প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর গোয়েন্দা সংস্থার প্রকাশিত ‘গোপন দলিল’ বাংলাদেশের রাজনীতি ও ইতিহাস গবেষকদের জন্য হবে অমূল্য সম্পদ। তিনি বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন থেকে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ ও সংগ্রাম সম্পর্কে প্রকৃত এবং সম্পূর্ণ ইতিহাস এই গোপন দলিলে পাওয়া যাবে। এর মাধ্যমে বিশ্বের জনগণও বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে জানতে পারবে।’
লন্ডনের ক্লারিজ হোটেলে গতকাল ৫ নভেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন দলিলের আন্তর্জাতিক প্রকাশনার উদ্ধোধন অনুষ্ঠানে তিনি এই মন্তব্য করেন। শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই প্রকাশনা থেকে দেশের রাজনৈতিক নেতা ও নতুন প্রজন্ম শিক্ষা নিতে পারবে। তিনি বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর এসব গোপন দলিল ও রেকর্ড তাদের সংগ্রহে রেখেছিল।
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাসে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি মুহূর্তের গতিবিধি ও কর্মকান্ড অনুসরণ করতো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর জীবনের ৩ হাজার ৫৩ দিন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে। শেখ হাসিনা বলেন, শুধু বঙ্গবন্ধুই নয়, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা যাদের প্রতি গোয়েন্দা নজরদারি করতো তাদের সবাইকে এমনকি তাঁর মা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবকেও সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখতো। তিনি আরো বলেন, ‘বিশেষ করে ১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণার পর থেকে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকতেন।’ শেখ হাসিনা বলেন, এসব গোপন দলিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সংগ্রামের শুধু রেকর্ডই নয় বরং এগুলো কীভাবে একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হলো তারও ঐতিহাসিক দলিল। তিনি আরো বলেন, এসব গোপন দলিল বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের জন্য খুবই গুরুত¦পূর্ণ। শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস কীভাবে তৈরি হলো তা এইসব গোপন দলিলে প্রদর্শিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, এসব নথিতে জাতির পিতার অপরিসীম দুর্ভোগ ও ত্যাগের চিত্র রয়েছে। তিনি বলেন, এই নথিগুলো একজন জাতীয় নেতা, একজন রাষ্ট্রনায়ক এবং একজন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তৈরির বিবরণ। সরকার প্রধান বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম দিন থেকেই যে নীতি ও মূল্যবোধের পক্ষে থাকায় বিরোধীরা তাকে টার্গেট করেছিল। একই বাহিনী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কাল রাতে তাঁর পরিবারের বেশীরভাগ সদস্যসহ তাঁর জীবনের নির্মম পরিণতির জন্য দায়ী। শেখ হাসিনা এই প্রকাশনার জন্য বাংলাদেশের হাক্কানি পাবলিশার্সের সাথে অংশীদারিত্বে এগিয়ে আসার জন্য টেলর অ্যান্ড ফ্রান্সিস গ্রুপকে ধন্যবাদ জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে তাঁর সংগ্রামের প্রতি সুবিচার করার অঙ্গীকার নবায়ন করছি। শেখ হাসিনা ‘বঙ্গবন্ধু অ্যান্ড ব্রিটেন : এ সেন্টেনারি কালেকশন’ শীর্ষক একটি শিল্প প্রদর্শনীরও উদ্বোধন করেন।
বিনিয়োগকারীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগকারীদের বেশ কয়েকটি লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘… জ্বালানি, নবায়নযোগ্য শক্তি, জাহাজ নির্মাণ, অটোমোবাইল, হালকা প্রকৌশল, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, সমুদ্র অর্থনীতি, পর্যটন, জ্ঞান ভিত্তিক হাই-টেক শিল্প, আইসিটি খাত বিদেশী বিনিয়োগের অপেক্ষায় রয়েছে, ব্রিটিশ বিনিয়োগকারীরা এর মধ্যে যে কোনও একটি এবং এর বাইরেও বেছে নিতে পারেন’। শেখ হাসিনা ব্রিটিশ বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে অংশীদারিত্বে বাংলাদেশে আসার জন্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আপনারা সব সুযোগ পাবেন, আর কোনো বাধা থাকলে আমি তা দেখব। প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে কুইন এলিজাবেথ সেন্টারের চার্চিল হলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলন ২০২১: টেকসই প্রবৃদ্ধি অংশীদারিত্ব তৈরি ও রোড শো’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি তার বাসস্থান থেকে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এছাড়াও, প্রিন্স চার্লস এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের একটি পূর্বে রেকর্ডকৃত ভিডিও বার্তা অনুষ্ঠানে প্রচার করা হয়। ব্রিটিশ বাণিজ্য নীতি প্রতিমন্ত্রী পেনি মর্ডান্টও এই কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন। শেখ হাসিনা একক অর্থনৈতিক অঞ্চলেরও প্রস্তাব প্রদান করেন যেখানে একটি নির্দিষ্ট দেশের কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করতে পারবে। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগকারীরা এই ধরনের একটি অঞ্চল নিজেদের জন্য নিতে পারেন।
