‘বারোমাসি বা গ্রীষ্মকালীন টমেটোর ফলন পাওয়া যায় ছয় থেকে সাত মাস। বাজার ব্যবস্থাও ভালো থাকে। বিক্রি করা যায় একশ টাকার ওপরে প্রতি কেজি। পাইকারিতে ২৫ কেজির ক্যারেট বিক্রি করা যায় তিন হাজার টাকায়। শীতকালীন টমেটোর চেয়ে গ্রীষ্মকালীন জাতের এই টমেটোতে আট থেকে ১০ গুণ বেশি আয় করা সম্ভব। এক বিঘা জমিতে যদি এই জাতের টমেটো চাষ করা হয় তাহলে খরচ হবে ৫০-৬০ হাজার টাকা। আর বিক্রি করা যাবে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা।’
ময়মনসিংহ সদরের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার বোরোরচরের কুষ্টিয়া পাড়া গ্রামে বারোমাসি টমেটোর বাগানে দাঁড়িয়ে এ কথা বলছিলেন বিদেশফেরত চাষি মো. আবুল কালাম। তার শেড পদ্ধতির বাগানে থরে থরে টমেটো ফলেছে। পুরো বোরোরচরই টমেটো চাষের জন্য বিখ্যাত। সবজির স্বর্গখ্যাত এই এলাকা থেকে বছরে কোটি কোটি টাকার টমেটো যায় সারাদেশে।
মো. আবুল কালাম সিঙ্গাপুরে ছিলেন ১৩ বছর। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ছুটিতে আসেন বাংলাদেশে। পরে করোনার কারণে আর সিঙ্গাপুরে ঢুকতে পারেননি। কৃষির প্রতি ছিল আলাদা টান। কর্মসূত্রে সেখান থেকে গেছেন ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড। সেখানে দেখেছেন তাদের উন্নত চাষাবাদ। আধুনিক কৃষির সঙ্গে তারা যুক্ত। স্বল্প খরচে কীভাবে বেশি ফলন পাওয়া যায় তা জানে তারা। এটা তার কাছে খুব ভালো লেগেছিল। তখন থেকে পরিকল্পনা ছিল, যদি কখনো দেশে ফেরেন তাহলে কৃষিকাজ করবেন।
আবুল কালাম বলেন, ‘কৃষি আমাদের প্রাণ, আমি কৃষকের সন্তান, কৃষি প্রধান বোরোরচর আমার এলাকা। সেজন্য এই কাজেই মনোনিবেশ করি।’
এই চাষি বলেন, এটা বারি-৮ জাতের টমেটো। সারা বছর ধরে। তবে গাছ অবশ্যই গ্রাফটিং করতে হবে। গ্রাফটিং ছাড়া বারোমাসি জাত হলেও বেশিদিন টিকবে না। বর্ষাকালে এটার ভালো ফলন আসে। শীতকালেও আমি জাতটাকে ট্রায়ালে রেখেছি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাদের মাধ্যমে বীজ সংগ্রহ করি। শীতেও ভালো ফলন এসেছে।
চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি বলেন, বর্ষাকালে গ্রাফটিং পদ্ধতিতে চাষ করতে হয়। আর বর্ষার টমেটোয় লাভও অনেক বেশি। জানুয়ারিতে বীজতলায় বীজ দিতে হয়। গ্রাফটিং পদ্ধতিতে গেলে তিত বেগুনের চারা দিতে হয় একই সঙ্গে। গ্রাফটিং করার উদ্দেশ্য হলো বর্ষাকালে মাটিতে আর্দ্রতা বেশি থাকে। এসময় টমেটোতে ছত্রাক আক্রমণ করে। তিত বেগুনে কাটিং পদ্ধতিতে গ্রাফটিং করলে এর শিকড় অনেক শক্ত হয়। ফলে পানি শিকড় নষ্ট করতে পারে না।
মূলত কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্মকর্তাদের সঙ্গে নেত্রকোনা, সিলেট প্রভৃতি জায়গার বারোমাসি টমেটো ক্ষেত সরেজমিনে দেখে তিনি শুরু করেছেন বলে জানান।
