করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ‘ওমিক্রন’ যেসব দেশে শনাক্ত হয়েছে সেসব দেশ থেকে বাংলাদেশের যাত্রী আসা বন্ধ করার সুপারিশ করেছে কোভিড ১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। রবিবার (২৮ নভেম্বর) কমিটির ৪৮তম সভায় বিশদ আলোচনার পর এই পরামর্শ দেওয়া হয় বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। এছাড়া বিভিন্ন সমাবেশে (রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়) জনসমাগম সীমিত করার সুপারিশ জানিয়েছে কমিটি। নতুন শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাসের ভয়ংকর ধরন ‘ওমিক্রন’ প্রতিরোধে ১৫ দফা সুপারিশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
১. দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, বতসোয়ানা, এসওয়াতিনি, লেসোথো ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক সময় সময় ঘোষিত অন্যান্য আক্রান্ত দেশ থেকে আসা যাত্রীদের বন্দরসমূহে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও স্ক্রিনিং জোরদার করতে হবে। ২. সব ধরনের (সামাজিক/রাজনৈতিক/ধর্মীয়/অন্যান্য) জনসমাগম নিরুৎসাহিত করতে হবে। ৩. প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে গেলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সর্বদা সঠিকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। ৪. রেস্তোরাঁতে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা ধারণক্ষমতার অর্ধেক বা তার কম করতে হবে। ৫. সব জনসমাবেশ, পর্যটন স্থান, বিনোদন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার, সিনেমা হল/থিয়েটার হল ও সামাজিক অনুষ্ঠানে (বিয়ে, বৌভাত, জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি) ধারণক্ষমতার অর্ধেক বা তার কমসংখ্যক লোক অংশগ্রহণ করতে পারবে। ৬. মসজিদসহ সব উপাসনালয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। ৭. গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। ৮. আক্রান্ত দেশসমূহ থেকে আসা যাত্রীদের ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। ৯. সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (মাদরাসা, প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয়) ও কোচিং সেন্টারে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। ১০. সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সেবা গ্রহীতা, সেবা প্রদানকারী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সর্বদা সঠিকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। ১১. স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভ্যাকসিন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। ১২. করোনা উপসর্গ/লক্ষণযুক্ত সন্দেহজনক ও নিশ্চিত করোনা রোগীর আইসোলেশন ও করোনা পজিটিভ রোগীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা অন্যান্যদের কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ১৩. কোডিড-১৯ এর লক্ষণযুক্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশনে রাখা এবং তার নমুনা পরীক্ষার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে সহায়তা করা যেতে পারে। ১৪. অফিসে প্রবেশ এবং অবস্থানকালে বাধ্যতামূলকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা দাফতরিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে। ১৫. কোডিড-১৯ রোগ নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাস করার নিমিত্তে কমিউনিটি পর্যায়ে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সচেতনতা তৈরির জন্য মাইকিং ও প্রচারণা চালানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে মসজিদ/মন্দির/গির্জা/প্যাগোডার মাইক ব্যবহার করা যেতে পারে এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর/ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যসহ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। এদিকে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি ৪৮তম সভা শেষে চারটি সুপারিশ করেছে। যার মধ্যে রয়েছে, ওমিক্রন সংক্রমিত দেশ থেকে বাংলাদেশে যাত্রী আসা বন্ধ রাখা, এসব দেশ থেকে এলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতকরণ, বন্দরে কোভিড পরীক্ষা জোরদার ইত্যাদি।
পরামর্শক কমিটি বলছে, ওমিক্রন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওমিক্রনকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর বিস্তার রোধে এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক দেশ, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ জিম্বাবুয়ে, নামিবিয়া, বোতসোয়ানা, সোয়াজিল্যান্ড থেকে যাত্রী আগমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফ্লাইটসহ)। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশেও এসব দেশ এবং যেসব দেশে সংক্রমণ ছড়িয়েছে সেসব দেশ থেকে যাত্রী আগমন বন্ধ করার সুপারিশ করা হচ্ছে।
এছাড়া পরামর্শক কমিটির অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে আছে, কোনও ব্যক্তির এসব দেশে ভ্রমণের বিগত ১৪ দিনের ইতিহাস থাকলে তাদের বাংলাদেশে ১৪ দিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। কোভিড পজিটিভ হলে আইসোলেশন করতে হবে।
প্রতিটি পোর্ট অব এন্ট্রিতে পরীক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত ব্যবস্থা আরও কঠোরভাবে পালন করা (স্কুল কলেজসহ), চিকিৎসা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা ও করোনার পরীক্ষায় জনগণকে উৎসাহিত করার জন্য বিনামূল্যে পরীক্ষা করার সুপারিশ করা হচ্ছে।
