বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:২৪ অপরাহ্ন

সুখময় জীবনের রহস্য

ফাতিমা আজিজা :
  • আপডেট সময় রবিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২১

মানুষ মাত্রই সুখের পেছনে ছুটে চলা এক জীবন্ত পিপিলিকার মতো। পিপিলিকা যেমন সুখের জন্য প্রদীপ খুঁজে বেড়ায় আর মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তার পেছনে ছুটে, তেমনই মানুষ। দুনিয়ার এই মরীচিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে মানুষ ক্লান্ত, তবুও কখনো সে থামে না। আসলেই কি দুনিয়ার পেছনে ছুটে কেউ কখনো সুখী হতে পেরেছে, নাকি দিন শেষে সবই মরীচিকা। আর এই মরীচিকার হাতছানি মাড়িয়ে যারা চিরস্থায়ী জীবনের জন্য সুখ সঞ্চার করে তারাই হয় সর্বক্ষেত্রে সফলকাম। চিরস্থায়ী সুখের সন্ধান যারা চায় তাদের উচিত কিছু রহস্যের সন্ধান করা।
প্রথমত, আল্লাহর ওপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা। ঈমানদার বা মুত্তাকি সেই ব্যক্তি যে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে একমাত্র আল্লাহর আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী কাজকর্ম করে। একান্ত অনুগত বান্দা হয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্বাস করে যে, সুখের মালিক আল্লাহ আর দুঃখের মালিকও আল্লাহ। যদি আল্লাহ জীবনে সুখ রাখেন তবে পৃথিবীতে কোনো বাধা সেই সুখ থেকে তাকে বঞ্চিত করতে পারবে না। আল্লাহ অবশ্যই মুমিনের জীবনে সুখ রেখেছেন সেটা দুনিয়ায় না হলেও চিরস্থায়ী আখিরাতে থাকবে।
আল্লাহ বলেছেন, ‘মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করবে, অবশ্যই আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব। আর অবশ্যই আমি তাদেরকে তারা যা করত তার তুলনায় শ্রেষ্ঠ প্রতিদান দেবো।’ (সূরা নাহল-৯৭)। এখানে হায়াতে তাইয়েবা বলতে দুনিয়ার পবিত্র ও আনন্দময় জীবন বোঝানো হয়েছে। আলী রা: বলেন, এর অর্থ স্বল্পে তুষ্টি। দাহহাক বলেন, হালাল রিজিক ও দুনিয়াতে ইবাদত করার তাওফিক। কারো মতে আখিরাতের জীবন। হাসান মুজাহিদ ও কাতাদা বলেন, জান্নাতে যাওয়া ব্যতীত কারোই জীবন স্বাচ্ছন্দ্যময় হতে পারে না। অর্থাৎ হায়াতে তাইয়েবা এসব অর্থের সবগুলোকেই শামিল করে। (ইবন কাসির)
মুমিন ব্যক্তি কোনো সময় আর্থিক অভাব অনটন কিংবা কষ্টে পতিত হলেও দু’টি বিষয় তাকে উদ্বিগ্ন হতে দেয় না। এক, অল্পে তুষ্টি এবং অনাড়ম্বর জীবন যাপনের অভ্যাস, যা দারিদ্র্যের মাঝেও কেটে যায়। দুই. তার এ বিশ্বাস যে, এ অভাব অনটন ও অসুস্থতার বিনিময়ে আখিরাতে সুমহান, চিরস্থায়ী নিয়ামত পাওয়া যাবে। কাফের ও পাপাচারীর অবস্থা এর বিপরীত।
রাসূল সা: বলেন, ‘সে ব্যক্তি অবশ্যই সফলকাম হয়েছে যে ইসলাম গ্রহণ করেছে, চলনসই মতো রিজিক দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহ তাকে যা দিয়েছে তাতেই সে তুষ্ট হয়েছে।’ (মুসলিম-১০৫৪)। রাসূল সা: দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ আমাকে যা রিজিক দিয়েছেন তাতে তুষ্ট করে দিন এবং তাতে আমার জন্য বরকত দিন আর আমার অনুপস্থিতিতে যে কাজ হয় তা ভালোভাবে শোধ করুন।’ (মুস্তাদরাকে হাকেম)।
