ঢাকার ধামরাই উপজেলার শরীফবাগ গ্রামে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের নেয়া (বিএলআরআই) বিভিন্ন কর্মসূচি খামার ব্যবসায় আগ্রহী করে তুলছে কৃষকদের। দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, খাদ্য ও পুষ্টি ঘাটতি পূরণ, আয় বৃদ্ধি, প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং নারীর ক্ষমতায়ন সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিএলআরআই ঢাকা জেলার ধামরাই উপজেলার শরীফবাগ গ্রামটিকে ঘিরে একটি ‘বিএলআরআই প্রযুক্তি পল্লী’ গড়ে তোলে। বিএলআরআই উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলো হাতেকলমে ব্যবহারের মাধ্যমে খামারিদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য গ্রামটিকে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রযুক্তি পল্লী গঠন করা হয়। সরেজমিনে শরীফবাগ গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রযুক্তি পল্লীটিতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, গবাদিপশু ও খামারের মুরগি রোগমুক্ত রাখতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মাঠকর্মীরা গবাদিপশুর পিপিআর, খুরারোগ ও ল্যাম্পি স্কিন রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ, কৃমিমুক্তকরণ, রানীক্ষেত, কলেরা ইত্যাদি নিয়ে খামারিদের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি নিয়মিতভাবে গবাদিপশুর কৃমিনাশক টিকা ও ভিটামিন প্রদান করেন। ফলে গ্রামটিতে গবাদিপশুর রোগবালাই অনেক কমে গেছে। খামারিরা আগের চেয়ে অনেক বেশি লাভবান হচ্ছেন। তারা গবাদিপশু পালন ও পোলট্রি খামার গড়তে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
প্রযুক্তি পল্লী এলাকায় বেবী আখতার নামে এক পোলট্রি খামারির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাত্র ১০টি উন্নত জাতের মুরগি নিয়ে তিনি যাত্রা করেছিলেন। তিনি এখন পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা মিটিয়ে মাসে প্রায় ২ হাজার ৫০০ টাকার ডিম বিক্রি করতে সক্ষম হচ্ছেন। বেবী আখতারের মতোই এ গ্রামে রয়েছেন আরো অনেক সফল মুরগি খামারি। যারা উন্নত জাতের মুরগি পালন করে বছরে ১৭০-১৮০টি ডিম পাচ্ছেন। খামারের প্রতিটি মুরগির ওজন তিন কেজি পর্যন্ত হয়। যেখানে সাধারণ দেশী মুরগি বছরে ৪০-৫০টির বেশি ডিম দেয় না।
প্রচলিত মুরগির তুলনায় অধিকসংখ্যক ডিম পাওয়ায় প্রযুক্তি পল্লীসহ পাশের গ্রামগুলোয় এর চাহিদা বেড়েছে। এ বাড়তি চাহিদার জোগান দিতে প্রযুক্তি পল্লীর আলমগীর হোসেন নামের একজন খামারি প্রায় এক হাজারটি দেশী জাতের মুরগির প্যারেন্ট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন। গ্রামীণ এলাকায় হাঁস পালন কার্যক্রম যে একটি লাভজনক ব্যবসা, তা প্রযুক্তি পল্লীর খামারিদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে অনেকেই হাঁস পালনে উৎসাহী হয়ে বিএলআরআই উদ্ভাবিত উন্নত জাতের রুপালি ও নাগেশ্বরী হাঁস পালনে এগিয়ে আসছেন। এ প্রকল্প থেকে কয়েকজন খামারিকে দেশীয় উন্নত জাতের ভেড়া ও ছাগল প্রদান করা হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রযুক্তি পল্লীতে গরু মোটাতাজাকরণ পদ্ধতিও সাড়া ফেলেছে।
গ্রামীণ নারীদের ক্ষমতায়ন ও আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে এ প্রকল্পের মাধ্যমে সেলাই প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে। প্রকল্প থেকে নেয়া পদক্ষেপ গুলো হলোÍছয়জন খামারিকে ১৭টি ছাগল ও ভেড়া, তিনজন খামারিকে উন্নত জাতের ঘাসের কাটিং, ২৫ জন খামারিকে ১০টি করে দেশী মুরগি, ৩০১ জন খামারিকে হাঁস ও মুরগির টিকা প্রদান করা হয়েছে। প্রযুক্তি পল্লী নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী জানতে চাইলে প্রকল্পের প্রধান গবেষক ড. রেজিয়া খাতুন বলেন, বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে লাগসই প্রযুক্তি এবং উন্নতজাতের প্রাণি ও পোলট্রির জার্মপ্লাজম এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ২০২১ সালের মধ্যে আমরা যদি প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ করতে চাই, তবে আমাদের নিজস্ব উৎপাদন ছয়-নয় ভাগ বাড়াতে হবে। এ চাহিদা সামনে রেখে বিএলআরআই বিভিন্ন লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছে এবং উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলো খামারি ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে জনপ্রিয়করণ এবং হাতেকলমে ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করা। এর মাধ্যমে উন্নতজাতের জার্মপ্লাজম সরবরাহ বিএলআরআই প্রযুক্তি পল্লী গঠনের মূল উদ্দেশ্য। বিএলআরআই মহাপরিচালক ড. মো. আব্দুল জলিল বলেন, বর্তমানে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, দরকার এখন প্রাণিজ আমিষে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। এ লক্ষ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে বিএলআরআই প্রাণিসম্পদ সম্পর্কিত নানাবিধ লাগসই প্রযুক্তিগুলোর সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে খামারি ও উদ্যোক্তারা নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটাতে পারবেন।