যুগে যুগে গল্প, ছড়া আর কবিতায় ঠাঁই পেয়েছে তালগাছ। বাতাসে হেলান দিয়ে কারিগর পাখি বাবুই তালগাছে বুনে যায় বাসা। কালক্রমে প্রায় হারাতে বসা সে তালগাছ এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাত নিরোধে সহায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজশাহী অঞ্চলে প্রথমে তালগাছ ফেরানোর উদ্যোগ নেয় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। প্রতিষ্ঠার তিন যুগে প্রতি বছরই তালগাছ রোপণ করেছে বিশেষায়িত সংস্থাটি। স¤প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ কর্মসূচির অংশ হিসেবেও বরেন্দ্র এলাকায় রোপণ করা হয় তালবীজ। এক কথায় বরেন্দ্র অঞ্চলে ফিরে এসেছে ঐতিহ্যের তালগাছ। বিএমডিএ সূত্র জানাচ্ছে, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বরেন্দ্র অঞ্চলে ব্যাপক হারে তালবীজ রোপণ শুরু করে বিএমডিএ। ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪০ লাখ তালবীজ রোপণ করেছে সংস্থাটি। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা। পরিবেশ সুরক্ষা ছাড়া বজ্রপাত নিরোধ ছিল এ উদ্যোগের অন্যতম উদ্দেশ্য। বরেন্দ্র অঞ্চলের রাস্তা ও খালের ধারে, সরকারি পুকুর এমনকি পতিত জমিতে যে সারি সারি তালগাছ দৃশ্যমান তা ওই সময় রোপণ করা। এসব তালগাছের কোথাও কোথাও ফল আসতে শুরু করেছে। এসব এলাকার বাসিন্দারা তালগাছ থেকে পাচ্ছে নানা সুবিধাও। সর্বশেষ বিশেষ কর্মসূচির আওতায় রোপণ করা হয়েছে আরো ২০ লাখ তালবীজ। তা থেকে ১২ লাখের বেশি চারা পাওয়া গেছে। এ কর্মসূচিতে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৯০ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।
পেশায় কৃষক বরেন্দ্রখ্যাত রাজশাহীর তানোর পৌর এলাকার বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম। তানোর-মু-ুমালা সড়ক ধরে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। পৌর এলাকায় প্রবেশের আগেই রাস্তার দুই ধারে তালগাছের সারি। সেখানেই কথা হয় আমিরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ২০ বছর আগেও রাস্তার দুই ধার বৃক্ষশূন্য ছিল। ক্ষেতের কাজে গিয়ে কৃষক-শ্রমিক প্রখর রোদে পুড়তেন। একটা সময় তালগাছ লাগানো শুরু করে বিএমডিএ। এখন এসব তালগাছে তাল ধরছে। লোকজন ছায়া ও জ্বালানি দুই পাচ্ছে। কচি তালের শ্বাস আর পাকা তালের পিঠাও পাওয়া যাচ্ছে।
একই ভাষ্য তানোরের বিলকুমারী পাড়ের গুবিরপাড়ার বাসিন্দা হাবিবুর রহমানের। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই বিলপাড়ের রাস্তাটি ভেঙে যচ্ছিল। কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছিল না। সাত-আট বছর আগে বিএমডিএ রাস্তার পাশে তালবীজ রোপণ করে। এরপর থেকে রাস্তা আর ভাঙেনি। তালগাছের কোনো কিছুই ফেলনা নয় বলে জানিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন খান। তিনি বলেন, তালপাতা থেকে পাখা, বাঁশি, খেলনা, ঝুড়ি, মাদুর ছাড়াও ঘরের ছাউনি তৈরি হয়। ডালের আঁশ দিয়ে রশি, ব্রাশ, ফুলের টপ, বাজারের থলে ও টুপিসহ নানাবিধ জিনিস তৈরি হয়। অপেক্ষাকৃত শক্ত, মজবুত ও টেকসই তালকাঠ ঘরের খুঁটি, আসবাবপত্র, বিভিন্ন গৃহস্থালি সামগ্রী, শৌখিন দ্রব্য ও নৌকা তৈরিতে অনন্য। গ্রামগঞ্জে টিনের বা সেমিপাকা বাড়ি তৈরিতে দীর্ঘস্থায়ী তালকাঠ অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে তালগাছের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি বলে জানিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চন্দন রায়। তিনি বলেন, তালগাছ বাবুই পাখিসহ জীবজন্তু ও কীটপতঙ্গের আশ্রয়স্থলসহ খাদ্যের অন্যতম উৎস। তালগাছ উজাড় হওয়ায় আশ্রয় হারিয়েছে বাবুই পাখি। অত্যধিক লম্বা এবং পাতার অগ্রভাগ সূচালো হওয়ায় বজ্রপাত নিরোধক হিসেবেও খুবই কার্যকরী তালগাছ। এছাড়া বায়ুপ্রবাহের গতি নিয়ন্ত্রণ, ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস রোধ এবং ভূগর্ভস্থ পানির মজুদ বৃদ্ধি ও মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়ায় পরিবেশবান্ধব তালগাছ। ‘বরেন্দ্র এলাকায় তালবীজ রোপণ কর্মসূচি’ বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিলেন বিএমডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী তরিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে খরাপ্রবণ উত্তরাঞ্চলে ব্যাপকহারে তালগাছ রোপণ করা হয়। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে এ কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২০ সালের জুন র্পযন্ত এ কর্মসূচির আওতায় রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জয়পুরহাট, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৮১টি উপজেলায় ১৬ লাখ তালবীজ রোপণ করা হয়েছে। কর্মসূচির প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ২ কোটি ২০ লাখ টাকা। কর্মসূচি বাস্তবায়নের পর উদ্বৃত্ত ৩০ লাখ টাকা ফেরত গেছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে।
কর্মসূচি পরিচালক বলেন, তালবীজ রোপণে লটারির মাধ্যমে ঠিকাদার নির্বাচন করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল বিএমডিএর একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি। এছাড়া গাছ গণনা হয়েছে রিজিওনের তত্ত্বাবধানে। বিভিন্ন উপজেলার কমিটি গণনা শেষে প্রতিবেদন দেয়ার পর বিল পেয়েছেন ঠিকাদার। শর্ত ছিল রোপণ করা চারার ৫০ শতাংশ গাছ না পেলে বিল পাবেন না ঠিকাদার। সে হিসাবে ৮১ জন ঠিকাদারের মধ্যে বিল পাননি ১৩ জন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশীদ বলনে, মূলত তালবীজের অঙ্কুরোদগম বিলম্বে হয়। দীর্ঘদিন পরও এর চারা গজাতে পারে। কিন্তু আমাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের সময়সীমা বাঁধা থাকায় আমরা দ্রুত গণনা শেষ করেছি। সরেজমিনে গিয়ে যতগুলো গাছ পাওয়া গেছে, কেবল তার বিপরীতে বিল পেয়েছেন ঠিকাদার। যাদের ১০ হাজারের নিচে গাছ পাওয়া গেছে, তারা বিল পাননি।