করোনাভাইরাস সংক্রমণ বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার কয়েক মাসের মধ্যেই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা খেয়াল করেন যে সংক্রমিতদের অনেকের জ্বর-কাশির মতো উপসর্গগুলো সেরে গেলেও তারা পুরোপুরি সুস্থ হতে পারছেন না। যেমন, সামিয়া সুলতানা চলতি বছরের মার্চ মাসে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও স্বাদ-গন্ধ চলে যাওয়ার উপসর্গগুলো ছিল তার। চিকিৎসকের পরামর্শে বাসায় আইসোলেশনে থেকে তিনি চিকিৎসা নিয়েছেন। তিন সপ্তাহ পর তিনি পেয়েছেন কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট। এরপর আট মাস পার হতে চলেছে। কিন্তু এখনো বেশ কিছু সমস্যায় ভুগছেন তিনি। তার মধ্যে অন্যতম -ভুলে যাওয়া। সামিয়া সুলতানা বলেন, এই সমস্যা আমার আগে ছিল না। কিন্তু কোভিডের পর দেখতে পাচ্ছি আমি মানুষের নাম চট করে মনে করতে পারছি না। হয়তো কিচেনে গিয়েছি পানি আনতে কিন্তু কিচেনে ঢুকে মনে করতে পারছি না কেন এসেছি। এই ভুলে যাওয়ার সমস্যা প্রকট হওয়ার কারণে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তিনি খাতায় লিখে টেবিলের উপর রাখছেন। তিনি বলেন, যেমন ধরেন ওষুধ খেতে হবে, হয়ত একবার খেয়েছি কিন্তু মনে করতে পারছি না খেয়েছি কিনা। এক্ষেত্রে যদি আবারো ওষুধ খেয়ে ফেলি তাহলে তো সেটা বিপদজনক। তাই লিখে সামনের টেবিলে রাখি।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য নির্দেশিকা অনুযায়ী, কেউ যদি করোনাভাইরাস সংক্রমণ – তা গুরুতর বা মৃদু যাই হোক না কেন- তার পর ১২ সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও যদি রোগীর দেহে এমন অসুস্থতার লক্ষণ রয়ে যায়, যার কারণ হিসেবে অন্য কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না, তখন ধরে নিতে হবে তার ‘লং কোভিড’ হয়েছে। ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবার তথ্য অনুযায়ী, এই লং কোভিডের অন্যতম একটা লক্ষণ- স্মৃতি শক্তি বা মনঃসংযোগের সমস্যা – যাকে বলা হয় ‘ব্রেন ফগ’ বা বোধশক্তি ঝাপসা হয়ে যাওয়া।
ব্রেন ফগ কী? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক বাহাদুর আলী মিয়া বিবিসিকে বলেন, করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হলে রোগীর শরীরে রক্ত জমাট বাঁধার একটা প্রবণতা থাকে। তিনি বলেন, রক্তে যখন অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায় তখন ব্রেনেও অক্সিজেনের সরবরাহ কমে যায়। এতে করে ব্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেডিকেল সায়েন্সে এটাকে বলে ‘হাইপ্রোসিক ইনজুরি’। অধ্যাপক বাহাদুর আলী মিয়া বলেন, ব্রেন স্ট্রোক হলে বা টিউমার হলে ব্রেনের একটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু যখন হাইপ্রোসিক ইনজুরি হয় তখন সমস্ত ব্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অবস্থাকে বলা হচ্ছে ‘ব্রেন ফগ’। ব্রেন ফগ হলে স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া, বিষণ্ণতা, আচরণের পরিবর্তন, হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে যাওয়া এসব লক্ষণগুলো দেখা যায় বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।
কী চিকিৎসা রয়েছে: জান্নাতুল ফেরদৌস একটা বেসরকারি ব্যাংকে কাজ করেন। তিনি বলেন, ছয় মাস আগে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। এখন অনেকটা সুস্থ কিন্তু তার ভাষায় ‘ভুলে যাওয়ার সমস্যায় জর্জরিত’ তিনি। জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘আমি ব্যাংকে কাজ করি। হিসেব-নিকেশ মেলাতে বড় ধরনের সমস্যা হয়ে যাচ্ছিল। আমি অনেক কিছুই মনে রাখতে পারছি না। আমি এখন চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাচ্ছি।’ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া বা ব্রেন ফগ নিয়ে এখনো বিস্তর গবেষণা চলছে। তাই কোনো গাইডলাইন এখনো তৈরি হয়নি এই রোগের চিকিৎসার জন্য।
অধ্যাপক বাহাদুর আলী মিয়া বলেন, এই ক্ষেত্রে অবশ্যই নিউরোলজি বা স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। এক্ষেত্রে চিকিৎসক তাকে কিছু ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেবেন। সঙ্গে সঙ্গে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া ,ব্যায়াম করা, মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা বাড়িয়ে দিতে হবে। এছাড়া কাউন্সেলিং এবং চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ব্রেন ফ্রগ বিষয়টা নির্ভর করে কার মস্তিষ্ক কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার উপর। সেরে ওঠাটাও তার উপরই নির্ভর করে। সূত্র : বিবিসি