জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বিশ্বব্যাংকের মতো এখন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী হয়ে উঠছে চীনের নেতৃত্বাধীন এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি)। ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশে সংস্থাটি কার্যক্রম শুরু করে। এই স্বল্প সময়ে ১৩টি প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে বাংলাদেশে আড়াই বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে সংস্থাটি। নতুন করে বিনিয়োগ বাড়াতেও বাংলাদেশের সঙ্গে ঋণচুক্তি সই করেছে। আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে আরও তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে তারা।
ফলে বাংলাদেশে এআইআইবির মোট বিনিয়োগ দাঁড়াবে সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রতি ডলার সমান ৮৫ টাকা ধরে বাংলাদেশি মুদ্রায় এই বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৬ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, এআইআইবির এই ঋণ বাংলাদেশকে তিন বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ (এই সময়ে ঋণের আসল বা সুদ পরিশোধ করতে হবে না) ২০ বছরে পরিশোধ করতে হবে। এই ঋণের জন্য ফ্রন্ট অ্যান্ড ফি হিসেবে দশমিক ২৫ শতাংশ ও অব্যয়িত অর্থের ওপর বার্ষিক শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ কমিটমেন্ট ফি পরিশোধ করতে হবে। এই ঋণের সুদের হার নির্ধারিত হবে লাইবরের (লন্ডন আন্তর্জাতিক ব্যাংক লেনদেনে সুদের হার) সঙ্গে রেফারেন্স রেট ও ভেরিয়েবল স্প্রেড হারের সমন্বয়ে।
দেশের রপ্তানি আয় ২৪ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও সন্তোষজনক। এ কারণে উন্নয়ন সহযোগীরা এখন ঋণ দিতে বেশ আগ্রহী। অর্থনৈতিক আরও নানা সূচকে বাংলাদেশ এখন ভালো অবস্থানে রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ঋণ-জিডিপির অনুপাত এখনো ৪০ শতাংশের নিচে, করোনা মহামারির পরও মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের নিচে রয়েছে, রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি প্রায় ১৭ শতাংশ, খেলাপি ঋণ ৮ দশমিক ১ শতাংশে নেমে এসেছে। এছাড়াও চলতি (২০২১-২০২২) অর্থবছরের প্রথম কোয়ার্টারে ঋণস্থিতি বেড়েছে প্রায় ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসের সাময়িক হিসেবে নিট প্রফিট করেছে, ব্যাংকের ঋণের সুদের হার ৭ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এসব কারণেই মূলত উন্নয়ন সহযোগীরা ঋণ দিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
স্বাধীনতার ৩৮ বছরের মাথায় ১০০ বিলিয়ন ডলার জিডিপির মাইলফলক স্পর্শ করেছিল বাংলাদেশ। আর স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির অব্যবহিত আগে তা চারগুণ বেড়ে ৪১১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় ও সাহসী নেতৃত্বে মাত্র ১২ বছরের মাথায় এ অর্জন বাংলাদেশের। মূলত এসব কারণেই ঋণ সহায়তা বাড়িয়েছে এআইআইবি।
সড়ক অবকাঠামো, সেতু, স্বাস্থ্যসহ নানা উন্নয়নমূলক খাতে প্রকল্পের আওতায় আড়াই বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে এআইআইবি। এরই মধ্যে প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি হার্বারের আদলে ব্রিজ নির্মাণ করা হবে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর। ১১শ মিটার দীর্ঘ এ ব্রিজ দেখতে ধনুকের মতো হবে। নতুন প্রযুক্তির ‘স্টিল আর্চ ব্রিজ’ নির্মাণ প্রকল্পের মোট প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৭৯৩ কোটি ৭২ লাখ ১৮ হাজার টাকা। প্রকল্পে চীনের নেতৃত্বাধীন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) ঋণ সহায়তা এক হাজার ৯৩০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা বা ২৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। জানুয়ারি ২০২১ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবিত প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সিলেটের সঙ্গে রাজধানীসহ দেশের অন্য অংশের যোগাযোগ আরও উন্নত হচ্ছে। এ পথে বিদ্যমান দুই লেনের সড়কটি সার্ভিস লেনসহ ছয় লেনে উন্নীত করা হবে। ‘সাসেক ঢাকা-সিলেট করিডোর-৬ লেন সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প’ নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পে ৪০৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিচ্ছে এআইআইবি। এরই মধ্যে সংস্থাটির সঙ্গে বাংলাদেশের ঋণচুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে।
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপার্ডনেস’ প্রকল্পে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিচ্ছে সংস্থাটি। প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো কোভিড-১৯ মোকাবিলা এবং রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা। ‘বাংলাদেশ কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি অ্যান্ড ক্রাইসিস রেসপন্স ফ্যাসিলিটি’ প্রকল্পে ৩শ মিলিয়ন ডলার, ঢাকা স্যানিটেশন ইম্প্রুভমেন্ট প্রকল্পে ১৭০, সাসটেইনেবল ইকোনোমিক রিকভারি প্রোগ্রামে ২৫০, বাংলাদেশ রুরাল ওয়াটার, স্যানিটেশন অ্যান্ড হাইজিন ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পে ২শ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে সংস্থাটি।
এছাড়া ঢাকা অ্যান্ড ওয়েস্টার্ন জোন ট্রান্সমিশন গ্রিড এক্সপানশন প্রকল্পে ২শ মিলিয়ন ডলার, ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম আপগ্রেড অ্যান্ড এক্সপানশন প্রকল্পে ১৬৫, ন্যাচারাল গ্যাস ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ইফিসিয়েন্সি ইম্প্রুভমেন্ট প্রকল্পে ৬০, বাংলাদেশ পাওয়ার সিস্টেম আপগ্রেড অ্যান্ড এক্সপানশন (চট্টগ্রাম জোন) প্রকল্পে ১২০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে সংস্থাটি। ঢাকা মিউনিসিপাল ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যানিটেশন প্রকল্পে দিয়েছে ১শ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া কোভিড অ্যাক্টিভ রেসপন্স অ্যান্ড এক্সপানশন সাপোর্ট প্রকল্পে ২৫০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে। ফলে ১৩ প্রকল্পে দুই দশমিক ৫৭৯ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে সংস্থাটি।
এআইআইবির বিষয়টি দেখভাল করেন ইআরডির উপ সচিব (এশিয়া-১ অধিশাখা) কাওসার জাহান। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রতিনিয়তই নানা খাতে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে উন্নয়ন সহযোগীরা এগিয়ে আসছে বিনিয়োগ করতে। এরই ধারাবাহিকতায় স্বল্প সময়ে ১৩ প্রকল্পে আড়াই বিলিয়ন ডলার দিচ্ছে এআইআইবি। প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের সঙ্গে সংস্থাটির ঋণচুক্তি সই হয়েছে। দেশের উন্নয়নে বড় বড় প্রকল্পে ঋণ দিতে প্রস্তুত এআইআইবি। বলা যায় বিশ্বব্যাংক-এডিবির মতো বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী এআইআইবি।-জাগোনিউজ২৪.কম