দ্বিতীয়ত, সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর ভরসা করা। জীবনের সুখ শান্তি যাই আসুক না কেন মনের মাঝে দৃঢ় প্রত্যয় থাকতে হবে যে, আল্লাহই পারেন সবকিছু দান করতে। কুরআনে এসেছে, ‘এবং তাকে তার ধারণাতীত উৎস থেকে রুজি দান করবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর নির্ভর করবে, তার জন্য তিনিই যথেষ্ট হবেন। নিশ্চয় আল্লাহ তার ইচ্ছা পূরণ করবেনই। আল্লাহ সবকিছুর জন্য স্থির করেছেন নির্দিষ্ট মাত্রা।’ (সূরা তালাক-০৩)। অর্থাৎ, তিনি যা করতে চান, তা থেকে তাঁকে কেউ বাধা দিতে পারে না। কষ্টসাধ্য ও সহজসাধ্য সব কর্মের জন্যই। নির্ধারিত সময়েই উভয় (সহজ ও কঠিন) জিনিসেরই পরিসমাপ্তি ঘটে।
রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমরা যদি প্রকৃতভাবেই আল্লাহ তায়ালার ওপর নির্ভরশীল হতে তা হলে পাখিদের যেভাবে রিজিক দেয়া হয় সেভাবে তোমাদেরকেও রিজিক দেয়া হতো। এরা সকাল বেলা খালি পেটে বের হয় এবং সন্ধ্যা বেলায় ভরা পেটে ফিরে আসে।’ (তিরমিজি-২৩৪৪)। রাসূল সা: আরো বলেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে এমন একদল আছে যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে। তারা হলো সেসব লোক যারা মন্ত্র পাঠ করে না, পাখির মাধ্যমে কোনো কাজের ভালো-মন্দ নির্ণয় করে না এবং আগুনের সাহায্যে দাগ লাগায় না। বরং তারা তো তাদের রবের ওপরই ভরসা করে থাকে।’ (বুখারি-৫৭০৫)
তৃতীয়ত, নিম্নস্তরের লোকদের প্রতি দৃষ্টি দেয়া। আমরা যদি সত্যিকারে সুখের সন্ধানী হই তবে আমাদের উচিত হবে আমাদের চেয়েও যারা অধিক কষ্টের জীবন অতিবাহিত করছে তাদেরকে দেখা। রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমাদের চেয়ে নিম্নস্তরের লোকদের প্রতি দৃষ্টি দাও। তবে তোমাদের চেয়ে উঁচু স্তরের লোকেদের দিকে লক্ষ করো না। কেননা, আল্লাহর নিয়ামতকে তুচ্ছ না ভাবার এটাই উত্তম পন্থা।’ (সহিহ মুসলিম-৭৩২০)। সর্বস্তরের মানুষেরই আকাক্সক্ষা সুখ। তাই যদি অসহায় মানুষের দিকে তাকানো হয় দেখা যাবে আসলেই আমাদের তুলনায় তারাই বেশি কষ্টের জীবন চালাচ্ছে।চতুর্থত, আল্লাহর স্মরণে অন্তর প্রশান্তি করা। অন্তরের খোরাক হচ্ছে জিকির। সকাল-সন্ধ্যায় যখন আল্লাহর জিকিরে অন্তরকে সিক্ত করা হয় তখনই সুখের মুহূর্ত উপভোগ করা যায়। আল্লাহ বলেন, ‘যারা বিশ্বাস করেছে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের হৃদয় প্রশান্ত হয়। জেনে রাখো, আল্লাহর স্মরণেই হৃদয় প্রশান্ত হয়।’ (সূরা রাদ-২৮)
আল্লাহর স্মরণ বা জিকিরের অর্থ তাঁর তওহিদের (একত্ববাদের) বর্ণনা, যার দ্বারা মুশরিকদের অন্তর সঙ্কুচিত হয়ে যায়। জিকির অর্থ- তাঁর ইবাদত, কুরআন তিলাওয়াত, নফল ইবাদত এবং দোয়া ও মুনাজাত; যা ঈমানদারদের মনের খোরাক। অথবা তাঁর আদেশ-নির্দেশ পালন করা; যা ব্যতিরেকে ঈমানদার ও পরহেজগাররা অস্থির থাকেন।
