা আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনই হোক। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার থেকে ধারাবাহিকভাবে তিন দিনের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে দলের হাইকমান্ডকে এমন বার্তাই দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তে দলের নীতিনির্ধারকরাও একমত। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের সামনে এখন মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার দাবি আদায় করা। সেই সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন চায় দলটি। বিএনপি মনে করে, সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত হচ্ছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন কিংবা স্থানীয় প্রশাসন দলীয় বৃত্তের বাইরে যেতে পারে না। এ কারণেই জাতীয় নির্বাচনের প্রায় দুই বছর আগে নির্দলীয় সরকার দাবি তুলছে। এ দাবিকে মূল এজেন্ডা হিসেবে সামনে রেখে নতুন করে আন্দোলনের ছকও তৈরি করছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাজনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে প্রথম আওয়ামী লীগের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই পাঁচটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ক্ষমতায় এসেই আওয়ামী লীগ এই পদ্ধতি বাতিল করে। তারা এখন ভোট ব্যবস্থাপনার কবর রচনা করেছে। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, কাউকে ভোট দিতে কেন্দ্রেও যেতে হয় না। দিনের ভোট আগের রাতে হয়ে যায়। দেশে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক চর্চা হচ্ছে না। কোনো কিছুরই তোয়াক্কা না করে গায়ের জোরে পুরোপুরি স্বৈরাচারী কায়দায় তারা ক্ষমতায় টিকে আছে। এখানে জনগণের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। মূলত এ কারণেই বিএনপি নেতা-কর্মীরা মনে করেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো ভোটে যাওয়া ঠিক হবে না।’
জানা যায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি একটি রূপরেখা প্রণয়ন করছে। একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার পদ্ধতির একটি ফর্মুলাও দেবে বিএনপি। দলটি মনে করে, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকায় সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আওয়ামী লীগ রাজি না হলেও আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য থেকেই একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার পদ্ধতি বের করা সম্ভব। সেই দাবি নিয়ে নিয়েই মাঠে থাকবে বিএনপি।
বিএনপির একাধিক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, নির্দলীয় নির্বাচন, বেগম জিয়ার মুক্তি ও জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করাসহ অন্তত ১২ দফা দাবি নিয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই মাঠে নামার পরিকল্পনা নিয়েছে দলটি। এর আগেই বিভাগীয় শহর ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ জেলাগুলোতে সমাবেশ করার চিন্তা করছে দলটি। দেশের অন্তত ৩০টি সমাবেশ করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। সভা-সমাবেশসহ রাজপথের নানা কর্মসূচি আর সাংগঠনিক পুনর্গঠন কার্যক্রমে তৃণমূল হতাশায় আচ্ছন্ন থাকা মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা উজ্জীবিত হবে। যৌক্তিক দাবি নিয়ে জনগণের কাছে যেতে পারলে জনমত সৃষ্টি করাও সম্ভব হবে। দলের নীতিনির্ধারকরাও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু বলেন, ‘আওয়ামী লীগের অধীনে ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। ওই সময় ভোট পড়েছে মাত্র শতকরা ২ থেকে ৫ শতাংশ। এরপর তাদের অধীনে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগের রাতেই আওয়ামী লীগ ভোট কেন্দ্র দখল করে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়। এই আওয়ামী লীগ, নির্বাচন কমিশন ও বর্তমান প্রশাসন একাকার হয়ে এসব অবৈধ কাজ করেছে। তাই আওয়ামী লীগের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিংবা অন্য কোনো নির্বাচনে যাওয়া মানে তাদের অনৈতিক কাজকে বৈধতা দেওয়া। এ কারণেই আমরা বলছি, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ও নির্বাচন কমিশন ছাড়া আর কোনো ভোটে যাওয়া ঠিক হবে না। দেশব্যাপী জনমত সৃষ্টি করে আন্দোলনের বিকল্প নেই। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই হিসেবে ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আগামী নির্বাচনে অন্তত দেড় শ আসনে ইভিএমে ভোট করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে নির্বাচন কমিশন। তবে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ আছে ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তারাই নির্ধারণ করবে, কত আসনে ইভিএমে ভোট হবে। এরই মধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠন হবে, না আইন করে গঠন হবে, না অন্য কোনো বিকল্প পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে তা নিয়ে এখনই উত্তাপ শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ আইনি প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন গঠনের পক্ষে থাকলেও বিএনপি বলছে, সার্চ কমিটিই হোক আর আইনি প্রক্রিয়ায় হোক আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন হতে পারে না।