আবুল কালাম বলেন, এই চাষে কীটনাশক বেশি লাগে না। ৯৭ শতাংশ গাছ ৬-৭ মাস বাঁচে। বর্ষার সময়টায় চ্যালেঞ্জ বেশি। এটা শেড পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। এখন কুয়াশা হবে বলে শেডে পলিথিন নেই। কুয়াশা বিশেষ উপকার করে। বর্ষায় শেডে পলি দিয়ে দেবো।
ফলন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নরমাল টমেটো এক থেকে দেড় মাস ফলন দেয়। একটি গাছে ১৫-২০ কেজি ফলন এসে শেষ। কিন্তু গ্রীষ্মকালীন বা বারোমাসি টমেটো গাছ সাত-আট ফুট লম্বা হবে। সব সময় ফুল-ফল থাকবে। একটি গাছ থেকে ৫০ কেজি পর্যন্ত ফলন পাওয়া সম্ভব। আশা করি সামনে আমরা টমেটো চাষে বিপ্লব ঘটাবো। আমাদের বিদেশ থেকে আমদানি করা লাগবে না।
তবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, বারি হাইব্রিড টমেটো-৮ ফল ধারণের ৩৫ দিনের মধ্যে ফল সংগ্রহ করা যায়। প্রতি হেক্টরে ফলন ৩৫-৪০ টন। এই জাতের টমেটোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো- উচ্চ তাপমাত্রায় ফুল ও ফল ধারনে সক্ষম, আকর্ষণীয় লাল বর্ণ বিশিষ্ট ত্বক ও শাঁস, হরমোন প্রয়োগ ছাড়াই গ্রীষ্মকালে চাষাবাদ করা যায়, গাছ প্রতি ফলন ৪০-৪৫টি।
বিদেশের অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে এসে তিনি আধুনিক পদ্ধতির চাষাবাদ করছেন। উৎসাহিত করছেন অন্যকে। আপাতত বিদেশ যাওয়ার আর পরিকল্পনা নেই। আবুল কালাম বলেন, আমি এখন আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম ভারত থেকে আমদানি করি। কয়েকটা উপজেলায় আধুনিক কৃষির সঙ্গে কৃষকের পরিচয় করিয়েছি। ব্যবসার পাশাপাশি কৃষকের উন্নতিও আমার লক্ষ্য। তবে দুঃখের বিষয় আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে কৃষক তার ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
‘ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ থেকে বোরোরচরের সড়কটি অত্যন্ত খারাপ। বোরোরচর এলাকা থেকে প্রতি বছর দুইশ’ কোটি টাকার মতো সবজি দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি হয়। দেশের বাইরে যাওয়ারও প্রক্রিয়া চলছে। শীতের সিজনে প্রতিদিন দুইশ-আড়াইশ ট্রাক এখান থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যায়। সড়কের যে অবস্থা, একটা গাড়ি এলে আরেকটা যেতে পারে না। গাড়ি রওয়ানা দিয়েও ঢাকার রাতের বাজারে অনেক সময় ঢুকতে পারে না। ফলে ন্যায্যমূল্য পায় না। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি।’ ময়মনসিংহ সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা তাহমিনা ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, বোরোরচরে গত বছর সাড়ে ১১শ’ হেক্টর জমিতে টমেটোর চাষ করা হয়। এ বছর এখন পর্যন্ত আটশ’ একর হয়ে গেছে। এটা আরও বাড়বে। বারোমাসি বা গ্রীষ্মকালীন টমেটোও জনপ্রিয় হচ্ছে। আমরা ১৫ অক্টোবর থেকে যে চারা লাগানো হয়েছে তাকে শীতকালীন টমেটো ধরি। বারোমাসি টমেটোর জীবনকাল একটু বেশি। অসময়ে ফল হওয়ায় কৃষক বেশি লাভবান হয়।-জাগোনিউজ২৪.কম