রাসূল সা: বলেন, ‘যে তার প্রতিপালকের জিকির করে, আর যে জিকির করে না, তাদের উপমা হলো জীবিত ও মৃত ব্যক্তি।’ (বুখারি-৬৪০৭)। রাসূল সা: আরো বলেন, ‘যে লোক প্রতিদিন ১০০ বার সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহ বলবে তার গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেয়া হবে তা সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হলেও।’ (বুখারি-৬৪০৫)
পঞ্চমত, হিংসাত্মক মনোভাব পরিহার করা। হিংসা এমন একটি রোগ যা অন্তরে অবস্থান করলে কখনো সেই অন্তর সুখের সন্ধান পাবে না। সমাজের সাথে মানিয়ে চলতে গেলে অনেক রকম মানুষের সাথেই মিশতে হবে কিন্তু কখনো কারো প্রতি হিংসাত্মক মনোভাব রাখা যাবে না। পরিবার, সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে যদি সবার মাঝে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ এবং ভালোবাসা ছড়ানো যায় তবে সুখ নিজ থেকেই নিজের মাঝে এসে ধরা দেবে। কিন্তু হিংসা অন্তরে জীবিত রেখে নিজেকে জয়ী ভাবলেও দিন শেষে তাকে অন্তরের অসুখেই ভুগতে হবে। মানুষের সব ভালো কাজ হিংসা দ্বারা শেষ হয়ে যেতে পারে।
রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমরা অবশ্যই হিংসা পরিহার করবে। কারণ আগুন যেভাবে কাঠকে বা ঘাসকে খেয়ে ফেলে, তেমনি হিংসাও মানুষের নেক আমলকে খেয়ে ফেলে।’ (দাউদ-৪৯০৩)
ষষ্ঠত, সবার সাথে ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরণ করা। একে অপরের ভাই ভাই হয়ে বসবাস করার মধ্যে যেই সুখ বিরাজমান হয় সেটা অন্য কিছুতেই হয় না। নিজের ভালো চিন্তা করা ছাড়াও যদি অন্যের ভালো বেশি বেশি কেউ চিন্তা করে সে অবশ্যই সুখী। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেই সবার মুখে সুখের হাসি ফোটানো যায় না। তাই অন্যের মাঝেও সুখ দেখতে হলে নিজের জন্য যা ভালো মনে করবে অপরের জন্য ও সেটাই ভালো মনে করা। আর এটাই ইসলামে ভ্রাতৃত্বের মূল।
রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পরে বিদ্বেষ করবে না, একে অন্যের পেছনে শত্রুতায় আবদ্ধ হয়ো না, পরস্পরে লিপ্সা করবে না বরং তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসেবে ভাই ভাই হয়ে থাকো।’ (মুসলিম-৬৪৩৪)। মহান আল্লাহ নিজেই বলবেন একে অপরের প্রতি ভালোবাসার প্রতিদান হচ্ছে কিয়ামতের দিন বিশেষ ছায়ায় আশ্রয়।
রাসূল সা: বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, আমার মহত্ত্বের কারণে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা স্থাপনকারীরা কোথায়? আজ আমি তাদেরকে আমার বিশেষ ছায়ায় ছায়া প্রদান করব। আজ এমন দিন, যেদিন আমার ছায়া ব্যতীত অন্য কোনো ছায়া নেই।’ (সহিহ মুসলিম-৬৪৪২)
যার অন্তরে যত উদারতা করুণা আর ভালোবাসা সেই বেশি সুখী। সুখী হতে হলে অবশ্যই হিংসা বিদ্বেষ পরিহার করে সৌহার্দ্যপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করতে হবে। যার মূল উৎস হবে মহান আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের লক্ষ্য। ‘অন্তর হলো বুদ্ধির উৎসস্থল, করুণার স্থান হৃৎপি-, মায়া-মমতার স্থান যকৃত এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের স্থান ফুসফুস।’ (আদাবুল মুফরাদ-৫৪৯)




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com