বিএনপি সূত্র জানায়, এবার আটঘাট বেঁধেই দাবি নিয়ে মাঠে নামতে চায় বিএনপি। এ জন্যই নির্বাহী কমিটির নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক সভায় নেতাদের মতামতের পাশাপাশি রাজপথে থাকার অঙ্গীকার নেওয়া হচ্ছে। আগামী ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে টানা তিন দিন নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবে বিএনপির হাইকমান্ড। এরপর পর্যায়ক্রমে পেশাজীবী সংগঠনসহ বিশিষ্টজনদেরও মতামত নিয়ে দ্বাদশ নির্বাচনের একটি রূপরেখা প্রণয়ন করবে। ওই রূপরেখা ধরেই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পথে এগোবে বিএনপি। সর্বশেষ তিন দিনের রুদ্ধদ্বার সিরিজ বৈঠকে বিএনপির সিনিয়র, মধ্যম ও তরুণ নেতারা বলেছেন, আন্দোলন ছাড়া নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে না। নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনও গঠন হবে না। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি মিলবে না। জনগণের ভোটের অধিকারের ফয়সালা রাজপথেই করতে হবে। বিএনপির হাইকমান্ডও ডিসেম্বরের মধ্যে আন্দোলনে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, আন্দোলন ছাড়া কোনো দাবি আদায় করা সম্ভব হবে না। সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলনে নামতে হবে। তবে হাইকমান্ড এও হুঁশিয়ারি দেন, এবার দায়িত্বপ্রাপ্ত যেসব নেতা মাঠে থাকবেন না, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রাজপথে থাকা নেতাদেরই দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে ঠাঁই দেওয়া হবে। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম বলেন, আমাদের দাবি একটাই, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে কোনো ভোট হবে না। তাঁকে অবশ্যই ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচন দিতে হবে। দিনের ভোট রাতে করে ক্ষমতায় আসার সুযোগ আর দেওয়া হবে না। আগামীতে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায়ের জন্য আন্দোলনে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, আওয়ামী লীগের অধীনে পর পর দুটি সংসদ নির্বাচন, সব সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে, তাদের অধীনে সুষ্ঠু ভোট সম্ভব নয়। তাই বিএনপি নেতা-কর্মীরা মনে করেন, তাদের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদসহ কোনো নির্বাচনেই যাওয়া ঠিক হবে না।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিপক্ষে বিএনপির তৃণমূল: দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিপক্ষে মত দিয়েছেন বিএনপি নির্বাহী কমিটির বেশির ভাগ সদস্য ও জেলার সভাপতিরা। সেই সাথে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি নিশ্চিত করার কথা বলেন তারা। পাশাপাশি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে রাজপথে আন্দোলনের পক্ষেই মত দিয়েছেন এসব নেতা। তবে রাজপথে নামার আগে দলে শৃঙ্খলা ফেরানোর ওপরও জোর দিয়েছেন তারা। নেতারা বলেছেন যে, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ছাড়া বর্তমান সরকারকে হটানো সম্ভব নয়। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রতিটি ইউনিটে যাতে শৃঙ্খলা থাকে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। গতকাল বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সভাপতিদের সাথে বৈঠকে এসব আলোচনা উঠে আসে।
গত বুধবার বিকেল ৪টা থেকে রাত পর্যন্ত গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের অফিসে চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা বিভাগের বিএনপির নির্বাহী কমিটি সদস্য ও জেলার সভাপতিদের সাথে এই মতবিনিময় সভা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্কাইপির মাধ্যমে যুক্ত হয়ে মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। সভার শুরুর পর শোক প্রস্তাব উপস্থাপন করেন ময়মনসিংহ বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সাহলে প্রিন্স। গতকালের সভায় মোট ১২৯ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর পরিচালনায় উল্লিখিত বিভাগের ৮৫ জন নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলার সভাপতি মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন।
গত বুধবারের যারা উপস্থিত ছিলেন তারা হলেন আবদুল খালেক, আমিরুল ইসলাম খান আলিম, রফিক সিকদার, মঞ্জুরুল আহসান, জাহাঙ্গীর আলম, মমিনুল হক, এস এম কামাল উদ্দিন চৌধুরী, মোস্তফা খান সফরী, মাহবুব ইসলাম মাহবুব, কাজী রফিক, শেখ মো: শামীম, খন্দকার মারুফ হোসেন, একরামুল হক বিপ্লব, সাবেরা সাবু, আলাউদ্দিন হেনা, জিয়াউদ্দিন, সালাউদ্দিন ভূইয়া শিশির, জিল্লুর রহমান, সিরাজুল হক, রশিদুজ্জামান মিল্লাত, সুলতান মাহমুদ বাবু, মাহমুদুল হক রুবেল, ইকবাল হোসেন, ড. রফিকুল ইসলাম হিলালী, লায়লা বেগম, শামসুজ্জামান মেহেদী, আরিফা জেসমিন, রাবেয়া আলী, অধ্যাপক ডা: মো: আনোয়ারুল হক, মোতাহার হোসেন তালুকদার, মো: ইকবাল, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আরিফুল হক চৌধুরী, শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরী, আবুল কাহের শামীম, শাহ মোস্তফা, মজিবুর রহমান, হাসনা আক্তার সানু, গোলাম হায়দার, কাজী মফিজুর রহমান, ফোরকান-ই-আলম, সাচিং প্রু, জেরী, মামুনুর রশিদ মামুন, হুম্মাম কাদের, ডা: মাজহারুল ইসলাম, সুশীল বড়–য়া, বজলুুল করিম চৌধুরী আবেদ, মশিউর রহমান, ডা: শাহাদাত হোসেন, শাহ আলম, আবু সুফিয়ান, ম্যা ম্যা চিং, মাহফুজল্লাহ ফরিদ, জেড মর্তুজা চৌধুরী তুলা, এ জেড এম রেজওয়ানুল হক, আখতারুজ্জামান মিয়া, বিলকিস ইসলাম, সাইফুর রহমান রানা, আমিনুল ইসলাম, মির্জা ফয়সাল, ফরহাদ হোসেন আজাদ, হাসান রাজীব প্রধান, জহিরুল বাচ্চু, মো: শামসুজ্জামান সাবু, গফুর সরকার প্রমুখ। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার, বিএনপির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক রিয়াজুদ্দিন নসু, সহদফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু, মুনির হোসেন, বেলাল আহমেদ।