তৃতীয় ধাপে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতা বাদে সরাসরি ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে এমন ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ছাড়িয়ে গেছে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। সরাসরি ভোট অনুষ্ঠিত ৯০৮টি ইউপির মধ্যে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৪৪৫টিতে এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা ৪২৬টিতে জয়ী হয়েছে। অবশ্য বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত আওয়ামী লীগের ৯৯ জন প্রার্থী যুক্ত হলে চিত্রটি ভিন্ন হবে। এদিকে আওয়ামী লীগ মাদারীপুরসহ কয়েকটি এলাকার বেশ কিছু ইউপিতে দলীয় প্রার্থী না দিয়ে উন্মুক্ত রেখেছে। যেখানে নির্বাচিতরা স্বতন্ত্র হলেও প্রায় সকলে আওয়ামী লীগ ঘরানার। গতকাল সোমবার (২৯ নভেম্বর) নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের মাঠ পর্যায়ের একীভূত ফলাফল থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নির্বাচনে গড়ে ৭৪ শতাংশ ভোট পড়েছে। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতারসহ ১০০৮টি ইউপির মধ্যে ৫৪৫টিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত এবং ৪২৬টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ছাড়াও বিএনপি ঘরানার প্রার্থী রয়েছে। এ নিয়ে তিন ধাপে ইউপির চেয়ারম্যান পদের নির্বাচনে নৌকা ১২৭৮টিতে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ৮৬১টিতে জয় পেয়েছে।
ইসির জনসংযোগ পরিচালক এস এম আসাদুজ্জামান জানান, তৃতীয় ধাপে চেয়ারম্যান পদে এক কোটি ৭৫ লাখ ৫৫ হাজার ২৬৬ জন ভোটারের মধ্যে এক কোটি ৩০ লাখ ২৮ হাজার ৩১৮ জন ভোট দিয়েছেন। সে হিসাবে ভোট পড়েছে ৭৪ দশমিক ২১ শতাংশ। গত শনিবার (২৭ নভেম্বর) এক হাজার আটটি ইউপিতে ভোট হওয়ার কথা থাকলেও স্থগিত হয় সাতটির নির্বাচন। ৯টি ইউপির বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত থাকায় ফল প্রকাশ হয়নি। ফলে ওইদিন নির্বাচন সম্পন্ন হয় ৯৯২টি ইউপিতে।
ইসির উপসচিব মো. মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত মাঠ পর্যায় থেকে পাঠানো ফলাফলের সমন্বিত প্রতিবেদন অনুযায়ীÍনৌকার প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছে ৫২৫টি ইউপিতে (এরমধ্যে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ৯৯ জন), স্বতন্ত্র ৪৪৬টিতে (বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় একজন) ও জাতীয় পার্টি ১৭টিতে জয় পেয়েছে। এছাড়া একটি করে ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। এর আগে ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ৮৩৪টি ইউপির মধ্যে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা চেয়ারম্যান পদে জয় পায় ৪৮৬টিতে এবং ৩৩০টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পান। এ ধাপে জাতীয় পার্টি ১০টিতে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ চারটি এবং জাতীয় পার্টি (জেপি), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, খেলাফত মসলিশ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) একটি করে ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছে।
গত ২১ জুন অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের প্রথম দফার ভোটে ২০৪টি ইউপির মধ্যে ১৪৮টি ইউপিতে নৌকা ও স্বতন্ত্র পেয়েছে ৪৯টি চেয়ারম্যান পদ। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ একটি, জাতীয় পার্টি-জেপি ও জাতীয় পার্টি-জাপা তিনটি করে চেয়ারম্যান পদে জয় পায়। এখন পর্যন্ত তিন ধাপের ভোট শেষ হয়েছে। আগামী ২৬ ডিসেম্বর চতুর্থ ধাপে ৮৪০টি ইউপিতে এবং ৫ জানুয়ারি পঞ্চম ধাপে ৭০৭টি ইউপিতে ভোট হওয়ার কথা রয়েছে।
ইসির উৎকণ্ঠা আওয়ামী লীগ জানে: ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে হতাহতের ঘটনায় নির্বাচনে কমিশনের উৎকণ্ঠার বিষয়টি আওয়ামী লীগ জানে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, তাদের (আওয়ামী লীগের) সঙ্গে আলাদা বৈঠক করিনি। কিন্তু আমরা বার্তা দিয়েছি। তারা জানে আমাদের উৎকণ্ঠা আছে। তাদের বলা হয়েছে যেন বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণে রাখে।
গত সোমবার (১৫ নভেম্বর) রাজধানীর নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয়Íনির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মারামারি হচ্ছে। কিন্তু দায় আসে আপনাদের ওপর। এ নিয়ে আওয়ামী লীগকে কোনও বার্তা দিয়েছেন?
