বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:২৮ অপরাহ্ন

চীনের সঙ্গে শ্রীংলকার মধুচন্দ্রিমায় ভাটার টান

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় রবিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২১

ভারতের আগ্রাসন থেকে বাঁচতে চীনের দিকে ঝুঁকেছিল শ্রীংলকা। বেশ জমেও ছিল বন্ধত্বের মধুচন্দ্রিমা। ঋণের ফাঁদে ফেলে এখন এখন সহযোহিতার গুটিয়ে নিচ্ছে। চীনের সঙ্গে শ্রীংকার মধুচন্দ্রিমায় ভাটার টান পড়েছে।
আমদের দেশের পর্যবেক্ষকদেরকেও ভাবনায় ফেলেছে, বিষয়টি। কারণ আমাদের সাথেও চলছে চীনের দহরম মহরম। কয়দিন চলবে এই দহরম মহরম? শ্রীংলকার সাথে সার আমদানি নিয়ে শুরু। এরপর তা গড়িয়েছে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প পর্যন্ত। অনেকটা আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিতভাবেই চীনের সঙ্গে মনকষাকষি শুরু হয়েছে শ্রীলংকার। এর মধ্যেই আবার রিজার্ভ নেমে এসেছে ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে। খাদ্য ও ওষুধসহ অপরিহার্য দ্রব্যের আমদানি এক মাস চালানোর মতোও অর্থ নেই দেশটির হাতে। এ অবস্থায় ভারতের দ্বারস্থ হয়েছে কলম্বো। তাতে সাড়া দিয়ে শ্রীলংকার সঙ্গে এ নিয়ে কয়েকটি চুক্তিও করেছে ভারত। তবে পরিস্থিতি তাতে আরো ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে নানা উপায়ে প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছে চীনও।
শ্রীলংকার অর্থনীতি আর কখনই এতটা দুর্দশায় পড়েনি। পৌনে এক শতাব্দীর ইতিহাসে রেকর্ড সর্বনিম্নে নেমে এসেছে দেশটির রিজার্ভ। শ্রীলংকার পার্লামেন্টে উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসের শুরুতে দেশটির হাতে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১২০ কোটি ডলার। এ দিয়ে অপরিহার্য দ্রব্যের আমদানি এক মাসও চালানো সম্ভব না। উপরন্তু শিগগিরই বড় দুটি দেনার অর্থ পরিশোধের সময়ও এগিয়ে আসছে।
অতীতে এ ধরনের সংকট মোকাবেলার ক্ষেত্রে শ্রীলংকা সাধারণত চীনের দ্বারস্থ হয়েছে। চীনের কাছে শ্রীলংকার দেনা এরই মধ্যে ৫০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে। দেশটি থেকে ঋণ গ্রহণের আরো সুযোগ ছিল কলম্বোর। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে মতদ্বৈধতার শুরু সার আমদানি নিয়ে। চীন থেকে ৪ কোটি ৮০ লাখ ডলারের অর্গানিক সার আমদানিতে চুক্তি করেছিল শ্রীলংকা। কিন্তু এ আমদানীকৃত সারে ক্ষতিকর প্যাথোজেনের উপস্থিতির কারণ দেখিয়ে চুক্তিটি বাতিল করেছে কলম্বো। বর্তমানে এ-সংক্রান্ত আমদানি বিরোধের বিষয়টি সিঙ্গাপুর ও কলম্বোয় নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এ বিরোধ চলাকালেই আবার ভারত থেকে তরল নাইট্রোজেন সার আমদানির উদ্যোগ নেয় শ্রীলংকা। বিষয়টি চীনকে আরো ক্ষিপ্ত করে তোলে। অন্যদিকে শ্রীলংকার উত্তরাঞ্চলীয় তিনটি দ্বীপে হাইব্রিড সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা ছিল চীনের সিনো সোলার হাইব্রিড টেকনোলজির। সম্প্রতি লংকান সরকারের কয়েক কর্তাব্যক্তির বক্তব্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, বিষয়টি নিয়ে বিকল্প চিন্তাভাবনা করছে কলম্বো। এর পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীলংকা নিয়ে চীনের বিরক্তি রূপ নেয় বিরূপ মনোভাবে।
