শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ১২:০৯ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
বগুড়া শেরপুরে আগুনে পুড়লো পঁচিশ বিঘা জমির ভুট্টা ইসলামাবাদে ভোট কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগে মানববন্ধন বীর মুক্তিযোদ্ধার নির্মাণাধীন দোকানে সন্ত্রাসী হামলা বাগেরহাট নানান আয়োজনে মে দিবস পালিত ভালুকা বিশেষায়িত পেঁয়াজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ কেন্দ্র উদ্বোধন বরিশালে জাতীয়তাবাদী শ্রমিকদলের ৪৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন কুড়িগ্রামের উলিপুরে ভুট্টা মাড়াইয়ে ব্যস্ত কৃষকেরা, দ্বিগুণ লাভের আশা নগরকান্দায় অগ্নিকান্ডে চারটি দোকান ঘর ভস্মীভূত দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি না হলে গণতন্ত্রের মুক্তি হবে না-কেন্দ্রীয় বিএনপি যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সরোয়ার গলাচিপায় পুষ্টি সমন্বয় কমিটির সভা ও জাতীয় স্বাস্থ্য ও কল্যাণ দিবস পালিত

ভাঙছে পদ্মা: নড়িয়া উপজেলার আটটি গ্রাম পদ্মায় বিলীন

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বুধবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২১

