আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন
মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদন তৈরি করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে এ সময়কালের মধ্যে সারা দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা, বিশেষত ধর্ষণ, হত্যা, যৌন নিপীড়ন ও পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা ও ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি ২০২১-সেপ্টেম্বর ২০২১) মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত ঘটনা পর্যালোচনা করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দেশে এক সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন এবং ১৫৪ সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হামলা-মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) তাদের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে। প্রতিবেদনে নারী শিশু নির্যাতন, সীমান্ত সংঘাত, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন পরিস্থিতি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, ক্রসফায়ার, গুলিবিনিময় বা বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। ১০টি জাতীয় দৈনিক ও বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত সংবাদ ও আসক-এর নিজস্ব সূত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
সাংবাদিক নির্যাতন: আসক-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, নয় মাসে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একজন সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। ১৫৪ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হামলা-মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। নির্যাতিত সাংবাদিকদের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আট জন, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের হাতে ১৪ জন, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৩ জন, হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালে ১৩ জন সাংবাদিক আহত হন। এছাড়া ১০৬ জন সাংবাদিক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, স্থানীয় প্রভাবশালী মহল ও সন্ত্রাসীদের দ্বারা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ও হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ: গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর (২০২১) পর্যন্ত নয় মাসে প্রধান প্রধান জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে দেখা গেছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে এবং ‘ক্রসফায়ারে’ মোট ৪৮ জন মারা গেছেন। এরমধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সংগে কথিত ‘ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, গুলিবিনিময় বা এনকাউন্টারে’ নিহত হয়েছেন ৩৪ জন, বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে ৯ জন ও নির্যাতনে চার জন মারা গেছেন। এছাড়া গ্রেফতারের পরে হার্ট অ্যাটাকে (পুলিশের ভাষ্যমতে) এক জনের মৃত্যু হয়।
কারা হেফাজতে মৃত্যু: এবছরের নয় মাসে কারাগারে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মারা যান ৬৭ জন। এর মধ্যে কয়েদি ২৫ জন এবং হাজতি ৪২ জন। দেশের জাতীয় দৈনিকসমূহে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে জানা যায়, গত নয় মাসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ বা গুমের শিকার হন ছয় জন। এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে তিন জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং নিখোঁজ রয়েছেন আরও ৩ জন।
নারীর প্রতি সহিংসতা: এবছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও সহিংসতা, ধর্ষণ ও হত্যা, পারিবারিক নির্যাতন, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপসহ নারী নির্যাতনের ঘটনা গত বছরের (২০২০) নয় মাসের তুলনায় বেড়েছে বলে জানানো হয় আসক-এর প্রতিবেদনে। এই নয় মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১০৮৫ নারী, যার মধ্যে একক ধর্ষণের শিকার হন ৮৭৯ জন এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ২০৩ নারী। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হন ৩৯ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ৮ নারী। এছাড়া ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ২৫৬টি। উল্লেখ্য, গত বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে মোট ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ৯৭৫ নারী।
যৌন হয়রানি ও সহিংসতা: প্রতিবেদনে বলা হয়, এই নয় মাসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১০১ নারী, এর মধ্যে ১০ নারী আত্মহত্যা করেছেন এবং হত্যার শিকার হয়েছেন ৩ নারী। এছাড়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন ৭১ জন পুরুষ, যার মধ্যে ৪ জন পুরুষ খুন হয়েছেন।
পারিবারিক নির্যাতন ও হত্যা: এই নয় মাসে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫২৭ নারী। যাদের মধ্যে স্বামী, স্বামীর পরিবার এবং নিজ পরিবার কর্তৃক হত্যার শিকার হন ৩০৩ নারী এবং পারিবারিক নির্যাতনের ফলে আত্মহত্যা করেছেন ১১৮ নারী। উল্লেখ, গত বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৪৩২ নারী।
যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতন ও হত্যা: যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছেন মোট ১৮২ নারী। যৌতুকের জন্য নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ৬০ জনকে এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন নারী। এরমধ্যে যৌতুকের কারণে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৯৮ জন।
গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যা: এই সময়ের মধ্যে ৩৮ জন গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যার শিকার হন। যাদের মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছেন ১২ জন এবং ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৬ গৃহকর্মী।
শিশু নির্যাতন ও হত্যা: শিশুর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন সংক্রান্ত পরিসংখ্যানও উদ্বেগজনক। গত নয় মাসে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৬৩৬ শিশু। এরমধ্যে হত্যার শিকার হয় ৪৭১ জন এবং শারীরিক ও যৌন নির্যাতনসহ নানাভাবে সহিংসতার শিকার হয় ১ হাজার ১৬৫ শিশু। এই ১ হাজার ১৬৫ জনের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয় ৬৪৮ কন্যাশিশু এবং বলাৎকারের শিকার হয়েছে ৬৪ জন ছেলে শিশু। উল্লেখ্য, ২০২০ সালের এই সময়কালে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলো ১৫২৩ শিশু।
ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন: প্রতিবেদনের তথ্য মতে, এই নয় মাসে হিন্দু সম্প্রদায়ের ১০২টি বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিমা, মন্দির ও পারিবারিক পূজামন্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে ৭৮টি। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ৭ জন। জমি ও বাড়িঘর দখল এবং উচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে সাতটি। এছাড়া বৌদ্ধসম্প্রদায়ের পরিবার ও বাড়িঘরে হামলা হয়েছে একটি। উল্লেখ্য, ২০২০ সালের এই সময়কালে হিন্দু সম্প্রদায়ের সাতটি বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং ৪৮টি প্রতিমা, মন্দির ও পারিবারিক পূজামন্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
সীমান্ত সংঘাত: এই সময়কালে ভারত সীমান্তে মোট নিহত হয়েছেন ১১ জন। এর মধ্যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর গুলিতে ৯ জন, শারীরিক নির্যাতনে একজন এবং বিএসএফ-এর ধাওয়া খেয়ে পানিতে ডুবে একজন নিহত হয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন ছয় জন এবং অপহরণের শিকার হয়েছেন তিন জন।
রাজনৈতিক সংঘাত: গত নয়মাসে প্রধান প্রধান জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা গেছে, রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ৩২১টি। এতে নিহত হয়েছেন ৬৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৪ হাজার ৪০৫ জন। এর মধ্যে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সহিংসতা ও সংঘর্ষের ১৬৭টি ঘটনায় আহত হয়েছেন ১ হাজার ৯৪২ জন এবং নিহত হন ৩০ জন।