রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ১২:৪৫ অপরাহ্ন

বোরো ধান চাষে বছরে বালাইনাশকে হয় ব্যয় দেড় হাজার কোটি টাকা

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় রবিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২১

ধান উৎপাদনে বালাই ব্যবস্থাপনায় বিশেষ করে আগাছা দমনেই মোট উপকরণ ব্যয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ খরচ হচ্ছে বলে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) আয়োজিত এক কর্মশালায় জানানো হয়। গতকাল ভ্যালিডেশন অ্যান্ড আপস্কেলিং অব রাইস ট্রান্সপ্লান্টিং অ্যান্ড হারভেস্টিং টেকনোলজি ইন দ্য সিলেক্টেড সাইটস অব বাংলাদেশ (ভিআরটিএইচবি) শীর্ষক এ কর্মশালায় আগাছা দমন সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কীভাবে ক্ষতির মাত্রা কমানোর পাশাপাশি এ খাতে ব্যয় কমানো যায় সে বিষয়েও নানা তথ্য উঠে আসে। দেশে কয়েক বছর ধরেই ৪৭ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধান উৎপন্ন হয়। এ ধানের উৎপাদন খরচের একটি বড় অংশজুড়ে থাকে কীটনাশক ও বালাইনাশক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কৃষিবিষয়ক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, প্রতি হেক্টর জমিতে বোরো ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে এ বাবদ ব্যয় হয় ৩ হাজার ৭২ টাকা। প্রতি টন ধান উৎপাদনে এ ব্যয় ৫৪৬ টাকা। অর্থাৎ বছরে কেবল কীটনাশক ও বালাইনাশকের পেছনেই বোরো ধান চাষীর ব্যয়ের পরিমাণ ছাড়িয়ে যায় দেড় হাজার কোটি টাকা।
কৃষকের এ খরচ কমাতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বেশকিছু পরিবেশবান্ধব যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে। যার মাধ্যমে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কমানো সম্ভব। পাশাপাশি এ ব্যবস্থা পরিবেশের ক্ষতি করে না ও তুলনামূলক সুলভ বলে তা কৃষকের উৎপাদন ব্যয় কমাতেও সহায়তা করবে বলে মনে করছে প্রতিষ্ঠানটি।
কর্মশালায় ব্রি মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, আগাছা দমনে কায়িক শ্রম, সময় ও ব্যয় কমাতে শক্তিচালিত নিড়ানি যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে ব্রি। এ যন্ত্রের মাধ্যমে একসঙ্গে একাধিক সারির আগাছা দমন করা সম্ভব। এটি জনপ্রিয় করা গেলে ধানের আগাছা দমনে রাসায়নিক আগাছানাশকের ব্যবহার কমবে। এছাড়া ব্রি উদ্ভাবিত রাইস ট্রান্সপ্লান্টার কাম সার প্রয়োগ যন্ত্রের মাধ্যমে একই সঙ্গে ধানের চারা রোপণ ও সব ধরনের সার একসঙ্গে প্রয়োগ করা যায়। ফলে কৃষকের অর্থ ও সময় সাশ্রয় হয় এবং ফসলের উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। এ যন্ত্রের উপযোগিতা প্রমাণে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। যার আওতায় প্রকল্প এলাকার শস্য, শস্য বিন্যাস, মাটি ও কৃষকের চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে সঠিক মডেলের কম্বাইন হারভেস্টার নির্বাচন ও বিজনেস মডেল তৈরি করা হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কীটনাশক ও বালাইনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে কৃষকের উৎপাদন খরচ যেমন বাড়ছে, তেমনি কৃষকের স্বাস্থ্যহানি ঘটছে। বিভিন্ন ধরনের বালাইনাশকের প্রভাবে মানুষ, গবাদি পশু, মৎস্য সম্পদসহ সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়ছে। কীটনাশক মাটি ও ভূগর্ভস্থ পানিকে দূষিত করে জনস্বাস্থ্যকে বিপজ্জনক করে। এ বিষাক্ত পানি ব্যবহারে মানুষের স্নায়বিক রোগ বা ক্যান্সারও সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া এসবের ব্যবহারের কারণে অনেক উপকারী পোকাও ধ্বংস হয়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