প্রায় ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ২৮টি হাই-টেক পার্ক বিদেশী ও দেশীয় বিনিয়োগের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, জনসংখ্যার সুফল এবং বিনিয়োগকারীরা যাতে প্রতিয়োগিতামূলক দামে দক্ষ মানবসম্পদ পায় তা নিশ্চিতের উপর তাদের দৃষ্টি রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই যে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটিসহ আমাদের সরকারি সংস্থাগুলো আপনাদের জন্য একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবসায়িক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। তিনি বলেন, তাঁর সরকার ব্রিটিশ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম সম্ভাব্য সুফলের জন্য যথেষ্ট সুযোগ দিবেন।
বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি প্রধান ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সফলভাবে কাজ করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, আমি এইভাবে আরও কোম্পানিকে স্বাগত জানাতে চাই যাতে তারা এগিয়ে আসে এবং বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে।” তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে নতুন জাতির জন্মের পর থেকে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্য সর্বোত্তম সম্পর্ক উপভোগ করছে এবং প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাজ্য যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে উদার হাত বাড়িয়ে দেয়ার জন্য একটি নেতৃস্থানীয় দেশ ছিল। আর এইভাবে আজ যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য এবং বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারী। তিনি বলেন, এরপর থেকে এই সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলন দুই দেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ককে আরও ফলপ্রসূ করে তুলবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অবশ্যই এই রোড শো ব্যবসা এবং বিনিয়োগ থেকে উচ্চ সুফলের পুরষ্কারসহ বাংলাদেশের সম্ভাবনা প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রেরণা জোগাবে। বাংলাদেশ আজ একটি পরিবর্তিত দেশ উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত এক দশকে আর্থ-সামাজিক খাতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নে সরকারের প্রচেষ্টার কারণে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে ‘ভিশন ২০৪১’ পূরণ করে একটি উন্নত দেশ হতে এগিয়ে যাওয়া এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্য ঘোষণা করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এডিবি আউটলুক ২০১৯ অনুযায়ী এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশ সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি। তিনি বলেন, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সুশাসন, স্থিতিশীল সরকার, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুষ্ঠ সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি এবং সঠিক উন্নয়ন অগ্রাধিকারের সুবাদে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে এডিবি উল্লেখ করেছে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ পিপিপির ভিত্তিতে বিশ্বের ৩১তম বৃহত্তম অর্থনীতি।
শেখ হাসিনা বলেন, দ্রুত নগরায়ন, ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের ব্যবহার, মধ্যবিত্ত ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ স¤প্রতি বিনিয়োগের একটি আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে; যোগাযোগ সংযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় এটি দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশাল বাজারে পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, “আমরা জ্বালানি ও বিদ্যুৎ এবং রেল যোগাযোগসহ অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করছি।” এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার নিজস্ব অর্থায়নে উপেক্ষিত দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের সংযোগ স্থাপনকারী রেলপথ বিশিষ্ট পদ্মাসেতু নির্মাণ করছে।“বাংলাদেশ খুব শিগগিরই মেট্রো-রেল যুগে প্রবেশ করছে।”
তিনি বলেন, শিল্পের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বৃদ্ধি এবং সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য বিদ্যুতের উৎপাদন ইতোমধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ এই উৎপাদন লক্ষমাত্রা ৪০ হাজার মেগাওয়াট, ২০৪১ সাল নাগাদ ৬০ হাজার মেগাওয়াট নির্ধারণ করা হয়েছে।
“আমরা ক্রমাগত আমাদের আইনি এবং অবকাঠামো উন্নয়ন করছি। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে উদার বিনিয়োগ ব্যবস্থা রয়েছে এবং বিদেশী বিনিয়োগ সংসদের আইন এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তির দ্বারা সুরক্ষিত।” তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের আইসিটি খাত এখন দ্রুত বিকাশ লাভ করছে, ৬০টি দেশে এক বিলিয়ন ডলারের আইসিটি পণ্য রফতানি করছে, এটি ৫ গুণ বেড়ে ২০২৫ সাল নাগাদ ৫ বিলিয়ন ডলার দাঁড়াবে। ফ্রিলান্স আইটি প্রফেশনালদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৬ লাখ। আইটি খাতে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ সঠিক জায়গা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আরএমজি রফতানিকারক দেশ, সবজি উৎপাদনকারী হিসাবে তৃতীয় অবস্থানে, অভ্যন্তরীণ মৎস উৎপাদনে তৃতীয়, ইন্টারনেট ফ্রিলান্সিংয়ে তৃতীয় এবং ধান উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।