এমন এক মুহূর্তে শ্রীলংকার রিজার্ভ নেমে আসে ১২০ কোটি ডলারে। দেশটিতে খাদ্য ও ওষুধসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আমদানিতে মাসে অন্তত ১৩০ কোটি ডলারের প্রয়োজন পড়ে। সে হিসাবে দেশটির কাছে এক মাস আমদানি চালানোর মতো প্রয়োজনীয় অর্থও নেই। অন্যদিকে চীনও শ্রীলংকার সঙ্গে মনকষাকষির বিষয়টি প্রকাশ্যেই নিয়ে এসেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের শরণাপন্ন হয়েছে শ্রীলংকা।
চলতি মাসের প্রথম দিনে পার্লামেন্টে বাজেট অধিবেশন চলাকালেই ভারত সফরে যান শ্রীলংকার অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপাকসে। দুইদিনের এই সফর চলাকালে ভারতীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকরের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। এছাড়া ভারতের পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাসবিষয়ক মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরি এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গেও দেখা করেছেন বাসিল রাজাপাকসে। এছাড়া সফর চলাকালে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন বলে শ্রীলংকার স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছিল। তবে নরেন্দ্র মোদি ‘ব্যস্ত থাকায়’ এ সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়নি।
শ্রীলংকার জরুরি সহায়তা চেয়ে করা আবেদনে সাড়া দিয়েছে নয়াদিল্লি। সম্প্রসারিত লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় ভারত থেকে জরুরি খাদ্য ও ওষুধ আমদানির সুযোগ পাচ্ছে শ্রীলংকা। একই সঙ্গে সার্ক ফ্যাসিলিটির আওতায় কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে দেশটিকে ৪০ কোটি ডলার ঋণসহায়তা দিতে রাজি হয়েছে ভারত।
নির্মলা সীতারমণ ও এস জয়শংকরের সঙ্গে বাসিল রাজাপাকসের বৈঠক চলাকালে এসব সহায়তার বিষয়ে সম্মতি দেয় নয়াদিল্লি। এ সময় দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের লাইন স্থাপনের বিষয়েও একমত হন তারা। এছাড়া উদ্যোগটি তত্ত্বাবধানের জন্য নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষায়ও তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন।
অন্যদিকে হরদীপ সিং পুরির সঙ্গে বৈঠক চলাকালে সম্প্রসারিত লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় ভারত থেকে জ্বালানি আমদানিরও প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন বাসিল রাজাপাকসে। এছাড়া অজিত সিং দোভালের সঙ্গে তার বৈঠকেও পরস্পরের কৌশলগত স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। এ সময় শ্রীলংকার ত্রিঙ্কোমালিতে অবস্থিত একটি ট্যাংক ফার্মের আধুনিকায়নে ভারতের অর্থায়ন বৃদ্ধিরও প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন তিনি। বাজেট অধিবেশন চলাকালে আকস্মিক এ সফর নিয়ে এরই মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন বাসিল রাজাপাকসে। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে এ নিয়ে পার্লামেন্টে বলেন, ‘আমাদের আগের প্রেসিডেন্টরা একই সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বটিও পালন করেছিলেন। নানা ব্যস্ততার মধ্যেও তারা সব সময় বাজেট বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। আমরা আগে কখনই দেখিনি, জনগণের আর্থিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার সময়ে কোনো অর্থমন্ত্রী দেশে অনুপস্থিত থেকেছেন। কিন্তু আমাদের অর্থমন্ত্রী ভারতে গিয়ে এর মধ্যে ফিরেও এসেছেন। আমরা জানি না, আসলে তিনি ভারতের কাছে ভিক্ষে করতে গিয়েছেন কিনা।’
এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে ভারতের বৈরী দেশ চীন। সম্প্রতি দেশটির কলম্বো দূতাবাস এক টুইট বার্তায় ঘোষণা দিয়েছে, তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের কারণে শ্রীলংকার উত্তরাঞ্চলে জাফনা উপদ্বীপ-সংলগ্ন দ্বীপ তিনটিতে সিনো সোলারের বাস্তবায়নাধীন হাইব্রিড সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল হয়েছে। অন্য একটি দেশ নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। এছাড়া মালদ্বীপে একই ধরনের আরেকটি প্রকল্পের কাজ পেয়েছে সিনো সোলার।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর ভাষ্যে বলা হয়েছে, এখানে তৃতীয় পক্ষ বলতে ভারতকেই বুঝিয়েছে চীন। যদিও এখন পর্যন্ত এ-সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেয়নি কলম্বো।
চীনের পরবর্তী পদক্ষেপটি ছিল আরো অর্থপূর্ণ। গত সপ্তাহেই জাফনা উপদ্বীপ অঞ্চল সফরে যান শ্রীলংকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত চি জেনহং। বুধবার ও বৃহস্পতিবারÍএ দুই দিন সেখানকার তামিল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সময় কাটান তিনি। এখন পর্যন্ত চি জেনহংই জাফনা উপদ্বীপ অঞ্চলে সফরকারী প্রথম চীনা কূটনীতিক।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, শ্রীলংকায় চীনের অবকাঠামো প্রকল্পগুলো মূলত সিংহলি জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চলে। উত্তরাঞ্চলে এখন পর্যন্ত শুধু যুদ্ধবিধ্বস্ত সড়ক ও বাড়িঘর তৈরি করে দিয়েছে দেশটি। চি জেনহংয়ের দুই দিনব্যাপী এ সফরকে এখন তামিলদের সঙ্গে চীনের যোগাযোগকে আরো গভীর করে তোলার প্রয়াস হিসেবেই দেখা হচ্ছে। সফর চলাকালে ঐতিহ্যবাহী জাফনা লাইব্রেরিতে অনুদান হিসেবে ল্যাপটপ ও কম্পিউটার দিয়েছেন চীনা রাষ্ট্রদূত। এছাড়া লাইব্রেরিটির ডিজিটাইজেশনে সহায়তারও প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। ১৯৮৩ সালে জাতিগত দাঙ্গার সময়ে লাইব্রেরিটি পুড়িয়ে দিয়েছিল সিংহলিরা।
এছাড়া জাফনার মৎস্যজীবী জনসাধারণের মধ্যে স্থানীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে ১ লাখ ডলারের সমপরিমাণ মূল্যের জাল ও শুকনা রেশন বিতরণ করেছেন চীনা রাষ্ট্রদূত। চীনা রাষ্ট্রদূতের সফরসঙ্গীদের বরাত দিয়ে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, তামিলদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের তাগিদ থেকেই এ সফরে গিয়েছেন চি ঝেনহং। যদিও কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রীলংকার ক্ষমতাসীনদের খুব একটা বিশ্বাস করতে পারছে না বেইজিং। সফরটি ছিল এ অবিশ্বাসেরই বহিঃপ্রকাশ। অবিশ্বাস রয়েছে ভারতের মধ্যেও। শ্রীলংকার স্থানীয় সংবাদমাধ্যম নিউজওয়্যারে সম্প্রতি প্রকাশিত এক নিবন্ধে স্থানীয় সাংবাদিক ও কলম্বোভিত্তিক গবেষক আরআরএম লিলানি বলেন, শ্রীলংকার পররাষ্ট্রনীতিতে ধারাবাহিকতার অভাব ও ক্রমাগত ‘মুড সুইংয়ের’ অভাব নিয়ে বরাবরই অভিযোগ তুলে এসেছে ভারত। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতকে আপাতদৃষ্টিতে খুশিই বলা চলে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com