বাংলাদেশে সাধারণত ধান ক্ষেতে বাদামি গাছফড়িং বা কারেন্ট পোকার আক্রমণ সবচেয়ে বেশি দেখা দেয়। ধান রোপণের আগেই কিছু ব্যবস্থা নিলে বিশেষ কিছু পোকার আক্রমণ রোধ করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট দূরত্বে চারা রোপণ, আইলের মাঝে বিলি কেটে দেয়া, ইউরিয়া সারের যথাযথ প্রয়োগ, আগাম ও প্রতিরোধক্ষমতা সক্ষম জাতের চারা রোপণ ইত্যাদি। প্রাকৃতিক নিয়মেই জমিতে ক্ষতিকর পোকার পাশাপাশি বন্ধু পোকাও থাকে, যারা ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু কোনো বিচার-বিবেচনা না করে কেবল পোকা দমনে ওষুধ ব্যবহার করা হলে ভালো পোকাও মারা পড়ে, যা জমির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে ধান ক্ষেতে হাঁস ছেড়ে দেয়া একটি সহজ সমাধান হতে পারে। তাছাড়া নিম, বন কলমি, নিশিন্দা, হলুদ প্রভৃতি গাছের নির্যাস ও মেহগনি বীজের কার্নেলের নির্যাস ব্যবহার করেও বাদামি গাছফড়িং দমন করা সম্ভব। যার মাধ্যমে পরিবেশের ওপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না।
এ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর অর্গানিক এগ্রিকালচার মুভমেন্টের (আইএফওএম) সদস্য ও বাংলাদেশ জৈব কৃষি নেটওয়ার্কের (বিওএএন) সাধারণ সম্পাদক ড. মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, কীটনাশক ও বালাইনাশকের ভারসাম্যহীন ব্যবহারের কারণে অর্থের অপচয় হচ্ছে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, পাশাপাশি কৃষকের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। আবার নদী-নালা কিংবা জলাধারে এখন সেভাবে ছোট মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী আগাছানাশকের ক্ষতিকর স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে নানা তথ্য উঠে এসেছে। এমনকি ক্যান্সারের মতো রোগের কারণও হচ্ছে আগাছানাশক। কৃষিতে বালাইনাশকের প্রয়োজন হলে বায়ো পেস্টিসাইডসের ব্যবহার বাড়াতে হবে। সারা বিশ্বে যে জৈব কৃষির প্রচলন হচ্ছে, সেটি কার্যকরভাবে দেশে চালু করতে হবে। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমে আসবে, পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকিও কমবে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে দেশের শস্য ক্ষেতে বিভিন্ন জাতের পোকার মধ্যে মাত্র ৩৮ শতাংশ ফসলের জন্য ক্ষতিকর। ফসলের জন্য সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ফসলের উপকার করছে বাকিসব কীটপতঙ্গ বা পোকা। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ সরাসরি ফসলের জন্য উপকারী। আর ৩২ শতাংশ পোকা ক্ষতিকর পোকা খেয়ে বা পরজীবী ও পরভোজী হিসেবে ফসলের উপকার করে থাকে। কিন্তু পোকা দমনে কীটনাশকের ব্যবহার বাড়ার ফলে উপকারী পোকা ধ্বংস হচ্ছে। তাই উপকারী পোকা রক্ষা করা ছাড়াও অবাধে কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে কৃষক প্রশিক্ষণ ছাড়াও বিকল্প পদ্ধতি ও প্রযুক্তি কৃষকের মাঝে স¤প্রসারণ করতে হবে। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা প্রকল্প ছাড়াও বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বিষমুক্ত ও কীটনাশকমুক্ত শাক-সবজি ও ফল আবাদের পদ্ধতি কৃষকের মাঝে পৌঁছে দিতে হবে। ফেরোমেন ফাঁদ, জৈব বালাইনাশক ও নতুন প্রযুক্তিগুলো জনপ্রিয় করতে হবে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com