নড়িয়া উপজেলায় নদী-তীরবর্তী এলাকার প্রায় সব খানেই এখন ভাঙনের ছাপ। শুধু ২০১৮ সালের ভাঙনেই উপজেলার আটটি গ্রাম পদ্মায় বিলীন হয়েছে। ২০১৮ সালের ভাঙনেই উপজেলার আটটি গ্রাম পদ্মায় বিলীন হয়েছে। একসময় পদ্মা সেতুর উজান এলাকায় ভাঙনের প্রবণতা ছিল বেশি। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৫-২০০০ সালে এখানে ৩ হাজার ৮১৪ মিটার এলাকা ভাঙনের শিকার হয়েছিল। ২০০০-০৫ সালে তা আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৭৩০ মিটারে। এরপর ২০০৫-১০ সালের মধ্যে তা নেমে এসেছিল শূন্যে। ২০১০-১৫ সালে পদ্মা সেতুর উজান এলাকায় নদী ভেঙেছিল ৩১১ মিটার। গত পাঁচ বছরে উজানে নদীভাঙন হয়েছে ১ হাজার ৯৯৫ মিটার। গত বছর জুলাইয়ের শেষ ভাগে ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পড়ে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড। কয়েকদিনের ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় সেতুর সড়কপথের জন্য তৈরি করা শতাধিক স্ল্যাব, প্রায় ২০০ রেল গার্ডারসহ গুরুত্বপূর্ণ মালামাল। কয়েকশ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। পদ্মা সেতুর কাজ যখন পরিকল্পনা পর্যায়ে, তখনই পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনে ‘সেতুর কাজ চলাকালে’ সম্ভাব্য কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে ভাঙনের ঝুঁকির কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রতিবেদনে ইয়ার্ডের সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু কাজ শুরুর পর মাওয়া প্রান্তে নদী শাসনে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ, যার বিরূপ প্রভাবে ভাঙনের মুখে বিলীন হতে বসেছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড। পদ্মা সেতুর সুরক্ষার জন্য মাওয়া প্রান্তে ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার আর জাজিরা প্রান্তে ১২ দশমিক ৪ কিলোমিটার এলাকায় নদী শাসন করা হচ্ছে। ২০২২ সালে পদ্মার মূল প্রবাহ জাজিরার দিকে সরে যাওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে। এ কারণেই সেতুর মাওয়া প্রান্তের চেয়ে জাজিরার প্রান্তের দিকে নদী শাসনের পরিমাণ বেশি রাখার কথা বলছেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণে যতটা গুরুত্ব দিচ্ছে, নদী রক্ষায় ততটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। নদী শাসনের ঘাটতির কারণেই পদ্মা সেতুর উজান-ভাটি অঞ্চলে বাড়ছে নদীভাঙন।
দেশের ভাঙনপ্রবণ এলাকাগুলোর অন্যতম শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা। গত কয়েক বছরের ভয়াবহ ভাঙন উপজেলাটির অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলেছে। স্থানীয়দের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে অদূরভবিষ্যতে গোটা নড়িয়া উপজেলাই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে পড়বে। নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, এ এলাকায় পদ্মায় সবচেয়ে বেশি ভাঙন হয়েছে গত পাঁচ বছরে।
নড়িয়া উপজেলায় নদী-তীরবর্তী এলাকার প্রায় সব খানেই এখন ভাঙনের ছাপ। শুধু ২০১৮ সালের ভাঙনেই উপজেলার আটটি গ্রাম পদ্মায় বিলীন হয়েছে। সরেজমিন ঘুরে সেতুর ভাটি অঞ্চলে নড়িয়া ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত ভাঙনকবলিত এলাকার দেখা মিলেছে। পদ্মার মুন্সীগঞ্জ প্রান্তের চেয়ে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর প্রান্তে এখন ভাঙনপ্রবণতা বেশি। নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের টেকনিক্যাল জার্নালে স¤প্রতি এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। স্যাটেলাইট ছবির মাধ্যমে গত চার দশকের তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এতে বলা হয়েছে, নড়িয়াসহ পদ্মা সেতুর ভাটি অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ভাঙন হয়েছে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সময়কালে। এ সময়ে উপজেলাটিসহ সেতুর ভাটি অঞ্চলে নদীভাঙন হয়েছে ২ হাজার ৮২৩ মিটার। এর আগে ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলে নদীভাঙন হয়েছিল ১ হাজার ৩৯ মিটার। ২০০০-০৫ সময়কালে নদীভাঙনের শিকার এলাকার আয়তন ছিল ১ হাজার ১১৭ মিটার। ২০০৫-১০ সালের মধ্যে ভেঙেছে ১ হাজার ৫২৫ মিটার এলাকা। ২০১০-১৫ সময়কালে সেতুর ভাটিতে ভাঙনের শিকার হয় আরো ১ হাজার ৭১২ মিটার।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) তিন বিশেষজ্ঞ এ গবেষণা কার্যক্রম চালান। ‘অ্যাসেসিং রিভারব্যাংক ইরোশন অ্যাট আপস্ট্রিম অ্যান্ড ডাউনস্ট্রিম সাইড অব পদ্মা ব্রিজ বাই ইউজিং স্যাটেলাইট ইমেজেস’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গত পাঁচ বছরে পদ্মা সেতুর ভাটি অঞ্চলে ভাঙনের পরিমাণ বেড়েছে আগের পাঁচ বছরের তুলনায় ১ হাজার ১০০ মিটারেরও বেশি। একই পরিস্থিতি সেতুর উজানেও। আগের পাঁচ বছরের চেয়ে গত পাঁচ বছরে উজানে ভাঙনের শিকার এলাকার আয়তন বেড়েছে দেড় হাজার মিটারেরও বেশি।
পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের নভেম্বরে। সেতুটি নির্মাণের আগে করা বিভিন্ন সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নসহ (ইআইএ) বিভিন্ন প্রতিবেদনে নির্মাণকালে ও নির্মাণ-পরবর্তী সময়ে নদী ভাঙনপ্রবণতা কেমন হবে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব প্রতিবেদনে ভাঙন রোধে সম্ভাব্য পদক্ষেপ-সংক্রান্ত সুপারিশ ও দিকনির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সেতু নির্মাণের আগে সুপারিশকৃত এসব পদক্ষেপ ও দিকনির্দেশনার যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবেই পদ্মার ভাটি এলাকায় ভাঙনপ্রবণতা বাড়ছে। এ ভাঙন পর্যবেক্ষণের জন্য এরই মধ্যে একটি কমিটি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান অধ্যাপক শামীজ জেড বসুনিয়া। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু এলাকায় এবং দুই পাশে উজান-ভাটিতে নদীভাঙনের গতিপ্রকৃতি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য সেতু কর্তৃপক্ষ একটি কমিটি করে দিয়েছে। পদ্মার কোন এলাকায় কখন ভাঙন হচ্ছে তা পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুপারিশ করছে এই কমিটি। এ বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে একজন নদী বিশেষজ্ঞ বলেন, নদীতে যেকোনো ধরনের অবকাঠামোই পানিপ্রবাহের স্বাভাবিক গতিধারাকে বিঘিœত করে। বিষয়টি অস্বাভাবিক নয়। এজন্য নদীতে কোনো বড় অবকাঠামো তৈরি করতে হলে নদী তীর সংরক্ষণসহ নদী শাসনকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হয়। পদ্মা সেতুর নদী শাসন কাজটি আরো গুরুত্বের সঙ্গে ও বৃহৎ পরিসরে করা উচিত ছিল। তবে যথাযথ তথ্য-উপাত্ত ও সমীক্ষার ভিত্তিতেই পদ্মা সেতুর নদী শাসন এলাকা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য অধ্যাপক আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর আগে আমরা নদীভাঙন নিয়ে যত ধরনের তথ্য পেয়েছি সংগ্রহ করেছি। সেগুলোর আলোকে নদী শাসন এলাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এবং সেই অনুযায়ী আমরা নদী শাসন কাজ এগিয়ে নিচ্ছি। নদী তার স্বাভাবিক নিয়মেই ভাঙছে।
পদ্মা সেতু নিয়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার সময়ে মাওয়া-জাজিরায় সেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার। পরের কয়েক বছরে অব্যাহত ভাঙনের কারণে প্রকল্পের ইআইএ প্রতিবেদনে সেতুর দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারে নির্ধারণ করার কথা বলা হয়। একই সঙ্গে ভাঙন ঠেকাতে নদীর তীর সংরক্ষণের ওপরও গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হয়। পাশাপাশি পদ্মা সেতু এলাকায়; বিশেষ করে সেতুর ভাটি অঞ্চলে নদীভাঙন পর্যবেক্ষণের জন্য সেতু কর্তৃপক্ষ বা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সঙ্গে নিয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠনেরও সুপারিশ করা হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট নদী শাসন কার্যক্রমে কোনো পরিবর্তনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, নকশার ভিত্তিতেই আমরা পদ্মা সেতুর জন্য নদী শাসনের কাজ করছি। এটায় কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। এরই মধ্যে নদী শাসন কাজ ৮৫ শতাংশের বেশি শেষ হয়েছে।
নদী তীর বেঁধে ফেলাতেই ভাঙন সমস্যার সমাধান দেখতে পাচ্ছেন বুয়েটের পানিসম্পদ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান। তিনি বলেন, নদীতে যেকোনো অবকাঠামো তৈরি করলে তার একটা প্রভাব অবশ্যই পড়ে। তবে পদ্মায় যে ভাঙন হচ্ছে তার সঙ্গে সেতুর খুব একটা সম্পর্ক নেই। এখন যেভাবে পদ্মায় ভাঙন হচ্ছে সেতু না থাকলেও সেভাবেই ভাঙন দেখা দিত। নদীভাঙন রোধের একমাত্র স্থায়ী সমাধান নদী তীর বেঁধে ফেলা। এটা শুধু পদ্মার জন্য নয়, সব নদীর জন্যই প্রযোজ্য।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com