‘ওমিক্রন’ রুখতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১৫ দফা সুপারিশ: নতুন শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাসের ভয়ংকর ধরন ‘ওমিক্রন’ প্রতিরোধে ১৫ দফা সুপারিশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এসব পদক্ষেপ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে বলেছে সংস্থাটি। গত রবিবার রাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলামের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অন্যান্য দেশে করোনাভাইরাসের দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) ‘ওমিক্রন’-এর সংক্রমণ দেখা দেওয়ায় অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সব দেশকে এ সম্পর্কে সতর্ক করেছে। যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, বতসোয়ানা, এসওয়াতিনি ও লেসোথোর সঙ্গে আকাশপথে যোগাযোগ বন্ধ করেছে। নতুন এ ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা থেকেও অধিক সংক্রামক বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। তাই এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী ১৫টি পদক্ষেপ কঠোরভাবে বাস্তবায়নের জন্য অনুরোধ জানিয়েছে অধিদপ্তর।
ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট কী, কেন এটি বিপজ্জনক? করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন নিয়ে দুনিয়াজুড়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। কোভিডের আগের স্ট্রেইনগুলোর তুলনায় এটি কতটা শক্তিশালী? আক্রান্ত হলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কেমন? এটি কি করোনার প্রচলিত টিকাগুলোকে ফাঁকি দিতে সক্ষম? এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষের মনে। দক্ষিণ আফ্রিকায় গত বুধবার শনাক্ত হওয়া এই স্ট্রেইন নিয়ে বিশেষজ্ঞরা এখনই খুব বেশি কিছু ধারণা দিতে পারছেন না। তবে তাদের আশঙ্কা, এটি অতি সংক্রামক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও ধরনটিকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ বা উদ্বেগজনক হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করেছে। সাউথ আফ্রিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (এসএএমএ)-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন ড. অ্যাঞ্জেলিক কোয়েটজি। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে মেডিক্যাল প্র্যাকটিস করছেন তিনি। তার মতে, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটি ‘অস্বাভাবিক কিন্তু মৃদু’। তিনি নতুন করে বেশ কয়েকজনকে পরীক্ষা করেছেন। তাদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত। তাদের অধিকাংশই করোনার টিকা নেননি। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত যাদের শরীরে এই ধরনটি শনাক্ত করেছি, তাদের স্বাদ বা গন্ধ চলে যায়নি। তবে তাদের হালকা কাশি হতে পারে। এর বিশেষ কোনও উপসর্গ এখন পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি। আক্রান্তদের বেশ কয়েকজন বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।’
এদের মধ্যে ছয় বছর বয়সী এক শিশুও আক্রান্ত। তার নাড়ির স্পন্দন এবং শরীরের তাপমাত্রাও বেশি ছিল। এদের সবারই নতুন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন প্রবীণ এই চিকিৎসক। দক্ষিণ আফ্রিকার চিকিৎসক কোয়েটেজি ব্যাখ্যা করেন, ওমিক্রনে মৃদু উপসর্গ হিসেবে মাংসপেশির ব্যথা এবং দুই একদিনের মধ্যে ক্লান্তি দেখা দিতে পারে। দেশের হাসপাতালগুলো এখনও এতে আক্রান্ত রোগীদের ভিড় দেখা যায়নি। তবে প্রবীণ এবং যারা এখনও টিকা নেননি তারা এতে আক্রান্ত হলে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে।
দক্ষিণ আফ্রিকার সেন্টার ফর এপিডেমিক অ্যান্ড ইনোভেশন-এর পরিচালক টুলিও ডি অলিভিয়েরা এক টুইট বার্তায় বলেন, এই ভ্যারিয়েন্টটি অস্বাভাবিকভাবে মিউটেশন করেছে। ভাইরাসের যে অংশটি রিসিপটর বাইন্ডিং ডোমেইন, আমাদের শরীরের কোষের সঙ্গে প্রথম সংযোগ ঘটায়, নতুন ভ্যারিয়েন্টে সেটির ১০টি মিউটেশন রয়েছে। ভয়াবহ ক্ষতিকর হিসেবে আলোড়ন তৈরি করা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে এই মিউটেশন ছিল মাত্র দুটি। যেহেতু আফ্রিকার একাধিক দেশে এই ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে, ফলে আইসোলেশন না করে দেশগুলোর পাশে দাঁড়ানোর উচিত পুরো বিশ্বের। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ওমিক্রন এখন পর্যন্ত ৫০ বার রূপ বদল করেছে। স্পাইক প্রোটিনের বদল ঘটেছে ৩০ বারের বেশি। এটি সহজেই মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। দেহকোষে ঢুকে পড়ার জন্য যে কোনও ভাইরাস মূলত এ স্পাইক প্রোটিন ব্যবহার করে। আর স্পাইক প্রোটিনকে লক্ষ্য করেই বেশিরভাগ টিকা তৈরি করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এটি আগের ছড়িয়ে পড়া ভ্যারিয়েন্টের মতো ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, আফ্রিকার একাধিক দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ওমিক্রন। এর লক্ষণ নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় সংক্রামক রোগ ইনস্টিটিউট (এনআইসিডি) বলছে, বি.১.১.৫২৯ ভ্যারিয়েন্টে এখন পর্যন্ত অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা যায়নি। ডেল্টাসহ অন্যান্য ধরনের মতোই এখনও ওমিক্রনের প্রায় একই রকম লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সার্চ-কোভ-২ ভ্যারিয়েন্টগুলোকে ভালোভাবে অনুধাবন এবং এই বিষয়ে অধিক গবেষণার পরই জানা যাবে, জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।