জবাবে কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষ। মন্তব্য করা যাবে না। সহিংস ঘটনা কিন্তু নির্বাচন ছাড়াও ঘটে। পুলিশ তখন ব্যবস্থা নেয়। নির্বাচনের ঘটনাতেও পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি নূরুল হুদা বলেন, দলীয় লোকজন বঞ্চিত থাকায় এ রকম হতে পারে। এ নিয়ে আমাদের নিজস্ব বিশ্লেষণ নেই। এটা আমরা করতেও পারি না।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে উল্লেখ করে সিইসি বলেন, অস্ত্রের ব্যবহারের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি। কোনও একটি ঘটনা ঘটলে টিভিতে সেটা বারবার দেখানো হয়। এতে মানুষের ধারণা হয় সব জায়গায় বুঝি এমন ঘটছে। আরেক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, আমাদের কাছে একটি মৃত্যুও স্বাভাবিক নয়। ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং করেছি। যেসব বিভাগে বেশি নির্বাচন আছে, সেখানে গিয়ে মোটিভেট করার চেষ্টা করা হবে বলেও তিনি জানান। এর আগে লিখিত বক্তব্যে নূরুল হুদা বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে কয়েকটি স্থানে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। কোনোটাই প্রত্যাশিত নয়। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসবের পেছনে ছিল আধিপত্য বিস্তার, বংশীয় প্রভাব ও ব্যক্তিগত শত্রুতা। সিইসি আরও বলেন, দ্বিতীয় পর্যায়ে ৮৩৩টি ইউপি নির্বাচনে আট হাজার ৪৭২টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হয়। এরমধ্যে ১৬টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ প্রিজাইডিং অফিসারের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত হওয়ায় বন্ধ করা হয়। তারপরও ভোটকেন্দ্রের বাইরে বিচ্ছিন্ন হানাহানি ও প্রাণহানি ঘটেছে, যা কাম্য নয়।
সিইসি দাবি করেন, ইউপি নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে যথাযথ প্রস্তুতি নেয়। ভোট গ্রহণের দিন ও আগে-পরে ভোটকেন্দ্র ও নির্বাচনি এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পর্যাপ্ত পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যসহ র্যাব, কোস্টগার্ড ও বিজিবির মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স মোতায়েন করা হয়। এছাড়া আচরণবিধি ভঙ্গসহ নির্বাচনি অপরাধের বিচারের জন্য নির্বাচনি ও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়। ওইসব এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়। তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় নরসিংদীর রায়পুরের একটি দুর্গম চরে হতাহতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। গণমাধ্যমে এসেছে, গত ১০ বছর ধরে আধিপত্য বিস্তারের নামে নরসিংদীর চরাঞ্চলগুলোতে দুই শতাধিক মানুষ মারা গেছে। নরসিংদীতে এবারের প্রথম ঘটনাটি ঘটে ৪ নভেম্বর। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে নির্বাচনের দিন ভোরে।
তিনি আরও বলেন, মাগুরার যে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে তা নির্বাচনি প্রতীক বরাদ্দের আগে। যা ছিল এলাকার প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে। মেহেরপুরের গাংনির ঘটনার পেছনে ছিল বংশগত আধিপত্য বিস্তার। মেহেরপুরের ঘটনা ঘটেছে নির্বাচনের দিন ভোর-রাতে। তাদের চিহ্নিত করে বিচারের সম্মুখীন করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে দুই ধাপের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। আরও দুই ধাপের কার্যক্রম চলছে। এরপর একাধিক ধাপে ইউপি নির্বাচন হবে। সেগুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।