‘সিরাতুল মুসতাকিম’-এর অর্থ সহজ, সোজা, সরল, সঠিক পথ। কুরআনের শুরুতেই পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার শিখানো দোয়াটি যথাসম্ভব বেশি বেশি আমরা যেন তার দরবারে পেশ করতে থাকি ভিক্ষুক বেশে। কারণ এ দোয়াটি দয়া করে যদি আল্লাহ মঞ্জুর করেন তাহলে আমরা ইনশাআল্লাহ মহা সফল বা জান্নাতবাসী হতে সক্ষম হবো। দোয়াটি- ‘ইহদিনাস সিরাতাল মুসতাকিম’। অর্থ- ‘হে আল্লাহ! আমাদেরকে সঠিক পথ (সিরাতুল মুসতাকিম) প্রদর্শন বা দান করুন।’ আমীন। ‘সঠিক পথ’ কি? অন্যত্রে আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন। ‘হে গোলামগণ! আমার (আল্লাহর) দাসত্ব করো অর্থাৎ আমার আদেশ ও নিষেধাজ্ঞা যথাযথভাবে পালন করো। (কারণ) ইহাই সিরাতুল মুসতাকিম বা সঠিক পথ’ (সূরা ইয়াসিন : ৬১)। সিরাতুল মুসতাকিম কত উঁচু স্তরের, কত তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ তার চূড়ান্ত প্রমাণ আল্লাহর বাণী- ‘নিশ্চয় আপনি (রাসূল সা:) প্রেরিত রাসূলদের একজন এবং সিরাতুল মুসতাকিমের ওপর আসীন’ (সূরা ইয়াসিন : ৩)। বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বজ্ঞানী, নবী ও রাসূলদের নেতা যে পথে আসীন, সে পথের সঠিকতা বর্ণনাতীত। সে পথ মহা সফলতার পথ। সে পথ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তাঁর সাক্ষাত পাওয়ার পথ। সে পথের শেষ প্রান্তে চির সুখ-শান্তি ও ভোগ বিলাসের স্থান ‘জান্নাত’ অবস্থিত।
আসুন আমরা জেনে নেই আল্লাহর শিখানো উপরিউক্ত দোয়াটি পরিপূর্ণভাবে যা প্রত্যেক সালাতে প্রত্যেক রাকাতে পড়া হয় আবশ্যিক হিসেবে। কারণ তা না হলে সালাত আদৌ আদায় হবে না। দোয়াটির শুরু- ‘ইহদিনাস সিরাতাল মুসতাকিম’ হতে ‘ওয়ালাদ দোয়াল্লিন’ পর্যন্ত, যা শেষ হতেই নীরবে বা সরবে মুসল্লিরা উচ্চারণ করেন ‘আমীন’ অর্থাৎ- হে আল্লাহ! দয়া করে দোয়াটি কবুল করুন। উপরিউক্ত দোয়াটির অর্থÑ ‘আমাদেরকে সরল পথ দেখাও। সেসব লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নিয়ামত দান করেছ। তাদের পথ অবশ্যই নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাজিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে’ (সূরা ফাতিহা : ৬-৭)। পুরো দোয়াটিতে চারটি অংশ। প্রথম অংশ উপরে সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে। দ্বিতীয় অংশ আল্লাহর নিয়ামতপ্রাপ্ত বা সৌভাগ্যবানদের পথ। তাদের পরিচয় পাওয়া যায় আল্লাহর বাণী দ্বারা- অর্থ- ‘আর যে কেউ আল্লাহর হুকুম এবং তাঁর রাসূলের হুকুম মান্য করবে, তাহলে যাদের প্রতি আল্লাহ নিয়ামত দান করেছেন, সে তাদের সঙ্গী হবে, তারা হলেন নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তি। আর তাদের সান্নিধ্যই হলো উত্তম’ (সূরা নিসা : ৬৯)। তৃতীয় ও চতুর্থ অংশ আজাব-গজবপ্রাপ্ত ও পথভ্রষ্টদের পথ নয়। আজাব-গজবপ্রাপ্ত হলো তারা যারা মুমিন মুসলিম নয়। কারণ তাদের করুণ পরিণাম জাহান্নামবাস, যা চরম পরম আজাব ও গজব আল্লাহর তরফ থেকে। পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা দিয়েছেন- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা প্রদর্শন করেন বা দান করেন যাকে ইচ্ছা সিরাতুল মুসতাকিম বা সঠিক পথ’ (সূরা বাকারা : ১৪২)।
সম্মানীত পাঠক! আমাদেরকে গভীরভাবে ভাবতে হবে- কী উপায় অবলম্বনে আমরা মহামূল্যবান সঠিক পথের পথিক হতে পারি। আমার মতে, প্রাথমিক প্রয়োজন প্রতিদিন নীরবে নিভৃতে বসে প্রয়োজনবোধে চোখ বন্ধ করে কিছুটা সময় যথাসম্ভব গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা আল্লাহকে, তাঁর রাসূলকে, মৃত্যু, কবর, পরকাল, জান্নাত, জাহান্নাম, হিসাব-নিকাশ, শেষ বিচার ইত্যাদি এবং সাথে সাথে কিছু আত্মজিজ্ঞাসা যেমন- আমি কি সৎ লোক? আমি কি পিতা-মাতার প্রতি যথাযথ দায়িত্বশীল, নাকি দায়িত্বহীন? আমি কি মনে রাখি আমার মায়ের পায়ের নিচে আমার জান্নাত, নাকি ভুলে যাই? আমার সন্তানরা কি সৎ সন্তান? আমি কি কৃপণ, না উদার? আমি কি দাম্ভিক, না বিনয়ী?
আমি কি পরোপকারী, না অত্যাচারী? আমার মন কি কোমল, না কঠিন? আমি কি অন্যের সুখে সুখী, অন্যের দুঃখে দুঃখী? আমার কর্মকা- বা চিন্তাধারা, সময়ের ব্যবহার, মানুষের সাথে আমার আচার-আচরণ, আমার চালচলন, আমার জীবন যাপন ইত্যাদি কি ইসলাম ধর্মসম্মত? জবাব যদি ‘হ্যা’ হয়, তাহলে চমৎকার, আমার জন্য সুসংবাদ, বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার! পক্ষান্তরে, জবাব যদি ‘না’বাচক হয় তাহলে আমি হতভাগা, সর্বহারা, আল্লাহর রোষানলে নিক্ষিপ্ত, সর্বশেষ বাসস্থান জাহান্নাম এমনকি তা হতে পারে চিরকালের জন্য, যদি ঈমানহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করি। নাউজুবিল্লাহ মিন জালিক, অর্থাৎ- এহেন দুরবস্থা বা হতভাগা হতে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! দয়া করে তাওফিক দান করুন আমরা যেন আলোচ্য দোয়াটির ব্যাপক ব্যবহার ও প্রচলনের মাধ্যমে সিরাতুল মুসতাকিমের পথিক হয়ে এবং আমরণ এ পথে অবস্থান করে উভয় জগতের কল্যাণ অর্জন করতে এবং জান্নাতবাসী হতে পারি। আমীন। লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশ ও চেয়ারম্যান এবং প্রতিষ্ঠাতা অংশীদার, আজিজ হালিম খায়ের চৌধুরী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস।